মৌসুমের শুরুতেই চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গি

মৌসুমের শুরুতেই চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গি

জাতীয় স্লাইড

মে ৩১, ২০২৩ ৮:২১ পূর্বাহ্ণ

দেশে জুন থেকে সেপ্টেম্বর ডেঙ্গির প্রজনন মৌসুম। এই সময়ে ঋতু ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বর্ষাকাল শুরু হয়। বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টির পানি জমতে শুরু করে। কীটতত্ত্ববিদরা এই সময়টাকে ডেঙ্গির জীবাণু বহনকারী এডিস মশার প্রজননকাল হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু চলতি বছর এডিস মশার প্রজনন মৌসুমের শুরুতেই ডেঙ্গি আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সংখ্যার দিক থেকে গত বছরের প্রথম পাঁচ মাসের তুলনায় প্রায় ছয়গুণ।

গত বছর এই সময়ে ডেঙ্গিতে মৃত্যু শূন্য থাকলেও মঙ্গলবার পর্যন্ত ১৩ জনে পৌঁছেছে। ইতোমধ্যে ৪৪টি জেলায় রোগী শনাক্ত হয়েছে। প্রতিদিনই চিকিৎসার জন্য রোগীরা হাসপাতালে ছুটে আসছেন। ডেঙ্গির এই চোখ রাঙানি সম্পর্কে স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হলে কো-মরবিডিটি তথা দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগে আক্রান্তদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকে। কিন্তু মশকবাহিত রোগটির নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়হীনতা ও দায়িত্ব অবহেলার কারণে মৌসুমের শুরুতেই রোগটির বিস্তার ছড়িয়ে পড়ছে। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এডিস মশানিধন কর্মসূচি সারা বছর অব্যাহতভাবে রাখতে হবে। এ কাজে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।

এদিকে ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আরও ৮৪ জন রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। নতুন রোগীর ৬১ জন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৩ জন। বর্তমানে সারা দেশে ২৪৬ জন ডেঙ্গি রোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ২০৭ এবং ঢাকার বাইরে সারা দেশে ৩৯ জন ডেঙ্গি রোগী ভর্তি রয়েছেন। চলতি বছর ডেঙ্গি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে ঢাকায় ১ হাজার ২৯৬ এবং ঢাকার বাইরে ৬৩১ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গিবিষয়ক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি মাসের ৩০ দিনে ৯৪১ ডেঙ্গি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ সময় ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন দুজন। গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের মে মাসে ডেঙ্গি শনাক্তের সংখ্যা ছিল ১৬৩ জন, কারও মৃত্যু হয়নি। ২০২১ সালে করোনা মহামারি চলাকালে মে মাসে ৪৩ জনের ডেঙ্গি শনাক্ত হয়, কেউ মারা যাননি। এর আগের বছর ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১০ জন এবং ২০১৯ সালে ১৯৩ জন। ওই বছরগুলোয়ও মে মাসে কারও মৃত্যু হয়নি। অন্যদিকে চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ৩০ মে পর্যন্ত ১৯২৭ জন ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত পাঁচ বছরে শনাক্ত ও মৃত্যুর এমন চিত্র আর দেখা যায়নি।

মৌসুম শুরুর আগেই ডেঙ্গি রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ হিসাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ (প্রাণিবিদ্যা বিভাগ) অধ্যাপক কবিরুল বাশার মঙ্গলবার বলেন, এখন অনেক জায়গায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে বহুতল ভবনের পার্কিংয়ের জায়গা, নির্মাণাধীন ভবনের বেজমেন্ট, ওয়াসার মিটার বাক্স এবং বাসাবাড়িতে জমিয়ে রাখা পানি। রাস্তা উঁচু করার ফলে নিচু হয়ে যাওয়া বাসাবাড়ির জমা পানিতেও এডিস মশা জন্ম নিচ্ছে। মে মাসে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় আরও বেশি এডিসের প্রজননক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণে মশানিধনে জনসম্পৃক্ততা ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোয় ফগিং করে উড়ন্ত এডিস মশানিধন কর্মসূচি জরুরি হয়ে পড়ছে।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. খলিলুর রহমান বলেন, দেশে ডেঙ্গির প্রকোপ সবচেয়ে বেশি ছিল ২০১৯ সালে। বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার বিস্তারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ রোগের সংক্রমণ বাড়তে দেখা যায়। তবে চলতি বছর ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে।

এবার বর্ষা শুরুর আগেই লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে, এ মাসের ৩০ দিনে প্রায় দুই হাজার ডেঙ্গি রোগী শনাক্ত হয়েছেন। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক কম। এর কারণ, রোগীদের অবস্থা বেশি খারাপ না হওয়া পর্যন্ত তারা হাসপাতালে আসছেন না। গত সপ্তাহ থেকে দৈনিক দুই-একজন করে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।

জনস্বাস্থ্যবিদরা আরও বলেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণে ২০১৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক কে কে কৃষ্ণমূর্তি সরকারকে ২২ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। তাতে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে করণীয় বলা ছিল। পাশাপাশি ২০টির বেশি সুপারিশ ছিল।

১২টি মন্ত্রণালয়ের পৃথকভাবে সুনির্দিষ্ট করণীয় তাতে উল্লেখ ছিল। ডেঙ্গির প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে কীভাবে যুক্ত বা ব্যবহার করতে হবে, সেই পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল। এসব সুপারিশ বা পরামর্শ ২০১৯ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। কিন্তু দিন শেষে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় এবার প্রজনন মৌসুমের শুরুতেই ডেঙ্গি ফের চোখ রাঙাচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *