৭৬ বছরের ইতিহাসে প্রথম, সারা দেশে টানা তাপপ্রবাহের রেকর্ড

৭৬ বছরের ইতিহাসে প্রথম, সারা দেশে টানা তাপপ্রবাহের রেকর্ড

জাতীয় স্লাইড

মে ১, ২০২৪ ১০:১৭ পূর্বাহ্ণ

চলতি বছরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, ব্যাপ্তি ও দীর্ঘ মেয়াদে স্থায়িত্বের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। সিলেট ও চট্টগ্রামের দু-একটি এলাকা ছাড়া সারা দেশের মানুষের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তীব্র দাবদাহ। টানা দাবদাহের এক মাস পূর্ণ হয়েছে গতকাল মঙ্গলবার।

চলমান তাপপ্রবাহে বাতাসে জলীয়বাষ্পের আধিক্য ছিল। এ কারণে মানুষের কষ্ট বেশি হয়েছে। প্রচণ্ড গরম সইতে না পেরে হিট স্ট্রোকে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গতকালও দেশের সাত জেলায় আটজন হিট স্ট্রোকে মারা গেছেন। তাদের বেশিরভাগ রোদে বাইরে কাজ করার সময় অসুস্থ হয়ে মারা যান। এদিন গাজীপুরের কালীগঞ্জে গরমে রেললাইন বাঁকা হয়ে যায়। অল্পের জন্য দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পান কালনী এক্সপ্রেসের যাত্রীরা। এছাড়া প্রচণ্ড গরমের জন্য দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। যদিও আবহাওয়া অধিদপ্তরের আভাস, আজ থেকে গরমের তীব্রতা কিছুটা কমতে পারে। আগামী দু-একদিনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। যত বেশিদিন বৃষ্টি হবে, তাপমাত্রা তত কমতে থাকবে।

আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, এবার টানা ৩০ দিন প্রায় সারা দেশেই তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। যা ৭৬ বছরের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড। অতীতে সারা দেশে এভাবে তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে দেখা যায়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এর আগে ২০১০ সালে ২০ দিন টানা তাপপ্রবাহ ছিল রাজশাহীতে। আর ১৯৯২ সালে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে ৩০ দিন তাপপ্রবাহ ছিল। কিন্তু এবার চট্টগ্রাম ও সিলেটের কিছু অংশ ছাড়া সারা দেশে টানা ৩০ দিন তাপপ্রবাহ ছিল। এপ্রিল মাসে স্বাভাবিক গড় তাপমাত্রার চেয়ে ২-৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। তার মতে, চলতি মৌসুমে বৃষ্টিপাত না থাকায় তাপপ্রবাহের ব্যাপ্তি দীর্ঘকাল ছিল। বৃষ্টি হলে তাপমাত্রা কমে আসবে।

মঙ্গলবার দেশে সর্বোচ্চ ৪৩.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে। এর আগে ১৯৬৪ সালের এপ্রিল মাসে যশোরে ৪৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। ওই হিসাবে ১৯৬৪ সালের পর এই প্রথম সর্বোচ্চ তাপমাত্রা দেখলেন যশোরবাসী। যদিও ২০০৯ সালে যশোরে ৪৩.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল। গতকাল তাপপ্রবাহের তীব্রতার দিক বিবেচনায় দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল চুয়াডাঙ্গা। গত ৩৯ বছরের রেকর্ড ভেঙে চুয়াডাঙ্গায় এ মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চুয়াডাঙ্গায় ১৯৮৫ সালে আবহাওয়া অফিস স্থাপনের পর থেকে এটাই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, যশোর ও চুয়াডাঙ্গা ছাড়াও গতকাল কুষ্টিয়ায় ৪২.৫, পাবনা ৪৩.২, রাজশাহী ৪৩, বাগেরহাট ৪২.৩ ও সাতক্ষীরায় ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল। অর্থাৎ এসব জেলার ওপর দিয়ে অতি তীব্র দাবদাহ বয়ে গেছে। আর টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুর ও খুলনা জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ ছিল। দেশের অন্য জেলাগুলোতে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ ছিল।

আবহাওয়া অধিদপ্তর আরও জানিয়েছে, আগামী বৃহস্পতিবার থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাপমাত্রা কমার আভাস রয়েছে। এ কারণে সারা দেশে না হয়ে অঞ্চলভেদে জারি হবে নতুন হিট অ্যালার্ট।

আবহাওয়াবিদরা জানান, ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ ৪৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার রেকর্ড রয়েছে। এবার তাপমাত্রা পারদ ওই পর্যন্ত পৌঁছেনি। তবে চলতি বছরে তাপপ্রবাহের স্থায়িত্বকাল অনেক বেশি। এ কারণে মানুষের কষ্টের তীব্রতাও বেশি। এই সময়ে থেমে থেমে বৃষ্টি হলে মানুষের এত কষ্ট হতো না। টানা তাপপ্রবাহের কারণে সারা দেশেই মানুষের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। হিট স্ট্রোকে মানুষের মৃত্যু বেড়েছে।

তাপমাত্রা আজ থেকে কমার আভাস: গতকাল সন্ধ্যা ৬টার পূর্বাভাসে আজ বুধবার দিনে কিছু কিছু জায়গায় তাপপ্রবাহ কমতে পারে। সারা দেশে তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে। দেশের পূর্বাঞ্চলে রাতের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে।

সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের কিছু এলাকায় ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাশাপাশি ঢাকা ও বরিশাল বিভাগের দু-এক জায়গায় ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি হতে পারে। এতে বিরাজমান তাপপ্রবাহের তীব্রতা কমে আসতে পারে। দেশের পূর্বাঞ্চলে দিনের তাপমাত্রা ১-২ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমতে পারে। পরের পাঁচ দিনে সারা দেশে বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

হিট স্ট্রোকে মৃত্যু

মুন্সীগঞ্জে মঙ্গলবার হিট স্ট্রোকে ওমর আলী (৬৫) ও আব্দুল বাতেন মাঝি (৬৮) নামের দুই বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মরদেহে হিট স্ট্রোকের উপসর্গ ছিল বলে জানিয়েছেন মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আবু হেনা মোহাম্মদ জামাল। জানা গেছে, ওমর আলী মাঠে কাজ করার সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আর আব্দুল বাতেন মাঝি ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে অসুস্থ হয়ে মারা যান। একইদিন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার চর তারাবাড়িয়া মাঠে ধান কাটার সময়ে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন জিল্লুর রহমান (৩৫) নামের একজন কৃষক। তিনি চর তারাবাড়িয়া গ্রামের লুৎফর রহমানের ছেলে। সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।

এছাড়া সাতক্ষীরার নবারুণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারুক হোসেন গতকাল চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।

সোমবার তিনি নিজ কর্মস্থলে অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথম তাকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে খুলনা সিটি মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. কাজী আরিফ তাকে দেখার পর অতিরিক্ত গরমের কারণে হিট স্ট্রোক হয়েছে বলে ধারণা করেন। পরে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য খুলনায় পাঠানো হয়।

নাটোরের নলডাঙ্গায় তীব্র দাবদাহে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে খায়রুল ইসলাম (৩৯) নামে এক সৌদি প্রবাসীর মৃত্যু হয়েছে। দুই কন্যার জনক খায়রুল ইসলাম কিছুদিন আগে সৌদি আরব থেকে ছুটিতে দেশে আসেন। মঙ্গলবার নিজের ভুট্টার জমিতে শ্রমিকরা কাজ করার সময় তিনি নিজেও গিয়ে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন। একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে চিকিৎসকের কাছে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।

টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে হিট স্ট্রোকে মুনছের আলী (৯০) নামের একজন মারা গেছেন। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উপজেলা নারান্দিয়া ইউনিয়নের তালতলা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। কালিহাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজহারুল ইসলাম তালুকদার জানান, মুনছের আলী নারান্দিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলেন। তিনি সকালে বাড়ি থেকে বাজার করতে সিঙ্গুরিয়া বাজারে যান। বাজার থেকে হেঁটে বাড়িতে এসে হিট স্ট্রোকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে বেলা সাড়ে ১১টায় বাড়িতেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

এছাড়া মঙ্গলবার দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে হিট স্ট্রোকে রহিমা বেগম (৪৭) নামের এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। ঘোড়াঘাট থানার ওসি আসাদুজ্জামান আসাদ তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার জালালাবাদ ইউনিয়নে মনির উদ্দিন নামের এক যুবক মারা গেছেন।

কালীগঞ্জে বেঁকে গেছে রেললাইন : কালীগঞ্জ (গাজীপুর) প্রতিনিধি জানান, প্রচণ্ড গরমে কালীগঞ্জের আড়িখোলার দুই কিলোমিটার দূরে কাজিবাড়ীসংলগ্ন এলাকায় ৪০ ফিট রেললাইন বেঁকে যায়। ওয়েম্যানদের সতর্কতার কারণে সিলেট থেকে ছেড়ে আসা কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রীরা দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পান।

কর্তব্যরত ওয়েম্যান রাজু লাল সাহা জানান, প্রতিদিনের মতো আমরা রেললাইনে কাজ করছিলাম। আনুমানিক ১২টার দিকে সিলেট থেকে ছেড়ে আসা কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনটি যাত্রী নিয়ে আড়িখোলা স্টেশনে পৌঁছায়। এ সময় কাজীবাড়িসংলগ্ন রেললাইনটি প্রচণ্ড দাবদাহে প্রায় ৪০ ফুট সাপের মতো আঁকাবাঁকা হয়ে যায়। তাৎক্ষণিক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করলে দ্রুত ট্রেনটি গ্রিন সিগন্যাল তুলে ইমার্জেন্সি সংকেত দিয়ে থামানো হয়। ফলে প্রাণে বেঁচে যায় যাত্রীরা। ২ ঘণ্টা ট্রেনটি থামানো অবস্থায় রেললাইনে ডোবা থেকে পানি ছিটিয়ে ঠান্ডা করে এবং লাইনের কাজ সম্পন্ন করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে ট্রেন চলাচলে সক্ষম হয়।

সিলেটে স্বস্তির বৃষ্টি: সিলেট ব্যুরো জানায়, মঙ্গলবার বিকাল সোয়া ৫টায় শুরু হওয়া বৃষ্টি কিছুক্ষণ থেমে ফের শুরু হয় সন্ধ্যায়। বৃষ্টি চলে রাত ৮টা পর্যন্ত। এতে তীব্র গরমে অতিষ্ঠ মানুষ ফিরে পেয়েছে শান্তি। সিলেট আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজিব হোসাইন বলেন, মঙ্গলবার বিকালে ৬ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সিলেট অঞ্চলে এমন বৃষ্টি আরও হতে পারে। আবহাওয়া অফিস জানায়, সিলেট অঞ্চলে বৃষ্টির পাশাপাশি ঝড়ও হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *