‘রিয়া’ বা লোক দেখানো ইবাদত

‘রিয়া’ বা লোক দেখানো ইবাদত

ধর্ম স্পেশাল

এপ্রিল ২৮, ২০২৩ ১১:৫৬ পূর্বাহ্ণ

মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তার প্রিয় হাবিব রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি বলুন: নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার কোরবানি এবং আমার জীবন ও মৃত্যু- বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য’। (সূরা: আল-আনআম, আয়াত: ১৬২)

‘আপনি বলুন: আমিও তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমার কাছে ‘ওহি’ (প্রত্যাদেশ) করা হয় যে, তোমাদের ইলাহ হচ্ছেন ‘একমাত্র’ ইলাহ। অতএব, যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন নেক আমল করে এবং তার পালনকর্তার ইবাদতে কাউকে শরীক না করে’। (সূরা: আল-কাহফ, আয়াত: ১১০)

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমি তোমাদের ব্যাপারে ছোট শিরক থেকে খুব ভয় করছি। সাহাবিরা বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! ছোট শিরক কি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তা হলো ‘রিয়া’ বা লোক দেখানো ইবাদত’।

যেদিন আল্লাহ তাআলা বান্দাদের আমলের পুরস্কার প্রদান করবেন, সেদিন রিয়াকারীদেরকে বলবেন, ‘যাও, দুনিয়াতে যাদেরকে দেখানোর জন্য আমল করতে, তাদের কাছে যাও। দেখো তাদের কাছ থেকে কোনো পুরস্কার পাও কিনা’? (মুসনাদে আহমাদ, সহিহ ইবনে খুজায়মা, হাদিসটি সহিহ- শায়খ আলবানী)

কোনো কিছু করার ইচ্ছাকে ইসলামে ‘নিয়ত’ বলা হয়। নিয়ত ভালো ও খারাপ, দুটোই হতে পারে। কোনো ব্যক্তি যখন শুধুমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু তাআলার উদ্দেশ্যে কোনো ইবাদত করে সেটাকে ‘ইখলাস’ বলা হয়।

আর কেউ যখন লোক দেখানো বা অন্য কোনো উদ্দেশ্য  হাসিলের জন্য ‘ইবাদত’ করে, যেমন- দুনিয়াবী কোনো স্বার্থ হাসিল করা, টাকা পয়সা পাওয়া, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে খুশি করা, মানুষ ধার্মিক বলুক বা প্রশংসা করুক, এমন খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো ইবাদত করলে সেটাকে ‘রিয়া’ বলা হয়। সহজ ভাষায়- রিয়া হচ্ছে লোক দেখানো ইবাদত করা।

নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, ইসলাম বিষয়ক কিতাব লেখা, ব্লগে ইসলামিক আর্টিকেল লেখা- যেকোনো ইবাদত আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি বা উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে করলে সেটা আল্লাহ তাআলা কস্মিনকালেও কবুল করবেন না। বরং, এইরকম লোক দেখানো বা অন্যকে খুশি করার জন্য ইবাদত করার কারণে এটা- ‘শিরক’ এবং এর পর সে যদি তাওবা না করে তাহলে তাকে আল্লাহ কঠোর শাস্তি দেবেন।

ইখলাস না থাকলে তার পরিণতি কি হবে সেটা আল্লাহ পাক কোরআনুল কারিমে উল্লেখ করেছেন, ‘(আমি ছাড়া অন্যের সন্তুষ্টির জন্য) তারা যেসব আমল করবে, আমি তাদের কৃতকর্মের প্রতি মনোনিবেশ করব, অতঃপর সেইগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করে দেব’। (সূরা: আল-ফুরকান, আয়াত: ২৩)

কেয়ামতের দিন ‘রিয়াকারী’ বা লোক দেখানো আমলকারীর বিচার সবার প্রথম হবে। যেমন-

(১) কেয়ামতের দিন প্রথমে যেসব লোকের বিচার করা হবে তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে ‘শহিদ’ ব্যক্তি। তাকে উপস্থিত করে আল্লাহ তার নেয়ামতসমূহ স্মরণ করিয়ে দেবেন। সে তা স্বীকার করবে। অতঃপর, আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন আমার দেওয়া নেয়ামতের বিনিময়ে তুমি কি আমল করেছ? উত্তরে সে বলবেঃ আমি আপনার দেওয়া নেয়ামতের বিনিময়ে আপনার রাস্তায় জিহাদ করে শহিদ হয়েছি। আল্লাহ বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলছে; বরং তুমি এই উদ্দেশ্যে জিহাদ করে শহিদ হয়েছিলে যাতে করে লোকেরা তোমাকে শহিদ বলে আখ্যায়িত করে। পৃথিবীতে তা বলা হয়ে গেছে। অতঃপর তাকে মুখের উপর উপুড় করে টেনে হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

(২) অতঃপর, এমন একজন ‘আলেমকে’ উপস্থিত করা হবে যে দ্বীনি ইলম অর্জন করেছে এবং মানুষকে তা শিক্ষা দিয়েছে এবং কোরআন পাঠ করেছে। অতঃপর তাকে আল্লাহর নেয়ামতসমূহ স্মরণ করানো হবে। সেও তা স্বীকার করবে। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেনঃ আমার দেওয়া নেয়ামতের বিনিময়ে তুমি কি আমল করেছ? সে বলবেঃ আমি আপনার দেওয়া নেয়ামতের বিনিময়ে দ্বীনি ইলম অর্জন করেছি, অন্যকে তা শিক্ষা দিয়েছি এবং আপনার জন্যে কোরআন পাঠ করেছি। আল্লাহ বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলছো; বরং তুমি এই জন্যে বিদ্যা শিক্ষা করেছিলে যাতে করে মানুষ তোমাকে আলেম বলে। আর এই জন্যে কোরআন পাঠ করেছিলে যাতে লোকেরা তোমাকে কারী বলে। পৃথিবীতে তোমাকে এই সব বলা হয়ে গেছে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপের আদেশ দেওয়া হবে। অতঃপর নাক ও মুখের উপর উপুড় করে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

(৩) এরপর ঐ ব্যক্তিকে আনা হবে যাকে আল্লাহ নানারকম ধন-সম্পদ দান করেছিলেন। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন, আমার দেওয়া নেয়ামতের বিনিময়ে তুমি কি আমল করেছ? সে বলবেঃ আপনি যেসমস্ত পথে খরচ করা পছন্দ করেন তার কোনো পথই আমি বাদ দেইনি, সব পথেই খরচ করেছি। আল্লাহ বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলছো; বরং তুমি এই জন্য খরচ করেছো যাতে করে মানুষ তোমাকে ‘দানশীল’ বলে। পৃথিবীতে তোমাকে তা বলা হয়ে গেছে। অতঃপর তাকে মুখ ও নাকের উপর উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপের আদেশ দেওয়া হবে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সহিহ মুসলিম: কিতাবুল ইমারাহ)

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামাতের দিন যখন আল্লাহ তাআলা তার সত্ত্বার কিয়দংশ উন্মোচিত করবেন, তখন ঈমানদার নারী-পুরুষরা সবাই তার সম্মুখে সিজদায় পড়ে যাবে। তবে সিজদা থেকে বিরত থাকবে কেবল ঐ সমস্ত লোক, যারা দুনিয়াতে মানুষকে দেখানোর জন্য ও প্রশংসা পাওয়ার জন্য সিজদা (সালাত আদায়) করতো। তারা সিজদা করতে চাইবে বটে, কিন্তু তাদের পিঠ ও কোমর কাঠের তক্তার মতো শক্ত হয়ে যাবে’। (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত: ৫৩০৮)

ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যেকোনো শিরক থেকে বাঁচার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) এর শেখানো একটা গুরুত্বপূর্ণ দোয়া- ‘হে আল্লাহ! আমার জানা অবস্থায় তোমার সঙ্গে শিরক করা থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আর আমার অজানা অবস্থায় কোনো শিরক হয়ে গেলে ক্ষমা প্রার্থনা করছি’। (আহমাদ ৪/৪০৩, হাদিসটি সহিহ, সহিহ আল-জামে ৩/২৩৩; হিসনুল মুসলিম: পৃষ্ঠা ২৪৬)

হে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা! আমাদেরকে দুনিয়ার মোহমায়া, নৈতিক লৌকিকতা ও প্রতারণা এবং মিথ্যার শৈল্পিক শিরক থেকে রক্ষা করুন। আমিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *