নালিতাবাড়ীর কোচ সম্প্রদায়: রাঙ্গা রঙ্গিন লেফেনের সুতোর পোষাকে বুনেন রঙ্গিন স্বপ্ন

নালিতাবাড়ীর কোচ সম্প্রদায়: রাঙ্গা রঙ্গিন লেফেনের সুতোর পোষাকে বুনেন রঙ্গিন স্বপ্ন

শিল্প ও সংস্কৃতি

এপ্রিল ১১, ২০২৩ ২:৫১ অপরাহ্ণ

মাহফুজুর রহমান সোহাগ, নালিতাবাড়ী (শেরপুর)

রাঙ্গা রঙ্গিন লেফেনের সুতোর পোষাক বুনে চলেছেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী পাহাড়ী কোচ সম্প্রদায়ের মানুষজন। তাদের চোখে মুখে রঙ্গিন উন্নয়নের স্বপ্ন এখন দৃশমান হয়ে ফুটে উঠেছে। এরই মধ্যে সরকার কতৃর্ক তাদের এলাকায় বডার্র হাট স্থাপনের জন্য জায়গা নির্ধারণ করায় এখন তারা আরও বেশি উৎসাহি উদ্যেমী হয়ে নিজেদের শৈল্পিক নৈপূন্যের কারুকাজ রাঙ্গা লেফেনের পোষাক তৈরিতে মন দিচ্ছেন। ঐতিহ্যগত এই হস্তপন্য এখন নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আবারো হাজির করতে যাচ্ছেন এই কোচ সম্প্রদায়ের মানুষজন। এখন তারা রাঙ্গা রঙ্গিন লেফেনের সুতোর পোষাকে বুনেন রঙ্গিন স্বপ্ন।

সাম্প্রতিক সময়ে নালিতাবাড়ী উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা খৃষ্টফার হিমেল রিছিল খলচান্দা গ্রামে গিয়ে ক্ষুদ্র নৃ—গোষ্ঠী কোচ সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যের পোষাক রাঙ্গা লেফেন তৈরি কারুকাজ দেখে এসেছেন।

সূত্রে জানা গেছে, শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার ভারত সীমান্ত ঘেঁষা পোড়াগাঁও ইউনিয়নের আন্ধারুপাড়া মৌজার খলচান্দা গ্রামের বাস করে হিন্দু ধর্মাবলম্বী কোচ সম্প্রদায়ের ৫৫টি পরিবারের প্রায় ৫ শতাধিক মানুষ। তারা বাংলাদেশ জন্ম হওয়ার আগে থেকেই ওই পাহাড়ী সীমান্ত গ্রামে বসবাস করে আসছেন। এরা ক্ষুদ্র নৃ—গোষ্ঠী কোচ সম্প্রদায়ের মানুষ হওয়ায় এদের পোষাকে রয়েছে ভিন্নতা। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে এ সম্প্রদায়ের পুরুষরা পড়েন ধুতি। আর নারীরা পড়েন রাঙ্গা লেফেন। নারীরা নিজেদের হস্ত শিল্পের তাঁত বা যন্ত্র দিয়ে নিজ হাতেই তৈরি করে থাকেন এই রাঙ্গা লেফেন।

নালিতাবাড়ীর কোচ সম্প্রদায়: রাঙ্গা রঙ্গিন লেফেনের সুতোর পোষাকে বুনেন রঙ্গিন স্বপ্ন

উপজেলার খলচান্দা গ্রামের কোচরা জানান, রাঙ্গা লেফেন বানাতে যে সুতার প্রয়োজন হয় তার দাম অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার কারনে এখন খুব বেশি রাঙ্গা লেফেন বানান না। আগে প্রায় প্রতি ঘরের নারীরা তাদের তৈরি রাঙ্গা লেফেন পড়তেন। দীর্ঘ বছর ধরে রাঙ্গা লেফেন না বানানোয় অনেকেই এটি বানানো ভুলে গেছেন। তাই হারিয়ে যেতে বসেছে কোচদের ঐতিহ্যের পোষাক রাঙ্গা লেফেন। হঠাৎ দুই একটি পরিবারের নারীরা অনেকটা শখের বসে মাঝে মধ্যে নিজেদের যন্ত্র দিয়ে রাঙ্গা লেফেন বানিয়ে থাকেন। বিশেষ করে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কিংবা নিজস্ব সাষ্কৃতিক অনুষ্ঠানে পরিধান করার জন্য।

সীতা রাণী জানান, রাঙ্গা লেফেন তৈরির নিজস্ব তাঁত বা যন্ত্র থাকলেও সুতার দাম বৃদ্ধির কারনে লেফেন তৈরি করেন না। ৫ হাত লম্বা একটি রাঙ্গা লেফেন বানাতে প্রায় ৭৫০ গ্রাম সুতার প্রয়োজন হয়। প্রতি কেজি সুতার দাম এখন ৬০০ টাকা। প্রতিটি লেফেন বানাতে সুতা বাবদ খরচ হয় ৪৫০ টাকা। তৈরি করতে সময় লাগে ৫/৬ দিন। এর বর্তমান বাজার দাম রয়েছে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা।

শ্রমের মজুরীতে না পুষালেও নিজের নাতনীর সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানে পরিধানের জন্য সীতা নিজ হাতেই তিনি তৈরি করছেন রাঙ্গা লেফেন। রাঙ্গা লেফেন এর তাঁত যন্ত্রের জন্য প্রয়োজন হয় কাঁঠ বা বাঁশের তৈরি কয়েকটি যন্ত্রাংশ। ক্ষুদ্র এ যন্ত্রাংশ গুলোর নাম হলো— গাড়ী, রাজ, দোহী, মাখু, বড়াই, ঠোঙ্গা, কন্ঠাছান্দা, থেরথেবা, নাটাই, খুঁটি ও চরকী। এর প্রধান কাঁচামাল হলো সুতা। সব মিলিয়ে কোচদের নিজস্ব তাঁতযন্ত্র বানাতে খরচ পড়ে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা।

তিনি আরো জানান, তার পুর্ব পুরুষগণের কাছ থেকে এই নিখুঁত ও সুন্দর রাঙ্গা লেফেন বানানো শিখেছেন। বর্তমান যুগের নারীর অনেকেই রাঙ্গা লেফেন বানাতে পারেন না। আবার অনেকেই ভুলে যাচ্ছেন। সুতার পর্যাপ্ত সরবরাহ ও দাম থাকলে অনেক পরিবারই নিজেরাই এই ঐতিহ্যের পোষাক তৈরি করতে পারত।

শ্রীমতি মায়াদেবী কোচ বলেন, আমাদের পোষাকের ঐতিহ্য রক্ষায় তাঁত শিল্পে স্থানীয় একটি বেসরকারী সংস্থা প্রশিক্ষণ দিলেও এখন আর খবর নেয় না। তিনি কোচদের এই ঐতিহ্যের পোষাক রক্ষার দাবী জানান।

নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খৃষ্টফার হিমেল রিছিল বলেন, ক্ষুদ্র নৃ—গোষ্ঠী কোচ স¤প্রদায়ের ঐতিহ্যের পোষাক রাঙ্গা লেফেন তৈরি শিল্পে সরকারীভাবে সুনিদ্রিষ্ট কোন বরাদ্ধ নেই। কোচ স¤প্রদায়ের ঐতিহ্য ও সংষ্কৃতি রক্ষায় উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *