সর্বকালের সেরা মেসির ‘ইতিবৃত্ত’

সর্বকালের সেরা মেসির ‘ইতিবৃত্ত’

খেলা স্পেশাল

জুন ২৪, ২০২৩ ১:০৯ অপরাহ্ণ

মেক্সিকোর গোলরক্ষক ওচোয়া এমনিতেই দারুণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করে থাকেন। বিশ্বকাপ এলে তা যেন বৃদ্ধি পায় আরো কয়েকগুণ। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ২০২২ সালের ২৭ নভেম্বরের সেই রাতেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন দুর্ভেদ্য দেওয়াল। মাঠে প্রথমার্ধে নির্বিষ আলবিসেলেস্তেরা যা কয়েকটা আক্রমণ করছিল, সবই একেরপর এক আটকে দিচ্ছিলেন তিনি।

মেক্সিকোর বিপক্ষে সেদিন বাঁচা-মরার লড়াইয়ে আর্জেন্টিনা। হারা পরের কথা, ড্র করলেই বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ঘণ্টা প্রায় বেজে যাবে। এমন এক মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচেই কি না বিবর্ণ আকাশী-নীল শিবির। টিক টিক করে ঘড়ির কাঁটা যাচ্ছে আর বাড়ছে আলবিসেলেস্তেদের দুশ্চিন্তা। আগের ম্যাচ গ্রুপের সহজতম দল সৌদি আরবের কাছে হারায় এমনিতেই চাপ ছিল পাহাড়সম। সেখানে এমন কঠিন মুহূর্ত কাটানোর জন্য প্রয়োজন ছিল বিশেষ কিছু।

ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে- The Greatest players produce their Greatest performances when they are needed. অর্থাৎ, সেরাদের সেরা খেলোয়াড়রাই অতি প্রয়োজনের সময় সেরার থেকেও সেরা নৈপুণ্য প্রদর্শন করে থাকে। যার মাধ্যমে তারা আলাদা হন অন্যদের থেকে।

মেক্সিকোর বিপক্ষে সেই গোলের পর মেসি

মেক্সিকোর বিপক্ষে সেই গোলের পর মেসি

আর্জেন্টিনা দলের হতাশাজনক পারফরম্যান্সে দলের সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় লিওনেল মেসির জন্য চাপটা কি সহ্য করার মতো ছিল? আর তাই যেন তিনি সেই প্রবাদকে তুলে আনলেন বাস্তবে। ম্যাচের ৬৪ মিনিটে মুহূর্তের মধ্যে জায়গা বানিয়ে নিয়ে বোকা বানালেন ওচোয়াকে। বল জালে জড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তার দৌড় যেন স্বস্তি ফেরালো সবার মনে। আর আরো একবার বুঝিয়ে দিলেন, কেন তিনি সেরাদেরও সেরা।

লিওনেল মেসি এমন একজন ফুটবলার, যার ক্যারিয়ারের এরকম ‘গ্রেটেস্ট মোমেন্ট’-এর অভাব নেই। কিন্তু কেন আলাদা করে মেক্সিকো ম্যাচের গল্পটা দিয়ে শুরু করা? তার সেই একটা গোলই যে বদলে দিয়েছিল বিবর্ণ আর্জেন্টিনার রূপ। যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে জন্ম নিয়েছে রূপকথা। আর্জেন্টিনা পেয়েছে পরম আরাধ্য বিশ্বকাপ। আর সমাপ্তি ঘটেছে সর্বকালের সেরা ফুটবলারের প্রশ্নে। যেখানে এখন ‘কমপ্লিট ফুটবলার’ হিসেবে তৃপ্তির হাসি হাসতেই পারেন লিও।

অথচ এই বিশ্বকাপেই শুরুটা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। বিশ্বকাপের আগে হট ফেভারিট হিসেবেই আসা। যেখানে মেসি বলেছিলেন, ‘Knowing that this is a very special moment, certainly my last world cup, my last chance of achieving this dream that I have, that we all want.’  কথাগুলো আগেও বলেছিলেন। তবে এবারের মতো জোর ছিল কি না সে প্রশ্ন করাই যায়। কিন্তু প্রথম ম্যাচেই দুর্বল সৌদি আরবের কাছে হার।

কঠিন সময়ে সবাইকে বিশ্বাস রাখতে বলেছিলেন মেসি

কঠিন সময়ে সবাইকে বিশ্বাস রাখতে বলেছিলেন মেসি

বিশ্বকাপ জয় পরের কথা, টুর্নামেন্টে আলবিসেলেস্তেদের টিকে থাকাই তখন প্রশ্নের মুখে। সবাই দুশ্চিন্তায় ডুবে গেলেও একজন ছিলেন বিশ্বাসী। তিনি আর কেউ নন, লিওনেল মেসি। সমর্থকদের শুধু বললেন, বিশ্বাস রাখো। তার ভাষায়- ‘My message to the supporters is to have faith. We wont let you down. We are going to win.’

এরপর মেক্সিকোর বিরুদ্ধে চাপের মুখে মেসির দর্শনীয় সেই গোল। আর গল্পের বাকিটা আলাদা করে বলার দরকার আছে? অবশ্য বলতে না চাইলেও যে বলতে হয়। ক্যারিয়ারে দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক শিরোপা ছাড়া কিছুরই কমতি ছিল না। তবে মেসির স্বপ্নে ছিল শুধু বিশ্বকাপ। নিজের জীবনের সমস্ত অর্জন বিলিয়ে দিতে রাজি ছিলেন, বিনিময়ে চাইতেন সোনালী ট্রফিটা একবারের জন্য হলেও নিজের করে পাওয়া। অথচ বারবার বুকভরা কষ্ট নিয়েই ফিরতে হয়েছে তাকে।

২০০৬ বিশ্বকাপে দলের বিদায় দেখেছেন সাইডলাইনে বসে। ২০১০ সালে জার্মানির কাছে লজ্জার পরাজয়। পরের আসর অর্থাৎ ১৪ সালে অবশ্য শিরোপার খুব কাছেই গিয়েছিলেন। কিন্তু মারিও গোৎজের শেষ সময়ের গোলে বিশ্বকাপের ট্রফিটা খুব কাছ থেকে দেখা হলেও ছোঁয়ার সুযোগ পাননি লিও। আসরের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার নেয়ার সময় বিশ্বকাপ ট্রফির দিকে মেসির করুণ চাহনির মুহূর্তটি কি আসলেও ভোলা যেতো?

যে ছবি সবাইকে কাঁদিয়েছে অনেকবার

যে ছবি সবাইকে কাঁদিয়েছে অনেকবার

২০১৫ ও ১৬ পরপর দুই বছর কোপা আমেরিকার ফাইনাল থেকে বিদায়। রাগ, ক্ষোভ, হতাশা ও কষ্টে জাতীয় দল থেকে অবসরই নিয়ে নিলেন। তখনও কি তিনি জানতেন, মাত্র ৬ বছরের মাথায় সুখ ও সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করবেন তিনি? ভাগ্যিস আর্জেন্টিনা সেবার ভয়ানক বিপদে পড়েছিল! অবশ্য দলের যে অবস্থা ছিল, ভালো কিছু আশা করাই যে কঠিন ছিল। তাই একপর্যায়ে ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার অংশ নেয়া নিয়েই তৈরি হয় ধোঁয়াশা। মেসি তাই আবার ফিরে আসেন দলের প্রয়োজনে, নতুন ইতিহাস লিখতে।

মেসি আসার পর ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে আর্জেন্টিনা। তবে বাছাইপর্বের শেষ ম্যাচের আগে সমীকরণ ছিল এমন, বিশ্বকাপে খেলতে হলে ম্যাচটি জিততেই হবে তাদের। এদিকে ইকুয়েডরের মাঠে খেলা। যেখানে ২০০১ সালের পর জয়ের মুখ দেখেনি আকাশী-নীল শিবির। এমন ম্যাচেই কিনা প্রথম মিনিটে গোল হজম করলো আর্জেন্টিনা! কিন্তু তিনি কেন সেরাদের সেরা, সেটাই যেন আরেকবার প্রমাণ করেছিলেন মেসি। যেখানে অনবদ্য হ্যাটট্রিক করে দলকে নিয়ে যায় বিশ্বকাপের মূলপর্বে।

অবশ্য একা আর কতই টানা যায়! তাই যেন দ্বিতীয় রাউন্ডেই বিদায়। সেবারই মেসির শেষ দেখে ফেলেছিলেন অনেকে। তবে তিনি যে হাল ছাড়ার পাত্র নন! তাই চালিয়ে যেতে থাকেন চেষ্টা। সঙ্গে যোগ হন লিওনেল স্কালোনি নামের আরেক মায়েস্তো। যিনি আর্জেন্টিনা দলে নিয়ে আসেন আমুল পরিবর্তন। তার ছোঁয়ায় যেন নতুন প্রাণ ফিরে পায় আলবিসেলেস্তেরা। অদম্য গতিতে ছুটতে শুরু করে সামনে।

আর্জেন্টিনার হয়ে কোপা আমেরিকা জয়ের পর মেসি

আর্জেন্টিনার হয়ে কোপা আমেরিকা জয়ের পর মেসি

এরপর আসে ২০২১ কোপা আমেরিকা। যেখানে উজ্জীবিত আর্জেন্টিনার হয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপার স্বাদ পান মেসি। সেই আক্ষেপ ঘোচার কয়েক মাসের মাথায় জেতেন আন্তঃমহাদেশীয় সেরার ট্রফি ‘ফাইনালিসিমা’। তবুও বিশ্বকাপ না জিতলে কি আর গল্পের পূর্ণতা মেলে? বিধাতা বোধ হয় সেই পূর্ণতা দেওয়ার মঞ্চ হিসেবেই তৈরি করেছিলেন ২০২২ কাতার বিশ্বকাপ। যেখানে শেষ হাসি হাসার মধ্য দিয়ে সর্বকালের সেরার আসনে নিজেকে অন্যদের ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যান রোজারিওর ছোট্ট সেই ছেলেটি।

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে মেসিকে কম কটু কথা শুনতে হয়নি। দেশের হয়ে খেলেন না, মেসি মাঠে দৌড়া না। এমনকি মার্কো ফন বাস্তেনের মতো কিংবদন্তি বলেছিলেন, ‘মেসি কোনো নেতা না। মেসিকে নিয়ে খেলা মানে ১১ জনের বিপক্ষে ১০ জন।’ সবগুলোর উত্তর দেওয়ার জন্যই যেন এবারের আসরে নেমেছিলেন মেসি। যেখানে কখনো দেখা গেছে তার ক্ষ্যাপাটে চরিত্র, কখনো দেখিয়েছেন স্বভাবসুলভ অবিশ্বাস্য নৈপুণ্য। নেতা হিসেবে তিনি কেমন সেটা নিয়ে কাতার বিশ্বকাপের পর আর প্রশ্ন তোলারও অবকাশ নেই।

ক্লাবের হয়ে সম্ভাব্য সব শিরোপা জয় তো করেছেন বহু আগেই। বার্সেলোনার হয়ে কাটিয়েছেন ক্যারিয়ারের সেরা সময়। ফরাসি ক্লাব প্যারিস সেইন্ট জার্মেইনেও (পিএসজি) দেখিয়েছেন নিজের নৈপুণ্যের ঝলক। তার প্রতিটি বিষয়েই কীর্তিগাঁথা এত বেশি যে সেসব নিয়ে আলাদা করেই একেকটি বই লিখে ফেলা যাবে। তবে ক্লাবের হয়ে সব জয় করলেও মেসিকে অনেকেই সেরা মানতেন না। যার কারণ ছিল বিশ্বকাপ না জেতা।

বিশ্বকাপ জয়ের পর নিজেকে অবিসংবাদিতভাবে সেরাদের সেরা দাবি করতেই পারেন মেসি।

বিশ্বকাপ জয়ের পর নিজেকে অবিসংবাদিতভাবে সেরাদের সেরা দাবি করতেই পারেন মেসি।

অধরা সেই বিশ্বকাপ জয়ের পর মেসি এখন একদম ছোট্ট ব্র্যাকেটে চলে এসেছেন। যেখানে তার পাশে আছেন শুধু পেলে ও ম্যারাডোনা। তবে জাতীয় দল ও ক্লাব মিলিয়ে যা কিছু অর্জন করেছেন, মেসির মতো ‘কমপ্লিট ফুটবলার’ আর একজনও নেই। আর তাই অর্জনের খাতায় মেসিকে পেলে-ম্যারাডোনার চেয়ে এগিয়ে রাখলেও ফুটবলবোদ্ধারা নিশ্চয়ই আপত্তি করবেন না। এ তো গেলো ফুটবলের কথা। যদি সবরকম খেলার হিসাব করা হয়, সেখানে সর্বকালের সেরাদের কাতারে নাম আসে মোহাম্মদ আলী, মাইকেল জর্ডান, রজার ফেদেরার, উসাইন বোল্টদের কথা।

তবে বিশ্বকাপ জয়ের পর মেসি যে অর্জনের খাতায় তাদের প্রত্যেককেই ছাপিয়ে গেছেন, তা বলা বোধ হয় ভুল হবে না। এখনো অবসর গ্রহণ করেননি। জাতীয় দল ও ক্লাবের হয়ে মেসি মাতিয়ে যাচ্ছেন সবাইকে। যারা তার খেলা দেখছেন, নিজেদের সৌভাগ্যবাদ দাবি করে বলতেই পারেন, ‘আমি সর্বকালের সেরার জাদু দেখেছি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *