অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি

অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি

অর্থনীতি স্লাইড

এপ্রিল ১৩, ২০২৪ ৬:৩৫ পূর্বাহ্ণ

অর্থনীতিতে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে ন্যায্যমূল্যে মানুষের হাতে ভোগ্যপণ্য পৌঁছে দেওয়া। রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ, ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়াসহ নানা বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব রয়েছে দেশের অর্থনীতিতে। এ কারণে বহির্বিশ্বের মতো বাংলাদেশে নিত্য ও ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়।

বছরের শুরুতে জিনিসপত্রের দাম কিছুটা কমলেও মার্চ মাসে রোজার প্রথম সপ্তাহে আবার জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। এক্ষেত্রে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজির অভিযোগ রয়েছে। তবে এখন আবার ভোগ্যপণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। বিশেষ করে পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল ও চিনির মতো পণ্যের দাম কমে গেছে। এছাড়া সবজির দামও নিম্নমুখী। আশা করা হচ্ছে ঈদের পরও নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক থাকবে।

ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি কমেছে-

ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম কমায় ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। জানুয়ারিতে ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই) ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে কমা সত্ত্বেও ভোক্তা মূল্যস্ফীতি চলতি অর্থবছরের জন্য সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ওপরে আছে।

ফেব্রুয়ারিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ বেসিস পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশে, যা আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ। একইভাবে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি ৯ বেসিস পয়েন্ট কমে ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশে নেমে এসেছে।

সরকার চলতি ২০২৩-২৪ সালে মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। আশা করা হচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে মূল্যস্ফীতি আরো কমবে। এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদহার বাড়িয়েছে সরকার।

রেমিট্যান্স:

দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়। ঈদ সামনে রেখে প্রবাসীরা আত্মীয় স্বজনের কাছে বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। আগামী কোরবানি ঈদ পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ফেব্রুয়ারিতে প্রবাসী আয় ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। গত মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীরা প্রায় ২ দশমিক ১৭ বিলিয়ন বা ২১৭ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।

এর আগে, ফেব্রুয়ারিতে রেমিট্যান্স কখনো ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়নি। তবে সম্প্রতি ব্যাংকের মাধ্যমে ডলারের ভালো দর পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে ফেব্রুয়ারিতে রেমিট্যান্স বাড়ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসে ২১০ কোটি ডলার। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে প্রবাসীরা ১ হাজার ৫০৬ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন।

গত অর্থবছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ১ হাজার ৪০১ কোটি ডলার। সে হিসেবে প্রথম ৮ মাসে রেমিট্যান্স বেড়েছে ১০৫ কোটি ডলার বা ৭ দশমিক ৫১ শতাংশ।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রবাসীরা ১৫৬ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন।

ব্যাংকাররা জানান, আমদানি নিয়ন্ত্রণের ধারা অব্যাহত আছে। তবে ব্যাংকগুলো এখনো ১২১ থেকে ১২২ টাকা দরে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজ থেকে রেমিট্যান্স কিনছে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় দর নির্ধারিত রয়েছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। এর মধ্যে রফতানি আয় দেশে আসা বেড়েছে। সব মিলিয়ে ডলারের বাজার পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। আশা করা হচ্ছে ডলার সংকট কেটে যাবে এবং আমদানিতে এলসি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

বিনিয়োগ-

ডলার সংকট, অর্থ পাচার, সেবা প্রাপ্তিতে ভোগান্তি ও জ্বালানি সংকটের মতো বিষয়গুলোর কারণে গত একবছরে দেশে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ কমছে বলে মনে করা হয়। তবে জাতীয় নির্বাচনের পর উদ্যোক্তারা আবার বিনিয়োগমুখী হচ্ছেন। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসছে। তবে এক্ষেত্রে আরেকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। আর সেটি হলো ঋণের সুদ হার তুলে নেয়া। এর ফলে ব্যাংক ঋণের বিপরীতে উচ্চহারে সুদ আদায় করার সুযোগ নেবে ব্যাংকগুলো।

বিনিয়োগকারী বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর বাংলাদেশে নিয়ে আসা অর্থ সংক্রান্ত জরিপ প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সবশেষ এই জরিপের রিপোর্ট প্রকাশ হয় গত ডিসেম্বরের শুরুতে।

রিপোর্টে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে নিট এফডিআই প্রবাহ ছিল ৩২৪ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার ডলার। অথচ আগের বছর অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে এই পরিমাণ ছিল ৩৪৩ কোটি ৯৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার। হিসাব বলছে, বছর ব্যবধানে নিট এফডিআই প্রবাহ কমেছে ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। তবে বিনিয়োগ আকর্ষণে বর্তমান সরকারের নানামুখী উদ্যোগ রয়েছে। আশা করা হচ্ছে, নতুন অর্থবছরে বিনিয়োগ বাড়বে।

রিজার্ভ-

আমদানির গতি স্বাভাবিক রাখা ও আইএমএফের ঋণ পেতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্ভাব্য সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একদিকে রয়েছে দেনা পরিশোধের প্রবল চাপ এবং অপরদিকে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাড়ানোর বড় চ্যালেঞ্জ তো আছেই। আবার আমদানি ব্যয় তথা আমদানির জন্য এলসি খুলতে বিপুল অংকের ডলারের চাহিদা লাফিয়ে বাড়ছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনেক বিষয় সামনে রেখে বেশ সাবধানে এগোতে হচ্ছে। এ অবস্থায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ আপাতত ২ হাজার কোটি ডলারের আশপাশে ধরে রাখতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বর্তমানে নিট রিজার্ভে অংকের কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে। রিজার্ভ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বকেয়া রফতানি আয় দেশে আনা ও বেশি দামে হলেও রেমিট্যান্স সংগ্রহ বাড়ানোর তাগিদও দিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে, আমদানি ব্যয় যেন বেশি না বাড়ে সেজন্য আমদানিতে জোরেশোরে লাগাম টানা হয়েছে। অন্যান্য খাতেও ডলার সাশ্রয় করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে রিজার্ভ বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত বাস্তবায়ন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

গত বছরের জুনে নিট রিজার্ভ রাখার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ৩৭৪ কোটি ডলার। ঐ সময় নানামুখী চেষ্টা করেও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রিজার্ভ রাখতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বছরের জুনে নিট রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৯৫৬ কোটি ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশ কম। রিজার্ভ নিম্নমুখী হওয়ায় আইএমএফ তা কমিয়ে নতুন লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে। সে অনুযায়ী জুনে গ্রস রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ৩৮৮ কোটি ডলার। নিট রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৯৬৮ কোটি ডলার। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দুই খাতেই রিজার্ভ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ছিল। গ্রস রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৫২৫ কোটি ডলার এবং নিট রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৯৯৯ কোটি ডলার।

রিজার্ভ এখন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কিছুটা বেশি হলেও জুনের আগে আরো তিনটি বড় দেনা পরিশোধ করতে হবে। এর মধ্যে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনার দুটি কিস্তি এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ধার করা ডলার পরিশোধ করতে হবে। মার্চ ও এপ্রিলের আকুর দেনা পরিশোধ করতে হবে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। মে ও জুনের দেনা শোধ করতে হবে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে। এই দুই খাতের দেনা বাবদ প্রায় ২৫০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দেনা বাবদ শোধ করা হয়েছে ১২৯ কোটি ডলার। ফলে আমদানি যেহেতু বাড়ছে, সেহেতু দেনা শোধের পরিমাণ আরো বেশি হতে পারে। এছাড়া ব্যাংকগুলো থেকে ডলার ধার নিয়ে রিজার্ভ বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু এগুলো ব্যাংককের চাহিদা অনুযায়ী পরিশোধ করতে হবে। চলতি মাসেই শোধ করতে হবে সাড়ে ৬ কোটি ডলার। ফলে এসব দেনা শোধ করার পর রিজার্ভ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

রফতানি আয়-

গত ডিসেম্বরে ৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় বাংলাদেশের। ২০২৩ সালের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। ২০৩০ সালের মধ্যে পণ্য ও সেবাখাতে ১০০ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয়ের লক্ষমাত্রা রয়েছে সরকারের। এজন্য ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা, অবকাঠামো উন্নয়নে নজর দেওয়া হচ্ছে।

ইপিবির তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বাংলাদেশের মোট রফতানি আয় হয়েছে ২৭ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা সামান্যই (শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ) বেড়েছে।

বাংলাদেশের রফতানি অন্যতম মূলস্তম্ভ- টেক্সটাইল শিল্পে এ সময় সামান্য প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। তৈরি পোশাক রফতানি আয় ১ দশমিক ৭২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে হয়েছে ২৩ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার, যা ছিল এই ৬ মাসে মোট রফতানির ৮৫ শতাংশ।

এছাড়া নিটওয়্যার খাতে একক অংকের প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে ওভেন টেক্সটাইলের রফতানি পারদর্শিতা টানা কয়েকমাস ধরেই কমার ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে।

রফতানির অন্যান্য প্রধান প্রধান খাতেও প্রতিকূলতা দেখা গেছে। যে কারণে জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায়- হিমায়িত ও জ্যান্ত মাছ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল ও ফুটওয়্যার খাতে প্রবৃদ্ধি চলে গেছে নেতিবাচক ধারায়।

রফতানি আয়ের প্রধান চ্যালেঞ্জ আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাকের সঠিক দাম না পাওয়া। কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া। এছাড়া রফতানি আয় বাড়াতে পণ্য বহুমুখীকরণ ও নতুন বাজার অনুসন্ধান করতে হবে। এরই মধ্যে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দফতরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

নতুন বাজেট ঘোষণা জুনে:

আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের নতুন বাজেট ঘোষণা করা হবে জুন মাসে। টাকার অংকে ৮ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে এবারের বাজেটের আকার। বড় অংকের এই বাজেট দিতে কর হার না বাড়িয়ে করের আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া নিত্যপণ্যের দাম যেন না বাড়ে সে বিষয়ে বাজেটে পদক্ষেপ থাকতে হবে। এছাড়া দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়াতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *