২০ ঘন্টার সফরে নতুন ইতিহাস গড়ে গেলেন ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ

২০ ঘন্টার সফরে নতুন ইতিহাস গড়ে গেলেন ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ

জাতীয়

সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৩ ৫:৩৩ অপরাহ্ণ

মোহাম্মদ আল এমরান।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সফলটি বাংলাদেশকে প্রযুক্তিখাতসহ আন্তজার্তিক ও ভূ-রাজনীতিতে এক নতুন দ্বার উম্মোচিত করেছে। দীর্ঘ ৩৩ বছর পর ফ্রান্সের কোনো রাষ্ট্র প্রধানের সফর ছিল এটি। এর আগে ১৯৯০ সালে ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরা ঢাকা সফর করেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ গত ২০২১ সালের প্রধানমন্ত্রীর প্যারিস সফরের ফলোআপ হিসেবে জি-২০ সম্মেলন শেষে পুরানো আমন্ত্রণে ছুটে এসেছেন ঢাকায়।

দুই দেশের আন্তজার্তিক ও ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে অটুট রয়েছে। প্রযুক্তি বিনিময়ের ক্ষেত্রেও ফ্রান্সের সহযোগিতা দেশকে তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য এনে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-০১ উৎক্ষেপনে ফ্রান্সের সহযোগিতার ফলে ২০১৮ সালে ৫৭ তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইট জগতে প্রবেশ করে বাংলাদেশ।

রবিবার ১০ সেপ্টেম্বর রাত ৮:০০ টা ঢাকায় পৌঁছান ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। শাহজালাল রহ. আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা শেষে নিজের মত ঘুরে বেড়িয়েছে ম্যাক্রোঁ। কঠোর নিরাপত্তা বলয় উপেক্ষা করে তিনি রাতভর ঘুরে বেড়িয়েছে ঢাকার আশেপাশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান। পরিচিত হয়েছেন ঢাকার শিল্প, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে। ঢাকায় এসে তিনি এমন কিছু ব্যতিক্রমই কাজ করেছেন তা যেন ঢাকায় আসা বিলেত ফেরত রাজকুমারের মত। ঢাকায় এমনই মেইল-বন্ধন যেন তাঁর পূর্বপুরুষ এদেশেরই সন্তান। হ্যাসোজ্জ্বল ফরাসির প্রেসিডেন্ট মধ্যরাতে ছুঁটে গিয়েছেন জলের গানের দলনেতা রাহুল আনন্দের বাসায়, এক ভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শুনেছেন ফোক গান।

নৈশভোজের খাবারে তিনি বাঙ্গালীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। স্বাদ নিয়েছেন বাঙ্গালীর প্রতিদিনের খাবারের মেন্যুতে থাকা সুস্বাদু রেসিপির মুখরোচক খাবার। তিনি পিঁয়াজুসহ ধূমায়িত ইলিশ এবং সমুচা, স্যুপ, রুটি এবং মাখন দিয়ে নৈশভোজে আপ্যায়িত হয়েছেন। তিনি খাসির মাংসের কাচ্চি বিরিয়ানি, গরুর কাবা, চিকেন র্কোমা, ঐতিহ্যবাহী লুচি ও রোস্টেড লব স্টার দিয়ে নৈশভোজ করেন। পছন্দ তালিকায় বাঙ্গালীর ডের্জাট আইটেম পাটিসাপটা পিঠা, মিষ্টি দই, রসগোল্লা, তাজা ফল, পানীয় এবং আনারের জুস, তাজা জুস, জল এবং কোমল পানীয়, চা এবং কফি যোগে অ্যাপায়িত হন তিনি।

সোমবার ১১ সেপ্টেম্বর সকালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পন করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের বাসার বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন ও পরিদর্শন বইতে সই করেন তিনি। কিছুক্ষণ লেকের পাড়েও হেঁটে বেড়িয়েছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট। এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে ঢাকা-প্যারিস দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক শেষে ছুঁটে যান আমিন বাজার তুরাগ নদীতে পাড়ে। বৃষ্টিস্নাত তুরাগে ভ্রমণ বিলাসে বাংলার নদীবাহিত অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করেন তিনি। তুরাগে বহমান পাল তোলা নৌকা, জারি-সারি ভাটিয়ালি বাউল গানের সাথে সেই গ্রামীণ চিরাচরিত মনমুগ্ধকর এক প্রকৃতিতে নিজেকে বাঙ্গালীর রুপছায়ায় মলিন হন ম্যাক্রোঁ। তুরাগ তীরে ভাসমান খাবারও তাঁকে আকৃষ্ট করে। তিনি সেই ভাসমান রাস্তার জল খাবার সিঙ্গারা, সমুচা ও জিলাপির স্বাদ গ্রহন করেন।

তুরাগের পাড়ে তাঁকে দেখতে আসা শিশু, বয়বৃদ্ধ সবাইকে আপন মহিমায় কাছে টেনে কুশন বিনিময়ও করেন। স্বল্প সফরে বাংলার সংস্কৃতি আর প্রকৃতির সাথে মিশে যান ম্যাক্রোঁ। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে প্রায় এক ঘন্টা ধরে তুরাগ নদ ঘুরে দেখেন ম্যাক্রোঁ ও তার সফরসঙ্গীরা। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিও বাঁধ সাধতে পারিনি হাজার মাইল দূরের এই রাষ্ট্রপতি ও তার সফর সঙ্গীদের। বৃষ্টি যেন স্বল্প পরিসরে তাদের আনন্দ যেন আরও বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট নৌকায় বসে জেলেদের মাছ ধরাও উপভোগ করেন। এভাবেই স্মৃতির মহিমায় আবেগে আপ্লুত করে এদেশের উন্নয়নকে তরাণ্বিত হতে দিয়ে গেছেন সমৃদ্ধির উচ্চতার চাবিকাঠি।

ফ্রান্স বাংলাদেশের সমৃদ্ধির সারথী তার প্রমাণ আবারও দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ। সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় আবারও অংশদারী হতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু চুক্তি করে গেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রায় ১ ঘন্টা ব্যাপী দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। তিনি দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সমঝোতা স্মারকেও সই করেন। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এবং ফ্রান্সের ফ্রান্স ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির (এফডিএ) মধ্যে “ইম্প্রুভিং আরবান গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রোগ্রাম” বিষয়ে একটি ক্রেডিট সুবিধা চুক্তিতে ম্যাক্রোঁ সই করেন। বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানী লিমিটেড (বিএসসিএল) এবং ফ্রান্সের এয়ারবাস ডিফেন্স অ্যান্ড স্পেস এসএএসের মধ্যে বঙ্গবন্ধু-০২ আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম সম্পর্কিত সহযোগিতার বিষয়ে লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই) সই করেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের বানিজ্যিক সুবিধা অব্যাহত রাখার মাধ্যমে রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নে ফ্রান্স বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় ফ্রান্সের ভূমিকা থাকবে বলে জানিয়েছেন। সংঘাত, সহিংসতা ও নৃশংস অপরাধের কারণে বাস্তুচ্যুতদের জন্য জরুরি ও নিরবচ্ছিন্ন মানবিক সেবার জন্য ফ্রান্স অর্থায়ন করবে বলেও জানান। তথ্য-প্রযুক্তি খাতে আরও সহযোগিতারও আশ্বাস দিয়ে গেছেন ফ্রান্সের এই প্রেসিডেন্ট।

এদিকে কৌশলগত সম্পদ ও উন্নত প্রযুক্তিতে ফ্রান্সের সহযোগিতা নতুন ক্ষেত্র খুলে দিবে বলে মনে করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চলমান ভ‚-রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে ফ্রান্স বাংলাদেশের নীতি প্রনয়নের সার্বভৌমত্বকে সম্মান ও সমর্থন জানিয়েছে। বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ের একাধিক সংকট মোকাবেলায় আমাদের অংশীদারত্ব একটি অর্থবহ শক্তি হতে পারে বলে দ্বিপাক্ষিক সম্মেলনে জানান প্রধানমন্ত্রী।

দু-দেশের সম্পর্কের যুগান্তকারী অধ্যায়ের পথকে আরও মসৃন করে খুব স্বল্প পরিসরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরে নতুন এক ইতিহাস রচিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে নতুন দিগন্তের হাতছানি দিয়ে প্যারিসের উদ্দেশ্য সোমবার বিকেল ৪ টার দিকে রওনা হন ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *