একনজরে পেলের জীবন

একনজরে পেলের জীবন

খেলা

ডিসেম্বর ৩০, ২০২২ ৯:২১ পূর্বাহ্ণ

কথিত আছে, ব্রাজিলের ছেলেরা নাকি জন্মের পরই প্রথম উপহার হিসেবে পায় একটি ফুটবল। অনেকের সারা জীবন সেই গোলাকার চামড়ার বস্তুটিকে নিয়েই কেটে যায়। অনেকে আবার বড় হওয়ার পর আগ্রহ খুঁজে পায় অন্য কিছুতে।

পেলের জীবনও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর ব্রাজিলের মিনাস জেরাইসে জন্ম। বাবা ছিলেন ব্রাজিলের ক্লাব ফ্লুমিনেন্সের ফুটবলার ডোনডিনহো। ইলেকট্রিক বাল্বের আবিষ্কারক টমাস আলভা এডিসনের নামানুসারে ছেলের নাম রাখেন।

তবে ‘এডিসন’ বদলে নাম দেন ‘এডসন’। এডসন আরান্তেস দি নাসিমেন্তো। ডাকনাম দেওয়া হয় ‘ডিকো’।

বাবা ফুটবলার হলেও পেলের ছোটবেলা কেটেছে চরম দারিদ্রের মধ্যে। তখনকার দিনে ফুটবলাররা সে রকম বেতন পেতেন না। ফলে সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট রোজগার করা তার বাবার পক্ষে সম্ভব ছিল না। বাবার দেখাদেখি ফুটবলের প্রতি ছোট থেকেই ঝোঁক।

পেলের পড়াশোনা বিশেষ এগোয়নি। চায়ের দোকানে কাজ করে হাতখরচ জোগাড় করতেন। বাকি যে সময় পেতেন, রাস্তাতেই ফুটবল খেলা চলত। তবে চামড়ার ফুটবল দিয়ে নয়, এ ‘ফুটবল’ অন্য রকম। মোজার ভিতরে কাগজ পুরে তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে সেটা নিয়েই লাথালাথি…

বয়স কিছুটা বাড়ার পর আসল ফুটবলে লাথি মারার সুযোগ পেয়েছিলেন পেলে। স্থানীয় বাউরু এলাকার বিভিন্ন অপেশাদার লিগে খ্যাপ খেলেছেন ছোটবেলায়। গোল করা এবং বল ড্রিবলিং করার ক্ষমতা যেন ঈশ্বরপ্রদত্ত।

পেলের ছোটবেলায় ব্রাজিলে ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছিল ‘ফুটসাল’ (ইনডোর ফুটবল)। ছোটবেলায় চুটিয়ে সেই খেলাই খেলেছেন পেলে। বড় হয়ে স্বীকার করেছেন, ছোট জায়গায় কাটানোর ক্ষমতা এবং দুরূহ কোণ থেকে গোল করার পিছনে ছিল ছোটবেলায় ‘ফুটসাল’ খেলা।

সেখান থেকেই ওয়ালদেমার দে ব্রিটোর নজরে পড়ে যান। ব্রিটোই তাকে নিয়ে যান ব্রাজিলের ঐতিহ্যশালী ক্লাব সান্তোসে। পেলেকে নিয়ে ব্রিটো এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, সান্তোসের কর্তাদের সরাসরি বলে দেন, ‘এই ছেলে একদিন বিশ্বের সেরা ফুটবলার হবে’।

সান্তোসের কোচ লুলাও পেলের খেলা দেখে মুগ্ধ হন। ১৯৫৬-র জুনে প্রথম পেশাদার চুক্তি সই করেন পেলে। পরের মৌসুমেই প্রথম দলে খেলার সুযোগ পান এবং লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। তত দিনে ব্রাজিলে হইচই পড়ে গেছে তাকে নিয়ে। পেশাদার ক্লাবে সই করার ১০ মাসের মধ্যে সুযোগ পান জাতীয় দলে।

১৯৫৮-র বিশ্বকাপের শুরুটা খুব একটা ভাল হয়নি পেলের। হাঁটুর চোট নিয়েই তিনি সুইডেনে খেলতে এসেছিলেন। প্রথম ম্যাচ খেলেন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। সেই ম্যাচে একটি ‘অ্যাসিস্ট’ও করেন।

সেই সময় সবচেয়ে কম বয়সে বিশ্বকাপে খেলার নজির গড়েন পেলে। সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করেন। সেটাও সবচেয়ে কম বয়সে। ফাইনালে সুইডেনের বিরুদ্ধে জোড়া গোল পেলেকে ব্রাজিলের অন্যতম সেরা ফুটবলারের আসনে প্রতিষ্ঠিত করে।

১৯৬২ বিশ্বকাপে পেলে গিয়েছিলেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার হিসেবে। ততদিনে দলে গারিঞ্চা, গিলমারের মতো তারকা ফুটবলারও চলে এসেছেন। তবে চেকোশ্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে দূরপাল্লার একটি শট মারতে গিয়ে চোট পেয়ে বিশ্বকাপ থেকেই ছিটকে যান তিনি। গারিঞ্চার সৌজন্যে সেই বিশ্বকাপ ঘরে তোলে ব্রাজিল।

১৯৬৬ বিশ্বকাপ সব থেকে খারাপ যায় ব্রাজিলের। সেবার প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয় সেলেসাওরা। পেলেকে যেন সেই বিশ্বকাপের প্রতিপক্ষের ফুটবলাররা মারবেন বলেই ঠিক করে নিয়েছিলেন। প্রথম ম্যাচে বুলগেরিয়ার খেলোয়াড়রা পেলেকে প্রচুর ফাউল করেন। তবে আসল ঘটনা ঘটে পর্তুগালের বিরুদ্ধে।

সেই ম্যাচে জোয়াও মোরাইস জঘন্য ফাউল করলেও রেফারি তাকে লাল কার্ড দেখাননি। সেই সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে ‘অন্যতম জঘন্য’ সিদ্ধান্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। পেলে ওই ম্যাচের পরেই পণ করেছিলেন, আর বিশ্বকাপে খেলবেন না। তবে সতীর্থদের অনুরোধে পরে সিদ্ধান্ত বদলান।

১৯৭০ বিশ্বকাপ ছিল পেলের জীবনে শেষ এবং অন্যতম সেরা বিশ্বকাপ। ব্রাজিল দলে তখন তারকার ছড়াছড়ি। ছিলেন রিভেলিনো, টোস্টায়ো, জর্জিনহো, গার্সন, কার্লোস আলবার্তো তোরেসরা। ফাইনালে ইতালিকে ৪-১ ব্যবধানে উড়িয়ে দেয় ব্রাজিল।

কার্লোস আলবার্তোকে দেওয়া পেলের সেই পাস এখনো ফুটবলপ্রেমীদের চোখে লেগে রয়েছে। পেলেই একমাত্র ফুটবলার যার তিনটা বিশ্বকাপ জয়ের নজির রয়েছে।

রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাস, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ইন্টার মিলানসহ একাধিক ক্লাব টাকার থলি নিয়ে পেলেকে সই করানোর জন্য বসেছিল। কিন্তু ব্রাজিল ছেড়ে অন্য কোথাও খেলতে যাননি পেলে। অর্থকে বরাবরই দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন তিনি। দীর্ঘ ১৮ বছর খেলেছেন সান্তোসে। ৪৯৩ ম্যাচে করেছিলেন ৫০১টি গোল।

এরপর আমেরিকার নিউ ইয়র্ক কসমসের হয়ে সই করেন পেলে। সেই দলের হয়েই প্রথমবার ভারতবর্ষে এসেছিলেন তিনি। মোহনবাগানের বিরুদ্ধে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে কলকাতায় পা দিয়েছিলেন বিশ্ব ফুটবলের রাজপুত্র। কিন্তু সেই খেলা নিয়েও দেখা গিয়েছিল সমস্যা।

ম্যাচের দিন এবং আগের দিন প্রবল বৃষ্টিতে ভেসেছিল শহর। ইডেন গার্ডেন্সের মাঠে বিভিন্ন জায়গায় জমে গিয়েছিল পানি। পেলের বাঁ পায়ের বিমা করানো ছিল। বিমা কোম্পানির লোকরা কিছুতেই পেলেকে ওই মাঠে খেলতে দিতে রাজি ছিলেন না।

কিন্তু কলকাতার লাখ লাখ সমর্থকের কথা ভেবে পেলে খেলার সিদ্ধান্ত নেন। সেই ম্যাচ ২-২ ড্র হয়েছিল। কিন্তু কাদাজল ভরা মাঠেও পেলের পায়ে যে জাদু দেখা গিয়েছিল, তা এখনও ভুলতে পারেননি ওই ম্যাচের দর্শকেরা। পেলের একটি দুরন্ত ফ্রি কিক এখনও তাদের চোখে ভাসে।

ফুটবল ছাড়ার পর ইউনেস্কোর ‘গুডউইল অ্যাম্বাসেডর’ হন পেলে। এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে গিয়ে ফুটবলের প্রসারে বহু কাজ করেছেন তিনি। রাজনীতিতেও একসময় সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। তবে কোনোদিন প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসেননি।

পেলে শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন বহু বছর ধরে। ২০১৭ সালে হুইলচেয়ারে করে বিশ্বকাপের ড্রয়ে হাজির হয়েছিলেন। তারপরেই বাড়িতে পড়ে গিয়ে গুরুতর চোট পান। মস্কোর বিশ্বকাপে শারীরিক অসুস্থতার কারণে হাজির থাকতে পারেননি। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত নিয়মিত তাকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে শারীরিক পরীক্ষা করাতে হত।

নামের পাশে তিনটি বিশ্বকাপ। সেই সঙ্গে একের পর এক ট্রফি, সম্মান এবং অগণিত স্মৃতি। পেলের মৃত্যুতে শুধু ফুটবলের একটা যুগেরই শেষ হল না, অবসান হল পেলে বনাম ম্যারাডোনার চিরাচরিত সেই লড়াইয়েরও।

২০২০ সালের নভেম্বরে করোনা মহামারির মাঝে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছিলেন ম্যারাডোনা। এবার পেলে চলে গেলেন ৮২ বছর বয়সে। অবশেষে জীবনের শেষ লড়াইয়ে হার মানতে বাধ্য হলেন ‘কালো মানিক।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *