প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতকারে যেসব প্রসঙ্গ উঠে এসেছে

জাতীয় স্পেশাল স্লাইড

সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৩ ৬:৩১ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৭ সেপ্টেম্বর ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেন। সাক্ষাতকারে উঠে এসেছে খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা, ডিজিটাল বাংলাদেশ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও র‌্যাবের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাসহ নানা প্রসঙ্গ।

ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের প্রধান শতরূপা বড়ুয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওয়াশিংটন সফরের সময় ওই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। ওই সাক্ষাৎকারের ভিডিও ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।

সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা এবং র‍্যাবের কর্মকর্তাদের ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞাসহ মানবাধিকার ও ভোটসংক্রান্ত বিষয়ে প্রশ্ন করেন শতরূপা বড়ুয়া। জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমার এটাই প্রশ্ন যে হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই তারা আমাদের ওপর ভিসা স্যাংশন দিতে চাচ্ছে কী কারণে? আর মানবাধিকার বা ভোটের অধিকারের কথা যদি বলে, তাহলে আমরা আওয়ামী লীগ, আমরাই তো বাংলাদেশের মানুষের ভোটের অধিকার নিয়ে সংগ্রাম করেছি। আমাদের কত মানুষ রক্ত দিয়েছে এই ভোটের অধিকার আদায় করার জন্য। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন যাতে হয়, তার জন্য যত রকমের সংস্কার, সেটা আমরাই তো করেছি—আজকে ছবিসহ ভোটার তালিকা, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, মানুষকে ভোটের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা; এগুলো আমরাই করেছি।

প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব”—এ স্লোগান তো আমার দেওয়া। আমি এভাবে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছি। আমাদের দেশে বেশির ভাগ সময় মিলিটারি ডিক্টেটর (সামরিক স্বৈরাচার) দেশ শাসন করেছে। তখন তো মানুষের ভোট দেওয়া লাগেনি। তারা ভোটের বাক্স নিয়ে গিয়ে শুধু রেজাল্ট ঘোষণা দিয়েছে। এরই প্রতিবাদে আমরা আমাদের আন্দোলন–সংগ্রাম করে নির্বাচন সুষ্ঠু পরিবেশে নিয়ে আসতে পেরেছি। এখন মানুষ তার ভোটের অধিকার সম্পর্কে অনেক সচেতন। সেটা আমরা করেছি। কাজেই সেই ক্ষেত্রে হঠাৎ এই ধরনের কোনো স্যাংশন দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা আছে বলে আমরা মনে করি না।

খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার প্রসঙ্গে করা এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যদি তাদের বাহিরে (বিদেশে) যেতে হয় তাহলে এখন যে আমি বাড়িতে থাকার পরামর্শ/অনুমতি দিয়েছি সেটা আমাকে উথড্রো করতে হবে। তাকে আবার জেলে যেতে হবে এবং কোর্টে যেতে হবে। কোর্টের কাছে আবেদন করতে হবে। কোর্ট যদি রায় দেয় তখন সে যেতে পারবে, এটা হলো বাস্তবতা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় ফেরত যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। শেখ হাসিনাকে প্রশ্ন করা হয়-বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধীদলগুলো একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। আর আপনারা বলছেন যে, সংবিধানে এর সুযোগ নেই। কিন্তু সংবিধান সংশোধন করার মত প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা সংসদের আপনাদের রয়েছে। সংবিধান পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার কোন উদ্যোগ কি আপনারা নেবেন বা বিরোধীদলের সঙ্গে আলোচনায় যাবেন?

এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই তত্ত্বাবধায়কের জন্য বিএনপি যখন ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করে তখনই আমরা আন্দোলন করেছিলাম। ওই যে, ভোট চুরি যখন করে তখন। তখনই কিন্তু জনগণ ওইটা চাচ্ছিল। তখন বিনএপির নেত্রী বলেছিল “পাগল এবং শিশু ছাড়া কেউ নাকি নিরপেক্ষ নাই”। এটা তাদেরই কথা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধিনেতো নির্বাচন হয়েছিল ২০০৮ সালে। কারণ বিএনপি ২০০১ থেকে ২০০৬ এ জঙ্গিবাদ সৃষ্টি, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, মানিলন্ডারিং, যত রকমের অপকর্ম ছিল তার করণেই বাংলাদেশে ইমার্জেন্সি ডিকলার হয়। তখন কিন্তু এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসে। দুই বছর কিন্তু তারা নির্বাচন দেয়নি। বরং আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করে। তারপর যখন ২০০৮ এ নির্বাচন হলো সেই নির্বাচনটাও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধিনেই হয়। সেই নির্বাচনে বিএনপি কয়টা সিট পেয়েছিল? ৩০০ সিট আমাদের, বিএনপির নেতৃত্বে জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোট সিট পেয়েছিল মাত্র ২৯টি। পরে রিইলেকশনে একটা। তাদের অবস্থানটা ওই জায়গায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনেই তাদের এই অবস্থা। যার জন্য তারা ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করে এবং সেটা বানচাল করতে অগ্নিসন্ত্রাস করে।

শেখ হাসিনা পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেন, হঠাৎ তাদের এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি কেন? প্রশ্ন হচ্ছে যে- তাদের নেতাটা কে? মানুষ ভোট দেবে কাকে? মানুষ একজন নেতৃত্ব দেখতে চায়। বিএনপি কি তেমন কাউকে সামনে আনতে পেরেছে? যাকে নিয়ে তারা নির্বাচন করবে! বিএনপি-জামায়াত সহ তাদের ২০ দলীয় জোট আছে, এই পর্যন্তই। কিন্তু নেতৃত্ব কোথায়?

প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচন, এটা হচ্ছে জনগণের ভোটের অধিকার। যখন ২০০৭ সালে ইমার্জেন্সি ঘোষণা হলো, এরপর কিন্তু উচ্চ আদালতে রায় ছিল যে, বাংলাদেশে আর কোন অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসতে পারবে না। একটা নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তে আরেকটা নির্বাচিত সরকারই আসতে হবে।

‘বিএনপি নেতাদের মামলা দিয়ে নির্বাচন থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা হচ্ছে’ এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে ভয়েস অব আমেরিকাকে শেখ হাসিনা বলেন, মামলাগুলো কেন হয়েছে? নতুন করে কিছু করা হয়নি। দুর্নীতি, অগ্নিসন্ত্রাসের কারণে মামলা হয়েছে। মামলা চলমান প্রক্রিয়া। মামলা চলতেছে কত বছর ধরে। মামলাগুলো চলতে চলতে এক পর্যায়ে নিষ্পত্তি হচ্ছে। এখন যে নতুন করে কিছু করা হচ্ছে তা কিন্তু না। তারা যে মামলার হিসাব দিয়েছে (১ লক্ষ ৪১ হাজার ৬৩৩টি মামলা, ৪৯ লক্ষ ২৬ হাজার ৪৯২ জন আসামী) তাতে কি তালিকা দিতে পেরেছে?

র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী, আমাদের দেশের কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, সেটা র‍্যাব হোক, পুলিশ বা যেটাই হোক, কেউ যদি কোনো রকম অন্যায় করে, আমাদের দেশে কিন্তু তাদের বিচার হয়। এই বিচারে কিন্তু কেউ রেহাই পায় না। অনেক সময় কোনো কাজ তারা অতিরিক্ত করে, করতে পারে। কিন্তু করলে সেটা আমাদের দেশের আইনেই সেটার বিচার হচ্ছে। যেখানে এমন বিচার হচ্ছে, এ ধরনের ব্যবস্থা আছে, সেখানে এই স্যাংশনে কী কারণে?

  • ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, জাতীয় কিংবা স্থানীয় সরকার নির্বাচন—প্রতিটি সুষ্ঠুভাবে হয়েছে দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এসব নির্বাচনে মানুষ তার ভোট দিয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এই নির্বাচনগুলো নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু বাস্তবতাটা কী, বাংলাদেশের মানুষ তার ভোটের অধিকার নিয়ে সব সময় সচেতন। কেউ ভোট চুরি করলে তাদের ক্ষমতায় থাকতে দেয় না।

শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল, বাংলাদেশ বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। তাঁর কথায়, ‘এখন আর বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ নেই, এখন মানুষের সে রকম হাহাকার নেই, এমনকি আমাদের যে বেকারত্ব, সেটাও কিন্তু কমে এখন মাত্র ৩ শতাংশ। সেটাও তারা ইচ্ছা করলে কাজ করে খেতে পারে।’

শেখ হাসিনা বলেন, আজকের বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশ, ওয়াইফাই কানেকশন সারা বাংলাদেশে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাটের অভূতপূর্ব উন্নয়ন আমরা করে দিয়েছি; মানুষ যেন কাজ করে খেতে পারে। আমাদের বিশেষ করে কারিগরি শিক্ষা, ভোকেশনাল ট্রেনিং; আমরা এগুলোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। এভাবে দেশের জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সেখানে এভাবে স্যাংশন দিয়ে মানুষকে ভয়ভীতি দেওয়া…। তো ঠিক আছে, স্যাংশন দিলে (বাংলাদেশিরা) আমেরিকা আসতে পারবে না, আসবে না। না আসলে কী আসবে-যাবে? আমাদের দেশে এখন যথেষ্ট কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে। কাজেই আমরা দেখি, কী করে তারা। কেন তাদের এই স্যাংশন জারি।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারী ব্যক্তিদের ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপের পদক্ষেপ নেওয়া শুরুর ঘোষণা আসে ২২ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের ভিসা দেবে না দেশটি। এর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

পুরো সাক্ষাতকারটি শুনতে ক্লিক করুন এখানে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *