সুন্দরবনের মৌয়ালদের ৭০০ বছরের অপরিবর্তিত গল্প

সুন্দরবনের মৌয়ালদের ৭০০ বছরের অপরিবর্তিত গল্প

ফিচার স্পেশাল

ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৪ ১২:২৯ অপরাহ্ণ

সুন্দরবনের সঙ্গেই ভালো মানায় ‌‘ভয়ংকর সুন্দর’ তকমাটা। এই ভয়ংকর সুন্দর রাজ্যে প্রায় ৭০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মৌয়ালদের বসবাস। ধীরে ধীরে তাদের সংখ্যা সংখ্যা কমলেও, মধু সংগ্রহের পদ্ধতির একটুও পরিবর্তন আসেনি।

মৌয়ালদের সম্পর্কে জানতে হলে যেতে হবে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে। সেখানে নেমে সুন্দরবনকে ‘সুন্দরবন’ বলা যাবে না। সেখানকার মানুষের ভাষায় সুন্দরবন হচ্ছে ‘ব্যাদাবন’ বা ‘প্যারাবন’। আশেপাশের প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের জীবিকার একমাত্র উৎস এই বন। এর কিছু অংশ বন থেকে মধু সংগ্রহ করে থাকে। যারা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত তাদেরকে বলা হয় মৌয়াল।

মৌয়ালদের বিচিত্র জীবন ধারা বলার মতো, শোনার মতো। মধু সংগ্রহের মৌসুমে এরা নানা রকম নিয়ম কানুন মেনে চলেন। এ সময় যেহেতু বাড়ির পুরুষেরা বনে থাকেন তাই বাড়ির নারীদের নানা নিয়ম পালন করতে হয়। তারা এ সময় বাড়ির বাইরে খুব একটা দূরের এলাকায় যান না। নারীরা এ সময় মাথায় তেল-সাবান ব্যবহার করেন না। দুপুরবেলা কোনোভাবেই চুলায় আগুন জ্বালান না। কারণ তারা বিশ্বাস করেন বাড়িতে এ সময় আগুন ধরালে বন এবং মধুর চাকের ক্ষতি হবে। মধু কাটার মাসে মৌয়ালরা কারো সঙ্গে ঝগড়া বিবাদও করেন না।

মধু সংগ্রহের কাজটা কেবল যে মধু সংগ্রহেই সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয়। এর আগে ও পরে বেশকিছু ঝামেলা পোহাতে হয় মৌয়ালদের। একদিকে বন বিভাগের অনুমতি অন্যদিকে বন-দস্যুদের খপ্পর। তবে সবচেয়ে বড় আতঙ্ক হল ‘মামা’। মামা হচ্ছে বাঘ। হ্যাঁ, স্থানীয়রা রয়েল বেঙ্গল টাইগারকেই ‘মামা’ বলে ডাকে।

প্রতিবছর প্রায় ৮০ জন মৌয়াল মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের হাতে প্রাণ হারায়। এদিকের বেশির ভাগ মৌয়াল মুসলিম হলেও, হিন্দু মৌয়ালের সংখ্যা কম নয় এবং তাদের রয়েছে নিজস্ব দেব-দেবী। ‘বনবিবি’ হল তাদের প্রধান দেবী। দক্ষিণরায়ের মূর্তিতেও তাকে দেখা যায় বাঘের পিঠে বসা অবস্থায়। এছাড়াও আছে নারায়ণী, বিশালক্ষী, কালুরায়সহ আরো অনেক দেব-দেবী। তাদের আশীর্বাদের পরও বাঘের হাতে প্রাণ হারানোকে মৌয়ালরা নিয়তি হিসেবেই মেনে নেয়। তাদের মতে যখন তাদের হায়াত শেষ হয়ে যায় তখনই তারা বাঘের কবলে পড়ে।

গভীর সুন্দর সুন্দরবনের মধু মৌসুম চৈত্র থেকে বৈশাখ পর্যন্ত। ছবি: সংগৃহীত

গভীর সুন্দর সুন্দরবনের মধু মৌসুম চৈত্র থেকে বৈশাখ পর্যন্ত। ছবি: সংগৃহীত

লঞ্চে পিকনিক করতে গিয়ে যে সুন্দরবন দেখেছেন, মধু সেখানে নাই। যে সুন্দরবনে মধু আছে, সেটা ভয়ংকর সুন্দর! একই সঙ্গে ভয়ংকর ও সুন্দর। গভীর সুন্দর সুন্দরবনের মধু মৌসুম চৈত্র থেকে বৈশাখ পর্যন্ত। এ সময় খলিশার মধু বেশি পাওয়া যায় যেটা ‘পদ্ম মধু’ নামেও পরিচিত। তারপর গেওয়ার মধু এবং এর কিছুদিন পর বাইন, কেওড়ার মধু পাওয়া যায়। মধু সংগ্রহের সময় মৌয়ালরা বেশকিছু নিয়ম পালন করেন।

মধু সংগ্রহের সময় মৌয়ালদের একদল খেজুর পাতা-লাঠি দিয়ে বানানো এক প্রকার মশাল দিয়ে ধোঁয়া তৈরি করে মৌমাছিকে দূরে রাখে। আরেকদল পটকা-বাজি ও মহিষের শিং দিয়ে তৈরি শিঙায় ফুঁ দিয়ে বাঘকে দূরে রাখে। কেউ কেউ গায়ে ছাই মেখে /কেউ গামছা পড়ে গাছের ঢালে উঠে যায় ধারালো অস্ত্র হাতে। চাকের প্রথম কিছু অংশ বনবিবির নামে উৎসর্গ করে ফেলে দেয় তারা। মধু নিয়ে খুব দ্রুতই নৌকায় ফিরে যায় তারা। এরপর ন্যাকড়া বা এমন কাপড় দিয়ে ছাঁকন প্রক্রিয়ায় মধু ও মোম আলাদা করে বাড়ির পথ ধরে। একটা মজার তথ্য দেই, দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী একটা মৌমাছি মারলে ৫০ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। জামিল নামের এক মৌয়ালকে জিজ্ঞেস করলাম, এই আইন সম্পর্কে জানেন কি না? তার উত্তর, এই প্রশ্ন শুনেছেন তিনি!

মৌয়াল দলের প্রধানকে বলা হয় ‘সাজুনী’। আপনাকে জঙ্গলে যেতে হবে তাকে রাজি করাতে হবে। ভ্রমণের সময়টুকুর জন্য সে আপনার অভিভাবক। নৈতিক অনৈতিক বিভিন্ন উপায়ে অসংখ্য মানুষ মধু সংগ্রহে নামে। তবে নিয়ম মেনে যেতে হলে আপনাকে বেশ কিছু টাকা গুনতে হবে। ৭-৯ জনের নৌকার ফি দিতে হবে ৭০০০ টাকা। একটি সিঙ্গেল পাস এবং একটি ‘বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট’ নিতে হবে। সেটার জন্য চেয়ারম্যান থেকে ছবি, জন্ম-নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র এসব কিছুর সত্যায়িত কপি লাগবে। এগুলো জোগাড় ও কম খাটুনির কথা নয়।

দলের সবাই সাজুনীর নেতৃত্বে আগের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী মৌমাছির গতিপথ দেখে বনের কিনারে নৌকা রেখে বনের ভেতর চাকের সন্ধান করেন। চাক খোঁজার সময় মৌয়ালদের দৃষ্টিটা উপরের দিকে থাকে বলে মৌয়ালরাই বাঘের আক্রমণের শিকার হন সবচেয়ে বেশি। মৌচাক পাওয়া মাত্র ‘আল্লাহ… আল্লাহ…’ বলে চিৎকার করে বাকিদের জানিয়ে দেওয়া হয়। তাছাড়া মামাকে দূরে রাখারও একটা কৌশল এই চিৎকার।

আপনি যদি মৌয়ালদের সঙ্গে মধু সংগ্রহ করতে যেতে চান, আপনাকে কোনো সাজুনী’র ধারস্থ হতে হবে। আপনি তাকে কথা দিয়ে রাজি করাতে পারেন কিংবা টাকা পয়সা দিয়ে। কিন্তু সাজুনী ছাড়া আপনার এই থ্রিলারের অংশ হওয়ার কোনো সুযোগ নাই। মূলত সাতক্ষীরার দাতিনাখালী, বুড়িগোয়ালিনী, শ্যামনগরে মৌয়ালদের বসবাস। মধু সংগ্রহের জন্যে বনে ঢুকতে হবে এই পয়েন্টগুলো দিয়েই।

গহিন অরণ্যে মধু সংগ্রহের বিষয়টি আর দশটা টুরিস্ট স্পট ভ্রমণের মত নয়। এই অভিজ্ঞতার প্রতিটি পরতে পরতে রয়েছে অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ। মোটরচালিত নৌকায় আট দশ জনের একটা দলে বিভক্ত হয়ে প্রথমে যেতে হবে বনের ভেতরে। নৌকা থেকে নামতেই পা হয়তো চলে যাবে এক হাত কাদার ভেতরে, ঘন শ্বাসমূলে ভরা কাদামাখা পথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে কিন্তু চোখ থাকবে গাছে গাছে, হয়ত কোথাও বুক সমান পানি, গন্তব্যের ঠিক নেই।

কিন্তু এত কষ্টের পরও মৌমাছিবিহীন চাক থেকে ঝর ঝর করে মধু ঝরে পড়ার দৃশ্যের থ্রিল আসলে লিখে বোঝানো সম্ভব না। যে ভয়, সে থ্রিল আপনি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করবেন। কখনও বাঘ, কখনও জলদস্যু, কখনও ঝুম বৃষ্টি—এই থ্রিল, অস্বাভাবিক সুন্দরের মধ্যে এই ভয় শুধু নিজে গিয়ে অনুভব করা যায়। বলা বা লেখা যায় না।

ঢাকার কল্যাণপুর,গাবতলী থেকে নিয়মিত সাতক্ষীরাগামী বাস পাবেন। সাতক্ষীরা নেমে সেখান থেকে শ্যামনগরের লোকাল বাস পাবেন। থাকার কোনো আলাদা জায়গা নেই। আপনাকে মৌয়ালদের সঙ্গে তাদের গ্রামে থাকতে হবে, খাওয়া দাওয়াও সেখানে। এরা খুবই সহজ সরল, অভাবী এবং অতিথি পরায়ণ মানুষ। ফেরার সময় থাকা খাওয়া বাবদ কিছু টাকা দিয়ে আসতে পারেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *