বেড়াতে গিয়ে সমুদ্রে নামার আগে সতর্ক থাকবেন যেসব বিষয়ে

বেড়াতে গিয়ে সমুদ্রে নামার আগে সতর্ক থাকবেন যেসব বিষয়ে

লাইফস্টাইল স্পেশাল

নভেম্বর ২২, ২০২৩ ১১:৪২ পূর্বাহ্ণ

সমুদ্রে ভ্রমণ ও সমুদ্রেস্নানের সময় দুর্ঘটনা এড়িয়ে সতর্কতা পালনের মাধ্যমে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনাগুলো এড়ানো যেতে পারে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত বাংলাদেশের জন্য সম্পদ, যা বিশ্ব পরিব্রাজকদের কাছে প্রধান আকর্ষণ। দুর্ঘটনা তাদের কাছে এই সম্পদের ব্যাপারে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি করছে।

আর তাই একদিকে সৈকতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বৃদ্ধি যেমন জরুরি, অন্যদিকে দেশীয় পর্যটকদেরও উচিত নিজের ও অন্যের প্রাণ বাঁচানোর স্বার্থে সমুদ্র ভ্রমণের সময় সতর্ক থাকা।

সমুদ্র ভ্রমণে উত্তাল ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে দেওয়ার অমোঘ টান অনুভূত হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু এই উচ্ছ্বাস অনেক সময় জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সমুদ্র সৈকতে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুহার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। সমুদ্রে স্নানের সময় সতর্ক না থাকা, নির্দেশনা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব এবং সৈকতে যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি এর জন্য দায়ী। তাই চলুন, সমুদ্রস্নানের সময় দুর্ঘটনা এড়িয়ে সতর্ক থাকতে করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।

সমুদ্রে স্নানের সময় দুর্ঘটনা এবং মৃত্যুর কারণ

পর্যটকদের সৈকত নিরাপত্তা নির্দেশনা উপেক্ষা: কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার প্রধান কারণ হচ্ছে নিষেধ সত্ত্বেও পর্যটকদের সমুদ্রের পানিতে নামা। গোসলের জন্য নির্ধারিত জায়গা থাকলেও অনেকে ঝুঁকি নিয়ে আরো গভীরে চলে যান। নিরাপত্তা রক্ষীদের বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের পরেও দর্শনার্থীরা তা উপেক্ষা করেন। সৈকতের প্রতিটি পয়েন্টেই এই বিড়ম্বনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এমনকি বিপজ্জনক সময়গুলোতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার সময়েও কিছু পর্যটকদের সামাল দিতে যেয়ে রীতিমত ঝামেলার সম্মুখীন হন নিরাপত্তা কর্মীরা।

ফলশ্রুতিতে একের পর এক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে চলেছে। এ ছাড়া ভ্রমণের অফ সিজনে নির্জন সৈকতে পানিতে নেমেও দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন অনেকে। এই অসতর্কতা ও নিরাপত্তাজনিত নির্দেশনা অমান্য করাই মূলত দায়ী প্রতি বছর মৃত্যুর ঘটনাগুলোর জন্য।

সৈকত নিরাপত্তা সংকেত সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞানের অভাব: সমুদ্রের মতো বিপজ্জনক জায়গায় আগে থেকেই জোয়ার-ভাটার তথ্যটা সবার জেনে নেওয়া উচিত। সৈকত প্রশাসন প্রতিটি বৈরী আবহাওয়ায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। বিভিন্ন সময়ে সতর্ক সংকেত ও সংখ্যা দিয়ে বিপদের মাত্রা সম্পর্কে অবহিত করা হয় জনসাধারণকে।

কিন্তু সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এই সংকেত বা সংখ্যার অর্থ অনেকেই জানেন না। কোন রঙের পতাকা কী অর্থ বহন করছে সে বিষয়ে অনেকেরই কোনো স্পষ্ট জ্ঞান নেই। সৈকতের কোন কোন প্রবেশদ্বারগুলোতে সমুদ্রস্নানের নির্দেশনা থাকলেও তা একবারের জন্য পড়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেন না কেউ। ফলে অসতর্ক হয়েই সৈকতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন হাজারো দর্শনার্থী।

সমুদ্র সৈকতে নিরাপত্তা ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা: উপরোক্ত দুটি কারণের পাশাপাশি এই কারণটি বিপদের ভয়াবহতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। পর্যটকরা নিজেরা সতর্ক থাকলে বর্তমান নিরাপত্তা ব্যবস্থা দিয়েই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হতো। কিন্তু হাজার হাজার অসতর্ক পর্যটককে সামলানোর জন্য বর্তমান লাইফগার্ড কর্মীর সংখ্যা যথেষ্ট নয়। বিপুলসংখ্যক পর্যটকদের বিপরীতে মাত্র ১১২ জন টুরিস্ট পুলিশকে প্রায়ই হিমশিম খেতে হয়। কক্সবাজার সি সেইফ লাইফ গার্ড সংস্থার তথ্যমতে, প্রতিদিনের দুই শিফটে মাত্র ২৭ কর্মী নিয়োজিত থাকেন।

তাছাড়া সৈকত এলাকায় পর্যাপ্ত নজরদারি ছাড়াও অভাব আছে উদ্ধার সরঞ্জামের। এরকম নাজুক ব্যবস্থায় ক্রমাগত দিন দিন অনিরাপদ হয়ে উঠছে সৈকত।

সমুদ্রেস্নানের সময় কী কী সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার

দুর্ঘটনাপ্রবণ জায়গা ও সময়ের ব্যাপারে আগে থেকেই জেনে রাখা: সমুদ্রস্নান করার জন্য এমন মৌসুমে যাওয়া উচিত যখন সমুদ্র শান্ত থাকে। এরপরেও অন্যান্য মৌসুমে যেতে হলে জোয়ার-ভাটার সময়গুলো ভালোভাবে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে। কক্সবাজারে পৌঁছার পর পরই স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে খোঁজ খবর করে নেওয়া উচিত।

টুরিস্ট গাইড বা হোটেল বা স্থানীয় লোকদের সঙ্গে কথা বলে সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা এবং তার স্পট সম্পর্কে জেনে নেওয়া যেতে পারে। সৈকতে প্রবেশের মুখে উল্লেখিত নির্দেশনাগুলো মনযোগ দিয়ে একবার পড়ে নেওয়া উচিত।

সাধারণত লাবণী পয়েন্ট ছাড়া সৈকতের সুগন্ধা, কলাতলী, ডায়াবেটিস হাসপাতাল পয়েন্ট ও সিগাল পয়েন্টে গোসলে নামা নিষিদ্ধ থাকে। বিকেল ৫টার পর সমুদ্রের পানিতে নামা ঠিক নয়। এছাড়াও সমুদ্রে নামার আগে দিয়ে কর্মরত গার্ডের কাছ থেকে জোয়ার-ভাটাসহ আবহাওয়ার বর্তমান অবস্থাটা জেনে নেওয়া উত্তম। লাইফগার্ড নির্দেশিত স্থানগুলো ছাড়া অন্য কোনো পয়েন্ট থেকে সমুদ্রে গোসল করা ঠিক নয়। এমনকি সেখানে টায়ার বা যে কোন ভাসমান বস্তু নিয়েও পানিতে নামা উচিত হবে না।

সৈকতে বাতাসের গতিবিধি ও পানিতে নামা ঠিক হবে কি হবে না; তা-সহ যেকোনো তথ্যের জন্য লাইফগার্ডরা সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকেন। যেকোনো সময় তাদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তাদের ফোন নাম্বার সংগ্রহ করাটা ভালো।

চিহ্ন এবং পতাকা ব্যাপারে জানা: সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রঙের পতাকা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এগুলো কখন ও কোথায় সমুদ্রের পানিতে যাওয়া নিরাপদ তার নির্দেশনা বহন করে। লাল রঙের পতাকা মানে সমুদ্রের পানিতে নামা যাবে না। এগুলো ভাটার সময় লাগানো হয়। আর সবুজ পতাকার অর্থ এখন আপাতত সমুদ্রে গোসল করা নিরাপদ। এই পতাকা লাগানো হয় জোয়ারের সময় লাইফগার্ড এলাকায়।

হলুদ পতাকা মানে সমুদ্রে ঢেউয়ের মাত্রা ১.৫ মিটার পর্যন্ত উঠতে পারে। তাই পানিতে সাঁতারের সময় অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।

গোসলের স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে সবুজ; সর্বোচ্চ হলুদ পতাকা লাগানো জায়গাগুলোতে থাকতে হবে। কোনো অবস্থাতেই লাল পতাকা লাগানো জায়গা অতিক্রম করা যাবে না।

রিপ কারেন্ট থেকে সাবধান: রিপ কারেন্ট হলো ঢেউয়ের শক্তিশালী অবস্থা যখন তা সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হয়। এই ঢেউ যেকোনো দক্ষ সাঁতারুকেও খড়কুটোর মতো দ্রুত সমুদ্রের গভীরে টেনে নিয়ে যেতে পারে। এ সময় কোনভাবেই সমুদ্রের পানিতে নামা যাবে না। যথাসম্ভব আগে থেকেই গার্ডদের কাছ থেকে রিপ কারেন্টের সময়ের ব্যাপারে জেনে নিতে হবে।

অনেক সময় আচমকাও রিপ কারেন্টের সৃষ্টি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে তীর রেখার সমান্তরালে থেকে তীরের দিকে সাঁতার দিতে হবে। তবে এ সময় সাহায্যের জন্য চিৎকার করাটাই ভালো। তাহলে আশেপাশের লোকজন সাহায্য করার চেষ্টা করতে পারবে।

সমুদ্রের পানিতে নামার সময় টায়ার বা লাইফ জ্যাকেট ব্যবহার করা: খুব ভালো সাঁতারুদেরও সমুদ্রের পানিতে নামার সময় লাইফ জ্যাকেট ব্যবহার করা উচিত। সমুদ্রের আবহাওয়া যেকোনো সময় পরিবর্তন হতে পারে। টায়ার বা লাইফ জ্যাকেট থাকলে এ অবস্থায় বাঁচানোর সুযোগটা থাকে। আর যারা সাঁতার জানেন না, তাদের জন্য সমুদ্রের পানিতে না নামাটাই উত্তম। নিদেনপক্ষে, সমুদ্রের একদম কূল ঘেষে গোসল করা যেতে পারে, তবে সাবধান থাকতে হবে।

চোরাবালি থেকে সাবধান: সমুদ্রে তীব্র স্রোত এবং গুপ্ত গর্ত সৃষ্টি হওয়াটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। জোয়ারের সময় সমতল থাকা জায়গাগুলো ভাটার সময় খাদে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। আর ঘূর্ণিপাকে সৃষ্টি হয় ভয়ঙ্কর চোরাবালির। তাই এগুলো এড়িয়ে চলার জন্য লাইফগার্ডদের সাহায্য নিতে হবে। সবুজ পতাকা চিহ্নিত জায়গায় গোসল করা যেতে পারে। তবে সাবধানতার জন্য দলবদ্ধভাবে থাকা যেতে পারে, যেন কোনো সমস্যা হলেই অন্যরা সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারে।

শিশু ও বয়স্কদের একা হতে দেওয়া যাবে না: সমুদ্রস্নানের ক্ষেত্রে এই দলবদ্ধ থাকাটা খুবই জরুরি। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের কোনভাবেই একা হতে দেওয়া যাবে না। অসুস্থ বা দুর্বল শরীরের লোকদের নিয়ে সমুদ্রে হাঁটুপানির বেশি নামা যাবে না। তরুণদের মধ্যেও এরকম কেউ থাকলে বাকিদের উচিত তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকা।

প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম ও খাবার পানি রাখা: সৈকতে শঙ্খ, ঝিনুক জাতীয় জিনিসে লেগে অনেক সময় পা কেটে যায়। বিশেষ করে ইনানি সৈকতে এরকমটা বেশি দেখা যায়। এই পরিস্থিতির জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম থাকা বাঞ্ছনীয়। আর ক্লান্তি এড়ানোর জন্য সসঙ্গে রাখতে হবে খাবার পানি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *