সাগরের নীল জলের অতলে বিচরণ করে নানা জাতের মাছ। অজস্র জলজ প্রাণী। খাবারের খোঁজে উত্তাল তরঙ্গের ওপর দিনভর উড়াউড়ি করে নানা জাতের পাখি। কখনো সাঁতারও কাটে পানিতে। এরমধ্যে অদ্ভুত হলো উড়ুক্কু মাছ। পানিতে সাঁতার কাটতে কাটতেই এরা দ্রুত গতিতে ভেসে ওঠে। তারপর পানির উপরে অনেকটা পথ দিব্যি পাখির মতো উড়ে যায়।
ডলফিন, স্কুইড ও বড় মাছের তাড়া খেয়ে পালিয়ে বাঁচার জন্য অতি দ্রুত সাঁতার কাটতে গিয়ে এ মাছ পানির একেবারে উপরিভাগে চলে আসে এবং পাখনা মেলে বাতাসে উড়াল দেয়। উড়াল দেয় বললে আসলে ভুল হবে। প্রকৃত ওড়া বলতে যেটা বোঝায় এটা ঠিক সেরকম ওড়া নয়। একে বলে গ্লাইডিং। এরা মূলত পানি থেকে লাফ দিয়ে তাদের পাখনার সাহায্যে বাতাসে ভেসে চলে।
বিশ্বজুড়ে ৭১ প্রজাতির উড়ুক্কু মাছের সন্ধান পাওয়া গেছে। এদের বক্ষ পাখনা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে শ্রোণী পাখনাও প্রসারিত হয়ে ডানার মতন গঠন তৈরি করে।
এই মাছের অধিকাংশই সামুদ্রিক এবং সাধারণত ঝাঁক বেঁধে চলে। অতি দ্রুত সাঁতার কাটতে গিয়ে এরা অনেক সময়ে পানির একেবারে উপরিভাগে চলে আসে এবং পাখনা মেলে বাতাসে উড়াল দেয়। বাতাসের গতি বা ঢেউয়ের অবস্থার উপর নির্ভর করে এরা ৩০ সেকেন্ড অবধি বাতাসে ভেসে থাকতে পারে।
সুগঠিত পাখনা বিশিষ্ট এসব মাছের কোনো কোনোটি পানির উপরিভাগ থেকে ১০ মিটার উচ্চতায় প্রায় ৪০০ মিটার দূরত্ব অবধি চলতে পারে। এই কারণে অনেক সময় এই মাছ আচমকা সমুদ্রগামী জাহাজের ডেকের উপর আছড়ে পড়ে। উষ্ণমন্ডলের সব সাগরেই এই মাছ দেখা যায়। এদের দৈর্ঘ্য ১০ থেকে ৩০ সেমি অবধি হতে পারে। এরা মূলত শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই বাতাসে উড়াল দিয়ে থাকে।
গবেষকদের ধারণা, আকাশে পাখি ওড়ার আট কোটি বছর আগে থেকেই উড়ুক্কু মাছের রাজত্ব। ডাইনোসরের আগে থেকেই এ মাছের অস্তিত্ব ছিল। এখনো রয়েছে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সাগরে। উড়ুক্কু মাছ বলতে কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট প্রজাতির মাছকে বোঝায় না।
ওড়ার জন্য উড়ুক্কু মাছের কোনো ডানা নেই। আছে চ্যাটাল, ঢাউস, ফাঁপা বক্ষপাখনা। পাখনার ভেতরে হাওয়া ভরা থাকায় ওজনেও হালকা। এই বক্ষপাখনার সাহায্যেই বাতাসে ভেসে থাকতে পারে।
যদিও এই ওড়াউড়ি কিন্তু প্রকৃত উড্ডয়ন নয়। একে বলে গ্লাইডিং। আরও সহজ করে বললে, বাতাসে ভেসে থাকা। পানি ছেড়ে হাওয়ায় ভাসার পেছনে রয়েছে দুটি উদ্দেশ্য। প্রথমটা হলো, প্ল্যাঙ্কটন জাতীয় খাবার খেতে পানির ওপরে উঠতেই হয়। দ্বিতীয়টা হলো আত্মরক্ষা। বড় মাছের তাড়া খেয়ে পালিয়ে বাঁচার জন্য পানি ছেড়ে হাওয়ায় উঠে কোনোমতে পালিয়ে বাঁচে তারা।
পানির নিচে গড়পড়তা উড়ুক্কু মাছের বেগ হয় ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটারের কাছাঁকাছি। তবে পানির বাইরে তাদের গতিবিধি অবাক করার মতো। পানির ওপরে ৩১২ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত এসব মাছ দিব্যি ভেসে বেড়াতে পারে!
রঙ-বেরঙের আলোর প্রতি উড়ুক্কু মাছের রয়েছে মারাত্মক দুর্বলতা। এই আলোর নেশাকে কাজে লাগায় মাছ শিকারিরা। নজরকাড়া নানা রকম আলো দেখাতে দেখাতে সুকৌশলে ছড়ানো জালের মধ্যে আটকে ফেলে। তখন সাঁতার হোক বা ওড়া, কোনোকিছুই তাদের বাঁচাতে পারে না।
উড়ুক্কু মাছ খেতে সুস্বাদু। বাণিজ্যিকভাবে জাপান, ভিয়েতনাম, বার্বাডোজ ও ভারতে এ মাছ প্রচুর ধরা হয়। বিপুল পরিমাণ উড়ুক্কু মাছের কারণে ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্র বার্বাডোজের নামই ছিল ‘উড়ুক্কু মাছের ভূমি’। এই উড়ুক্কু মাছ সে দেশের জাতীয় মাছও বটে।