অনৈতিক সুবিধা নিচ্ছে বিএসইসি ও ডিএসই!

অনৈতিক সুবিধা নিচ্ছে বিএসইসি ও ডিএসই!

অর্থনীতি স্লাইড

সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৩ ৯:৫৯ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজারের হোটেল রয়েল টিউলিপ সিপার্লের শেয়ার কারসাজির তদন্ত করছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। এই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেই সুবিধা নিচ্ছে বিএসইসি এবং ডিএসই। বিশেষ সুবিধায় আগামী ১৬ অক্টোবর হোটেলটিতে ব্যয়বহুল প্রোগ্রাম করতে যাচ্ছে ডিএসই। এখানে বিএসইসির সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। অথচ কারসাজির মাধ্যমে রয়েল টিউলিপের শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে বর্তমানে এ দুই প্রতিষ্ঠানই তদন্ত করছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, তদন্তাধীন কোম্পানির কাছ থেকে এ ধরনের সুবিধা গ্রহণ নিঃসন্দেহে অনৈতিক। এখানে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় জড়িত। তবে বিএসইসি বলছে, তারা কোনো ধরনের সুবিধা নেবে না। হোটেল বিলের পুরো টাকাই পরিশোধ করবে।

জানতে চাইলে শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ রোববার বলেন, রয়েল টিউলিপ সিপার্ল তালিকাভুক্ত কোম্পানি। আর বিএসইসি নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এরপর কোম্পানিটির বিরুদ্ধে একটা তদন্ত চলছে। সে সময় এই কোম্পানির কাছ থেকে আতিথেয়তা নিচ্ছে বিএসইসি এবং ডিএসই। এটি যৌক্তিক নয়। এটা নিয়ে কথা উঠবে। আর প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, বিএসইসি হয়তো বলবে, ‘আমরা টাকা পরিশোধ করছি।’ কোনো সুবিধা নিইনি। কিন্তু এরপরও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলে কথা। কর্তাব্যক্তিরা যাবেন কিন্তু বাড়তি সুবিধা বা আতিথেয়তা নেবেন না অথবা হোটেল কর্তৃপক্ষ দেবে না, এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। মানুষ এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। আবু আহমেদ বলেন, তবে প্রশ্ন উঠলে কী হবে। কার কী আসে যায়। ওনারা এগুলো পরোয়া করেন না। কারণ এই বাজারে কতকিছু হচ্ছে। কে পরোয়া করে? তিনি আরও বলেন, টাকা দিয়ে প্রোগ্রাম করলে কক্সবাজারে অন্য হোটেল আছে না? তদন্ত চলাকালীন ওখানে যেতে হবে কেন? আমাদের দুর্ভাগ্য। প্রসঙ্গত, শেয়ারবাজারে কারসাজির মাধ্যমে কক্সবাজারের পাঁচ তারকা হোটেল রয়েল টিউলিপ সিপার্লের শেয়ারের দাম সাড়ে ৭ মাসে সাড়ে ৭ গুণ বাড়ানো হয়। এখানে ইনসাইডার ট্রেডিং (কোম্পানির ভেতরের লোকজনের লেনদেনসহ) বড় দুটি গ্রুপ জড়িত। বড় একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়েছেন মো. লুৎফুল গনি টিটু নামের এক ব্যক্তির নেতৃত্বাধীন একটি চক্র। ৮টি ব্রোকারেজ হাউজ থেকে ৫০টি বিও অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে এসব কারসাজি করা হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে ২০ আগস্ট অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে একটি গণমাধ্যম। এরপর নড়েচড়ে বসে কমিশন। ওইদিনই ডিএসইকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। দুই দিন পর বিএসইসি নিজেই তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটিতে রয়েছেন মার্কেট সার্ভিলেন্স বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ওহিদুল ইসলাম, একই বিভাগের সহকারী পরিচালক সীমা রাজবংশী এবং ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে শেয়ার সংরক্ষণকারী কোম্পানি রাকিবুল ইসলাম চৌধুরী। কমিটিকে আগামী ৬০ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। সে হিসাবে আগামী ২৩ অক্টোবরের মধ্যে রিপোর্ট দিতে হবে। এর মধ্যে শেয়ারবাজারের সবাইকে নিয়ে ওই হোটেল বিলাসবহুল প্রোগ্রাম করছে ডিএসই এবং বিএসইসি।

জানা গেছে, আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর রয়েল টিউলিপ সিপার্লে ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট কনফারেন্স করবে ডিএসই। এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলোর সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং মিউচুয়াল ফান্ডের বিনিয়োগ বিষয়ে সময়সূচিতে ৪টি লেকচার রয়েছে। শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শতাধিক কর্মকর্তা সেখানে যোগ দেবেন। অংশগ্রহণকারীরা ১৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সেখানে পৌঁছবেন। প্রোগ্রামের প্রধান অতিথি বিএসইসির চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। এছাড়া বিএসইসির কমিশনার ড. মিজানুর রহমান, ডিএসইর চেয়ারম্যান হাফিজ মো. হাসান বাবু, ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, কমপ্লায়েন্স অফিসার, এসেট ম্যানেজার, ফান্ড ম্যানেজার, ট্রাস্টি, কাস্টডিয়ান, অডিটর, মিউচুয়াল ফান্ড এবং অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের প্রতিনিধিরা অংশ নিচ্ছেন। রেজিস্ট্রেশনের শেষ তারিখ ছিল ২৪ আগস্ট। কিন্তু এখনো রেজিস্ট্রেশন চলছে। এর নিবন্ধন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। রয়েল টিউলিপ নিজেই এ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট করছে। প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য নিবন্ধনের নম্বর দেওয়া হয়েছে সিপার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা লিমিটেড। অ্যাকাউন্ট নম্বর ৫১২১৩১০০০০০১৬৪। রাউটিং নম্বর ২৩৫২২০২৬৮, প্রিমিয়ার ব্যাংক, কক্সবাজার ব্রাঞ্চ। ১৬ তারিখ প্রোগ্রাম শেষ হলে একটি অংশ ওইদিনই চলে আসবেন। বেশকিছু কর্মকর্তা আরও দু-একদিন থাকবেন।

এদিকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কর্মচারী চাকরি বিধিমালা, ২০২১-এর ৩৬/২গ ধারায় উল্লেখ আছে, কমিশনের সহিত লেনদেন রহিয়াছে, কিংবা লেনদেন থাকিবার সম্ভাবনা রহিয়াছে এমন ব্যক্তিদের নিকট হইতে কোনো দান বা সহায়তা গ্রহণ করিবেন না।

জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম রোববার গণমাধ্যমকে বলেন, এই প্রোগ্রামে মিউচুয়াল ফান্ড এবং ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিনিধিরা থাকবেন। তাদের বিনিয়োগ ও তহবিল ব্যবস্থাপনা, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং অডিটরের কার্যক্রম নিয়ে একটি ধারণা দেওয়া হবে। তিনি বলেন, যেহেতু কক্সবাজারে প্রোগ্রাম, তাই ভালো হোটেল হিসাবে আমরা রয়েল টিউলিপকে পছন্দ করেছি। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনো ধরনের সুবিধা নেওয়া হয়নি। আমরা পুরো টাকা পরিশোধ করছি। অংশগ্রহণকারী ২৫ হাজার টাকা করে চাঁদা দেবে। বাকি টাকা ডিএসই এবং বিএসইসি পরিশোধ করবে। ইতোমধ্যে টাকা তাদের অ্যাকাউন্টে চলে গেছে। ফলে এখানে স্বার্থের (কনফ্লিক্ট অব ইনটারেস্ট) কোনো ব্যাপার নেই।

জানতে চাইলে ডিএসইর চেয়ারম্যান ড. হাফিজ মো. হাসান বাবু গণমাধ্যমকে বলেন, ১৬ তারিখে প্রোগ্রাম আছে জানি। আমারও এখন পর্যন্ত যাওয়ার শিডিউল আছে। তবে শেষ পর্যন্ত যেতে পারব কিনা বলতে পারছি না। তিনি বলেন, আমি সঠিকভাবে (অ্যাকজাক্টলি) জানি না কোথায় থাকা হবে, কীভাবে আয়োজন হয়েছে।

সূত্র জানায়, রয়েল টিউলিপ সিপার্লের শেয়ারে কারসাজির বিষয়টি অনেক আগেই ডিএসইর নজরে এসেছে। এ ব্যাপারে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই কমিশনকে রিপোর্ট দিয়েছিল ডিএসই। ওই সময়ে বেশ কয়েকটি ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের (উদ্যোক্তাদের বেআইনি শেয়ার লেনদেন) বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। এ সময়ে তাদের জরিমানা কিংবা অন্য কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে, চিঠি দিয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়। তবে এরপরও চক্রটি থামেনি। এখনো শেয়ারের দাম বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। তবে এ বিষয়ে রয়েল টিউলিপের কোম্পানি সেক্রেটারি মো. আজহারুল মামুনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে প্রতিবেদনের বিষয়টি লিখে জানানো হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *