সিনেমা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পার্শ্ব অভিনেতা-অভিনেত্রীরা

সিনেমা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পার্শ্ব অভিনেতা-অভিনেত্রীরা

বিনোদন স্পেশাল

মার্চ ১৪, ২০২৪ ৬:২৪ পূর্বাহ্ণ

দেশের সিনেমায় একাধিক নায়ক-নায়িকার সমাবেশ খুব কমই দেখা গেছে। অধিকাংশ সিনেমাতেই একজোড়া নায়ক-নায়িকা দেখা যায়। তবে ঢালিউডের সিনেমার সোনালী দিনে অনেক সিনেমাতেই একাধিক নায়ক-নায়িকা এবং একাধিক খল চরিত্রের অভিনেতা অভিনেত্রী দেখা গেছে। বর্তমানে একাধিক নায়ক-নায়িকা আর একাধিক খল অভিনেতা-অভিনেত্রী তো দূরের কথা একাধিক পার্শ্বচরিত্র রাখতেই হিমশিম খাচ্ছে। এর মূল কারণই বাজেট। নির্মাতারা বাজেটের সঙ্গে অনেক ধস্তাধস্তি করেও যখন হার মানছে গল্পকে টেনে টেনে নেওয়ার জন্য একাধিক পার্শ্বচরিত্র গ্রহণে তখন তারা এক নায়ক-নায়িকা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। আর এ কারণেই যারা পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করবেন তাদের এখন খুবই দুর্দিন যাচ্ছে। বলতে গেলে বর্তমানে তারা কাজহীন অবস্থাতেই দিন পার করছেন। এফডিসিতেও তাদের আর আগের মতো বিচরণ করতে দেখা যায় না। দেখা যায় শুধু একবারই যখন শিল্পী সমিতির নির্বাচন তাদের দ্বারে দ্বারে কড়া নাড়ে।

একটা সময়ে মিডিয়ায় পার্শ্বচরিত্রগুলো নিয়েও আলোচনা পর্যালোচনা দেখা যেত। বর্তমানে মিডিয়াও আর তাদের নিয়ে খুব একটা আলোকপাত করে না। বর্তমানে সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করা শিল্পীকে নিয়েই একচেটিয়া আলোচনা বা সমালোচনা হয়। তবে পর্দায় কেন্দ্রীয় চরিত্রের কদর আগেও যেমন ছিল এখনো আছে। তবে এখন সেই মুখ্য চরিত্রটিকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে যেসব পার্শ্বচরিত্রগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করত তাদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কমে গেছে। অথচ এমন কিছু অভিনয়শিল্পী আছেন, যাদের অভিনয়গুণ অনেক সময় গল্পের প্রধান চরিত্রকেও ছাপিয়ে যায়। প্রতিটি সফল সিনেমার পেছনে তাদের ভূমিকা মুখ্য চরিত্রের থেকেও কম কিছু নয়।

বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’। এতে নানা চরিত্রের উপস্থাপনায় চলচ্চিত্রটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। যেমন এ ছবিতে ডাকাত চরিত্রে ইনাম আহমেদের দুর্দান্ত অভিনয় এখনো দর্শক মনে শিহরণ জাগায়। এরা ছিল পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতা। কিন্তু তাদের অভিনয়ে দক্ষতা দিয়ে দর্শকদের নজর কেড়ে নিয়েছিল। দর্শক তাদেরকে মনে রাখবে বহু বছর। তারা তাদের অভিনয়ের মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন দর্শকদের হৃদয়ের মাঝে। একটা সময়ে আমাদের বাংলা সিনেমার গল্প গড়ে উঠত নানা-নানি, দাদা-দাদি, মা-বাবা, ভাই-বোন, প্রেমিক-প্রেমিকা, কাজের লোক, খলনায়ক, আত্মীয়-স্বজনসহ পূর্ণাঙ্গ আবহ। এমন পরিপূর্ণ চরিত্র আর গল্পে নিয়ে নির্মিত হতো চলচ্চিত্র। এতে দর্শক কোনো না কোনো ভাবে নিজেদের পারিপার্শ্বিকতার চিত্র খুঁজে পেয়ে আহ্লাদে ছবিটি উপভোগ করতেন। এ কারণেই ৬০ থেকে আশির দশকের চলচ্চিত্রের ছিল সোনালী সময়।

যা এখন নেই বললেই চলে। পার্শ্বচরিত্রের ক্ষেত্রে প্রথমেই বাবা-মায়ের কথা বলতে হয়। একটা সময় সিনেমার চিত্রনাট্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বাবা-মায়ের চরিত্র। যেখানে পরিবারের প্রধানকর্তা হিসেবে বাবার চরিত্রের রূপ ছিল একরকম আর মায়ের চরিত্র ছিল আরেক রকম। এক্ষেত্রে আমরা দেখেছি পর্দায় দাপুটে বাবার চরিত্রে অভিনয় করা ফতেহ লোহানী, খলিল, গোলাম মুস্তাফা শওকত আকবর, নারায়ণ চক্রবর্তী প্রমুখকে কী দাপুটে সংলাপের সঙ্গে অভিনয় করতে। আবার আদর্শবাদী বাবার ভূমিকায় মানানসই ছিলেন খান আতা আনোয়ার হোসেন, প্রবীর মিত্র, রাজ্জাক, আলমগীর প্রমুখ। বাবার মতো মায়ের চরিত্রও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কখনো কখনো নায়ক-নায়িকাকে ছাপিয়ে ‘মা’ হয়ে যেতেন গল্পের মধ্যমণি। অনেকে মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন। পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সম্মান। দরিদ্র- খ্যাপাটে, মায়ের চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন রানী সরকার, মায়া হাজারিকা প্রমুখ। তেমনি সাদাসিধা মধ্যবিত্ত পরিবারের শহুরে মা কিংবা গ্রামের মায়ের ভূমিকায় শর্মিলী আহমেদ, রোজী সামান, মিনু রহমানের অভিনয় ছিল অনবদ্য।

এখন আর আগের মতো সেই পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করা অনবদ্য সংলাপের ফুলবুরি দেখা যায় না। বাবা-মায়ের চরিত্রে অভিনয় করে কেউই আর নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করতে পারছে না। কারণ সেরকম চরিত্র নিয়ে সিনেমা না হওয়া। যা কিছু পার্শ্বচরিত্র থাকছে তাতেও গুরুত্ব থাকছে খুবই কম। যতটা সময়জুড়ে তাদের সংলাপ থাকলে চরিত্রটির গুরুত্ব থাকে এই চরিত্রগুলো ততটা গুরুত্বের সঙ্গে আনতে দেখা যাচ্ছে না। তাদের সংলাপ কম থাকে। পর্দায় তাদের উপস্থিতি কম দেখা যায়। যার ফলে অভিনেতারা নিজের অভিনয়ের প্রতিভা প্রকাশ করতে পারে না। তাই গুরুত্বের বিচারে চলচ্চিত্র থেকে পার্শ্ব অভিনেতারা অনেকটাই হারিয়ে যাচ্ছেন।

আলী রাজ একসময় নায়ক চরিত্রে অভিনয় করতেন। বর্তমানে তিনি পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করছেন। এছাড়া রেবেকা রউফ, খালেদা আক্তার কল্পনা, ডলি জহুর, বড়দা মিঠু, মানস বন্দ্যোপাধ্যায়, আজিজুল হাকিম, কাজী হায়াৎ প্রমুখ পাশ্চরিত্রে নিয়মিত হলেও তারা সেরকমভাবে প্রখ্যাত হতে পারেননি। যেমন হয়েছেন আনোয়ার হোসেন, প্রবীর মিত্র, নারায়ণ চক্রবর্তী, রোজী সামাদ, আনোয়ারা প্রমুখ।

একটি সিনেমায় পাক্ষরিত্র তো শুধু বাবা-মায়েই সীমাবদ্ধ নয়। পার্শ্বচরিত্র হিসেবে এক সময় কমেডি অভিনেতাদেরও দাপট ছিল দেখার মতো। যেমন দেখা গেছে খান জয়নুল, হাসমত, টেলি সামাদ, মতি, দিলদার, আফজাল শরীফ, রতনদের। অভিনয় দিয়ে তারা দর্শককে বিনোদন দিয়ে গেছেন। তারাও ছিলেন ডাকসাইটে তারকাশিল্পী। টেলিসামাদ, দিলদারের মৃত্যুর পরে আফজাল শরীফও এখন অনিয়মিত। এখন যারা সিনেমা বানান তারা নাম কাওয়াস্তেই যেন সিনেমা বানান। এখন একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা আর একজন খলনায়ক ও আইটেম গান থাকলেই ছবি হয়ে যায়। চলচ্চিত্রে আরেক ধরনের শিল্পী আছে যাদেরকে বলা হয় এক্সট্রা শিল্পী। তাদের তো অবমূল্যায়ন শুরু হয়েছে আরো বহু আগে থেকেই। এখন যতটুকু ভালো আছেন নায়ক-নায়িকারাই। বাকিরা সবই যেন একটি সিনেমা করার পরই টিস্যু পেপারের মতো বাতিল হয়ে যান। সময়টাও ভালো যাচ্ছে না। কাজ কমে গেছে। ফলে পার্শ্বচরিত্র বা এক্সটা শিল্পীদের দুর্দিন এখন চরমে। এফডিসির আমতলায় প্রায় প্রতিদিনই অলস সময় কাটে তাদের। এফডিসিতে প্রবেশের পর এমনই দৃশ্য চোখে পড়ে। এক সময় পার্শ্ব বা এক্সটা চরিত্রে অভিনয় করা শিল্পীরাও ব্যস্ত থাকতেন।

এক্সটা চরিত্রে অভিনয় করা শিল্পী হালিমা খাতুন বলেন, ৩৭ বছর ধরে চলচ্চিত্রে অভিনয় করতেছি। আগে তো ভালোই কাজ হইছে। কিন্তু এখন সারা দিন ঘুইরাও কাজ পাই না। মাঝে মধ্যে দাদি, নানি চরিত্রের জন্য ডাক পাই। তবে অনেকদিন ধরেই কোনো কাজ পাচ্ছি না। আগের পরিচালকরাও নেই, প্রযোজকরাও নেই। নতুন পরিচালকরাও আমাদের চিনে না। তাদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় নেই। তাই আমাদের হাতে এখন আগের মতো কাজ আসে না।

আরেক এক্সট্রা শিল্পী শাহনাজ তাদের মধ্যে একজন। অনেক ব্যবসা সফল ছবিত্রে অভিনয় করেছেন। অনেক ছবিতে নায়িকা শাবনূর, পূর্ণিমা, পপির বান্ধবীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন। বর্তমানে তার হাতেও কোনো কাজ নেই। আগের মতো কেউ আর কাজে ডাকে না। তিনিও বেকার বসে আছেন। তিনি বলেন, একটি ছবিতে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অভিনয় করলে বেশকিছু টাকা আয় হতো। আর নাচে কাজ করে দুই হাজার টাকা পর্যন্তও দিনে পেয়েছি। এখন তো কাজ বুইঝ্যা টাকা দেয়। অনেকদিন ধরে তো কোনো কাজই পাচ্ছি না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *