নভেম্বর ৮, ২০২২ ৯:৩৬ পূর্বাহ্ণ
বাংলাদেশ ক্রিকেটে মোস্তাফিজুর রহমানের আগমনটা হয়েছিল ধুমকেতুর মতো। কাটার নামক এক অদ্ভূত অ্যাকশনে প্রতিপক্ষকে ইচ্ছেমতো ঘায়েল করে চারদিকে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন তিনি। তার বোলিংয়ের সামনে রীতিমতো খাবি খেয়েছে বিশ্বের বাঘা বাঘা সব ব্যাটাররা। মোস্তাফিজের ডাকনামই হয়ে গিয়েছিল ‘কাটার মাস্টার’।
আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে বর্তমান সময়টা এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। ক্রীড়াঙ্গনেও সমানতালে চলছে প্রযুক্তির ব্যবহার। তারই ধারায় মোস্তাফিজের বোলিং নিয়েও চুলচেরা বিশ্লেষণ করা শুরু করল প্রতিপক্ষ। তাতেও তাকে ঠিক দমানো যাচ্ছিল না। এমন সময় দুঃস্বপ্ন হয়ে এলো ইনজুরি। করতে হলো সার্জারি।
সার্জারির পরই নিজের ন্যাচারাল বোলিং অ্যাকশনটা হারিয়ে ফেলেন ফিজ। সেই সঙ্গে ব্যাটারদের কাছে রীতিমতো সুঃসাধ্য মোস্তাফিজ হয়ে ওঠেন বেশ সহজবোধ্য। কাটারে জং ধরলো, বিরুদ্ধ কন্ডিশনেও নিজেকে হারিয়ে খুঁজতে লাগলেন এই বাহাতি। চারদিকে রব উঠল মোস্তাফিজ শেষ। কেউ কেউ তো বলেই ফেলল, ‘মোস্তাফিজ নেভার কামিং ব্যাক’।
তবে সব কিছুকে পেছনে ফেলে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অনুষ্ঠিত টি-২০ বিশ্বকাপের অষ্টম আসরে নিজেকে নতুনরূপে হাজির করেছেন মোস্তাফিজ। আসরে আগে তাকে নিয়ে সমর্থকদের যত হতাশা, রাগ, আক্ষেপ ছিল; সব ধুয়ে মুছে দিয়েছেন পারফর্ম্যান্সের জোরে। নতুন এক মোস্তাফিজকে দেখলো সমর্থকরা।
পুরো আসরে বাংলাদেশের প্রাপ্তি বলতে বোলিং বিভাগে ভালো করা। শুরুতে তাসকিন আহমেদ প্রতিপক্ষের উইকেট তুলে নিয়ে চাপ ক্রিয়েট করার পর ধারাটা ধরে রেখে বোলিং করে গেছেন মোস্তাফিজ। উইকেট তেমন না পেলেও স্বভাবজাত বোলিংয়ে রান আটকে রেখেছেন তিনি। এক ম্যাচে তো তার বলে কোনো বাউন্ডারি হাঁকাতে পারেনি প্রতিপক্ষ দল।
মোস্তাফিজের এমন উত্থানের পেছনে কাজ করেছে তার বোলিং অ্যাকশন পরিবর্তন। ইনজুরির পর নিজের স্বাভাবিক অ্যাকশনটা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছিলেন ফিজ। বিশ্বকাপের আগে তাকে আগের অ্যাকশনে ফিরিয়ে আনতে কাজ করেন দলের ব্যাটিং পরামর্শক কোচ শ্রীধরন শ্রীরাম। তাকে সহায়তা করেন দলের ভিডিও অ্যানালিস্ট শ্রীনিবাস চন্দ্রশেখরন।
মুস্তাফিজ শুরুতে বোলিং করার সময়ে তার ফলো থ্রু আসতো মাথার ওপর থেকে। কাটার-স্লোয়ার ডেলিভারিগুলো নিখুঁত করতে পারতেন তখন। এ দুই ধরনের ডেলিভারি দিয়েই ব্যাটারদের বিট করতে পারতেন। অথচ গত তিন বছরে সাইড থেকে বল ছুঁড়তেন মোস্তাফিজ। কাঁধের বাইরে থেকে বল ছাড়ার কারণে জায়গামতো পিচ করতো না।
শ্রীরামের তত্ত্বাবধানে এই সমস্যা থেকে মোস্তাফিজকে সমাধানের পথ বাতলে দেন বোলিং কোচ অ্যালান ডোনাল্ড। তার অধীনে নিজের চেনা অ্যাকশনে ফেরেন ফিজ। সদ্য সমাপ্ত বিশ্বকাপে তার প্রতিফলন দেখান। তাসকিনের সঙ্গে জুটি বেঁধে দুর্দান্ত বোলিং করেন।
মোস্তাফিজের অফফর্ম প্রসঙ্গে পেসার তাসকিন আহমেদকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছেন, ‘একজন ক্রিকেটারের খারাপ সময় যেতেই পারে। আমি যা দেখছি, মোস্তাফিজ ভালো বোলিং করছে। ও অনেক কঠোর পরিশ্রম করছে। প্রক্রিয়াটা খুব ভালোভাবেই মেনে চলছে। দ্রুতই দেখবেন যে সে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।’
তাসকিনের কথা ভুল ছিল না। কুড়ি ওভারের সদ্যসমাপ্ত আসরে মোস্তাফিজুর রহমানের বোলিং পারফর্ম্যান্স ছিল বেশ ভালো। ৫ ম্যাচে মোট ২০ ওভার বোলিং করেছেন ফিজ। তাতে মাত্র তিন উইকেট পেলেও রান খরচ করেছেন মাত্র ১১২! ইকোনমি মাত্র ৫.৬০। ১২০ বলের মধ্যে ডট বল করেছেন ৪৯টি।
মজার ব্যাপার হলো, জিম্বাবুয়ে ও পাকিস্তানের বিপক্ষে কোন বাউন্ডারি হজম করেননি ফিজ। সুপার টুয়েলভে সবকয়টি ম্যাচ খেলা বোলারদের মধ্যে তৃতীয় সেরা ইকোনমি রেট মোস্তাফিজুর রহমানের। বাকি দুজন হলেন অ্যানরিক নরকিয়া (৫.৩৭) ও ভুবনেশ্বর কুমার (৫.৪০)। এরা আবার ৫ ম্যাচে নিজেদের বোলিং কোটা পূর্ণ করেননি!
চলতি বছরে ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সফরে আসছে ভারত। এই সিরিজ দিয়েই মোস্তাফিজের আরেকবার নিজেকে চেনানোর পালা। এই ভারতের বিপক্ষেই তো ঝলসে ওঠা উল্কার মতো বিশ্ব ক্রিকেটে তার উত্থান। আরেকবার সেই ভারতকে সামনে পেয়ে নিশ্চয়ই জ্বলে উঠবেন ফিজ। পুরনো অ্যাকশনে নতুন মোস্তাফিজ আবার ফিরুক।