কেএনএফ’র বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার ইঙ্গিত, অভিযান কি সহজ হবে

কেএনএফ’র বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার ইঙ্গিত, অভিযান কি সহজ হবে

দেশজুড়ে স্লাইড

এপ্রিল ৭, ২০২৪ ৯:৩২ পূর্বাহ্ণ

বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে ব্যাংকে হামলা ও ডাকাতির ঘটনায় সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ’র বিরুদ্ধে আরো কঠোর হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তবে ভেরিফায়েড নয় এমন একটি ফেসবুক পাতায় কেএনএফ তাদের প্রতিক্রিয়ায় বলেছে ‘সামরিক উপায়ে সমাধানের চেষ্টা রাষ্ট্রের উচিত হয়নি’।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান শনিবার রুমায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেছেন,নিরাপত্তা বাহিনী এখন যা করা দরকার সেটাই করবে। ব্যাংক ডাকাতিতে কারা জড়িত ও কারা সহযোগিতা করেছে তা বের করা হবে।

মঙ্গল ও বুধবারের ঘটনার পর থেকেই নিরাপত্তা বাহিনী অভিযানের কথা বলে আসছে। কিন্তু অপহৃত ব্যাংক কর্মকর্তাকে উদ্ধার করা গেলেও লুট হওয়া অস্ত্র গত তিনদিনেও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

এর আগে, বুধবার দুপুরে থানচির ঘটনার পর ঢাকায় এক প্রেস ব্রিফিংয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান রুমা ও থানচির ঘটনার জন্য কেএনএফকে দায়ী করেন। যদিও তখন কেএনএফ’র দিক থেকে এ নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি।

শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে কেএনএফ’র মিডিয়া ও ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি ফেসবুকে প্রকাশ করা হয়। যদিও এই ফেসবুক পেইজটি ভেরিফায়েড নয়, তবে কেএনএফের অনেক বক্তব্য ও বিবৃতি সেখানে নিয়মিতভাবে প্রকাশ করা হয়।

ঐ বিবৃতিতে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ বান্দরবানে শান্তি আলোচনার শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে সরকারের বিরুদ্ধে। তবে এই ফেসবুক পেইজ এবং তাতে কেএনএফ’র বিবৃতি সম্পর্কে কোনো নিরপেক্ষ সূত্র থেকে সত্যতা যাচাই করা যায়নি।

তবে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির মুখপাত্র কাঞ্চন জয় তঞ্চঙ্গ্যা বলেছেন, আলোচনার শর্ত লঙ্ঘনের মতো কিছুই ঘটেনি। তিনি বলেছেন, শান্তি বৈঠকে যেসব আলোচনা হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সময় দেয়নি কেএনএফে।

প্রসঙ্গত, র‍্যাব শুক্রবারই জানিয়েছে কেএনএফ’র বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ সমন্বিত সাঁড়াশি অভিযান শুরু করবে। এর আগে ২০২২ সালের শেষ দিকে পাহাড় এলাকায় কেএনএফ এর বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান চালিয়েছিলো র‍্যাব।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শামীম কামাল বলছেন, তার মনে হচ্ছে অনেক দিন প্রস্তুতি নিয়েই গেরিলা হামলা শুরু করেছে কেএনএফ এবং সে কারণেই এ ধরনের হামলা অব্যাহত রাখার চেষ্টা হতে পারে।

তিনি বলেন, পাহাড়ে অভিযান চালানো খুব একটা সহজ নয়। অভিযানে সফলতা কতটা আসবে তা নিয়েও সংশয় আছে কারণ কেএনএফ হিট অ্যান্ড রান কৌশল নিয়েছে। আবার হুট করে তাদের সাথে শান্তি আলোচনাও বাতিল করা ঠিক হয়নি। সবমিলিয়ে অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি করা হলো, যার সমাধান কঠিন।

রুমায় গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বললেন

রুমা উপজেলা কমপ্লেক্সে সোনালী ব্যাংক ও পুলিশের থাকার জায়গা পরিদর্শনের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, পাহাড় আবার অশান্তি হবে এটা তারা চিন্তা করেননি। ঘটনাটি কারা করেছে এবং কাদের সহযোগিতা ছিলো সবগুলোই তারা বের করবেন।

তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত যা মনে করছি অস্ত্র ও পোশাক সহকারে এখানে ঢুকবে আর আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী বসে থাকবে এটাও কাম্য নয়। যা করার নিরাপত্তা বাহিনী এখন সেটাই করবে। আমরা কঠোর অবস্থানে যাবো। কোন ভাবেই আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গ করতে দিবো না। এখানে অশান্তি হোক সেটা আমরা চাই না। কোনো বিষয়কে আনচ্যালেঞ্জড যেতে দেবো না। কারো গাফিলতি আছে কি না সব দেখবো।

শান্তি আলোচনার শর্ত ভঙ্গের অভিযোগ

২০২২ সালে পাহাড়ে কেএনএফ ও জঙ্গি বিরোধী অভিযানের সময় র‍্যাব বলেছিলো যে পাহাড়ি এলাকার ৬টি নৃ-গোষ্ঠীকে নিয়ে কেএনএফ গড়ে উঠেছে। তখন কেএনএফ’র ১৭ জন সদস্য ও নেতাকে আটকের তথ্য দিয়ে র‍্যাব তাদের কাছ থেকে অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধারেরও দাবি করেছিল। এরপর গত বছরের জুলাই মাসে কেএনএফ’র সঙ্গে শান্তি আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং নভেম্বরে বান্দরবান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সাথে সরাসরি আলোচনায় অংশ নেয় কেএনএফ’র একটি দল।

শনিবার সন্ধ্যায় কেএনএফ তাদের আনভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে আলোচনার শর্ত লঙ্ঘনের যে অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে তুলেছে তাতে এটা পরিষ্কার যে, কমিটির সঙ্গে বৈঠকে কেএনএফ কয়েকটি শর্ত দিয়েছিল এবং সরকার পক্ষ তা মেনে নেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বিশেষ করে কেএনএফ’র যাদের আটক করা হয়েছিল তাদের ‘৫ মাসেও মুক্তি দেওয়া হয়নি বলে’ বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে কেএনএফ। অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ তুলে গেরিলা হামলার পথ বেছে নিয়েছে কেএনএফ।

তবে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির মুখপাত্র কাঞ্চন জয় তঞ্চঙ্গ্যা বলছেন, আলোচনার শর্ত লঙ্ঘনের মতো কিছুই ঘটেনি বরং আলোচনার সময় তাদের সাথে যেসব বিষয়ে সমঝোতা হয়েছিলো সেগুলো ইতিবাচক ভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিলো। চুক্তি লঙ্ঘনের প্রশ্ন ওঠে না। তারা যা বলেছিল সেগুলো পর্যালোচনা করে কাজ হচ্ছিল। কোনো কোনো বিষয় চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। এরপরও আপত্তি থাকলে তারা তো জানাতে পারতো যে কোনটা লঙ্ঘন হচ্ছে বা কোনটা করা হচ্ছে না। সেসব কিছু না বলে হামলা, ডাকাতি, লুট বা অপহরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

কমিটির সদস্য মনিরুল ইসলাম বলছেন, সরকারের কাছে দাবিগুলো পাঠালে তারা সেগুলো পূরণের উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে দুজনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং আরো কয়েকজনের মুক্তি প্রক্রিয়াধীন। আর দ্বিতীয় সংলাপে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছিল যে, আগামী সংলাপের আগে কেএনএফ কারাগারে আটকদের সঠিক তালিকা দিবে। এছাড়া কোনো বিষয় নিয়ে প্রশ্ন থাকলে ২২ এপ্রিল তৃতীয় সংলাপে সেগুলো নিয়ে আলোচনা হবে। মাত্র ৫ মাসের মধ্যেই সব দাবি দাওয়া পূরণ হয়ে যাবে- এ রকম আশা করাটাও কি ঠিক হবে?

স্থানীয় সিভিল সোসাইটি ও জেলা পরিষদের উদ্যোগে গঠিত এই শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সঙ্গেই দুই দফা সরাসরি বৈঠক করেছিল কেএন এফ। আলোচনার সময় এ কমিটিতে সরকারের প্রতিনিধিও ছিলেন।

শুক্রবার বান্দরবানে এক সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেছেন, গত কয়েক দিনে ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনার দুটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। প্রথমত, টাকা লুটপাট ও অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়া এবং দ্বিতীয়ত নিজেদের সক্ষমতা প্রদর্শন করা। কিন্তু প্রশ্ন হলো শান্তি আলোচনা চলাকালে কেএনএফ রুমা ও থানচিতে হামলা করলো কেন?

নিরাপত্তা বিশ্লেষক শামীম কামাল বলছেন কেএনএফ’র জন্মই হয়েছে এক প্রগাঢ় হতাশা থেকে এবং সেই হতাশা এসেছে তীব্র বঞ্চনা থেকে। গেরিলা ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এ ধরনের পরিস্থিতিতে অভিযান চালিয়ে একটি গোষ্ঠীকে ধ্বংস করা গেলে দেখা যায় আরেকটি নতুন গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। এজন্যই মূল সংকটের দিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত।

প্রসঙ্গত, পাহাড়ে শান্তি আনতে ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে জনসংহতি সমিতির সাথে চুক্তি করেছিল সরকার, যা শান্তি চুক্তি নামেই পরিচিত। কেএনএফ’র প্রধান হিসেবে কর্তৃপক্ষ যার নাম বলছে সেই নাথান বম একসময় জনসংহতি সমিতির সঙ্গে সম্পৃক্ত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে জনসংহতি সমিতি ভেঙ্গে যায় ও ইউপিডিএফ নাম সংগঠন তৈরি হয়। সেটিও এখন আবার কয়েকভাবে বিভক্ত। এসব সংগঠনেরই বড় অভিযোগ সরকার শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন করছে না। বিশেষ করে পাহাড়িদের ভূমির অধিকার প্রশ্নে সরকার যত্নবান নয় বলে তাদের দাবি।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শামীম কামাল বলছেন, শান্তি চুক্তি হওয়ার পর ২৭ হাজারের মতো মামলা হয়েছে ভূমি নিয়ে, যার একটিরও নিষ্পত্তি হয়নি। শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়াই আজকের এমন পরিস্থিতির মূল কারণ, এদিকে মনোযোগ দিতেই হবে। তা না করে এসব অভিযানে টেকসই কিছু অর্জন হবে না। কারণ ক্ষোভ থেকেই যাবে। আজ এ সংগঠন আছে, কাল অন্য সংগঠন তৈরি হবে।

অভিযান কি সহজ হবে?

শামীম কামালের ধারণা, ২-৩ বছর ধরে প্রস্তুতি নেয়ার পর এখন গেরিলা হামলা শুরু করেছে বমদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা কেএনএফ, যারা পাহাড়ের ৯টি উপজেলাকে নিয়ে একটি স্বায়ত্তশাসিত এলাকা চাইছে।

মিয়ানমারের চিন প্রদেশে ও ভারতের মিজোরামেও তাদের লোক আছে। কিন্তু ২০২২ সালে ব্যাপক অভিযানের মুখে পড়ে মিজোরামে গিয়ে কেএনএফ’র লোকজন সুবিধা করতে পারেনি বলে মনে করে ঐ অঞ্চলের পুলিশ-প্রশাসন।

আবার পার্বত্য এলাকায় সেনাবাহিনীর যে পাঁচশর মতো ক্যাম্প ছিলো সেখান থেকে পরিস্থিতি ভালো হওয়ায় ১৩০টির মতো ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নিয়েছে সরকার। সেখানে আবার পরে এপিবিএন যাওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সেটি হয়নি।

ফলে কিছু এলাকায় ক্যাম্প প্রত্যাহারের পর কার্যত নিরাপত্তা বাহিনীর কোন উপস্থিতিই নেই। অনেকে মনে করেন কেএনএফ’র মতো পাহাড়ের কিছু সংগঠন এসব এলাকার সুবিধা নিচ্ছে।

শামীম কামাল বলছেন, নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থান এখন যেখানে কম, সেগুলো ঝুঁকিতে পড়েছে এবং সবমিলিয়ে অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি হয়েছে। এখন যা পরিস্থিতি তাতে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করাই তো কঠিন মনে হচ্ছে। পাহাড়ে অভিযানের জন্য সেনাবাহিনী লাগবেই। কোনো কোনো জায়গায় এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যেতে ১০-১২ ঘণ্টা সময় লাগে।

তিনি বলেন, কেএনএফ তাদের বিবৃতিতে দিয়েছে গেরিলা হামলা অব্যাহত রাখার ইঙ্গিত। বাংলাদেশের ওপাড়ে মিয়ানমারের চীন প্রদেশের চীন ন্যাশনাল আর্মি থেকেও কেএনএফ’র সহযোগিতা পাওয়ার আশঙ্কা আছে। এসব কিছু বিবেচনা করলে সাঁড়াশি কোনো অভিযান পরিচালনা করলেও তা খুব একটা সহজ হবে না।

সূত্র: বিবিসি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *