যে কারণে দুর্বল ব্যাংক সাথে নিতে রাজি হচ্ছে ভালো ব্যাংক

যে কারণে দুর্বল ব্যাংক সাথে নিতে রাজি হচ্ছে ভালো ব্যাংক

অর্থনীতি স্লাইড

এপ্রিল ১০, ২০২৪ ১০:১৫ পূর্বাহ্ণ

দেশের ব্যাংকিং খাত সংস্কারের লক্ষ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সাথে একীভূত করার প্রক্রিয়া চলছে। এক্সিম ও পদ্মা’র পর এবার সেই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভূক্ত হতে যাচ্ছে আরো ছয়টি ব্যাংক।

সোমবার (৮ এপ্রিল) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা।

রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সোনালী ব্যাংকের সাথে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে একীভূত করার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তের খবর এসেছে স্থানীয় গণমাধ্যমে। বেসরকারি দ্য সিটি ব্যাংকের সাথে একীভূত হওয়ার আলোচনায় আছে সরকারি বেসিক ব্যাংকও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা আশা করছেন,এর মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকগুলোর ভঙ্গুর অবস্থা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।

কিন্তু যেসব ভালো ব্যাংকের সাথে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করা হচ্ছে, তা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন একজন অর্থনীতিবিদ। যদিও ব্যাংকাররা তা অস্বীকার করেছেন।

তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, দুর্বল একটি ব্যাংককে সঙ্গে নিয়ে সবল ব্যাংকের লাভ কী হবে? ভালো ব্যাংক কী সুবিধা পাবে?

দুর্বল ব্যাংকগুলোর সংকট কাটিয়ে তোলার পদক্ষেপের অংশ হিসেবে গত বছর একটি ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন বা পিসিএ নামক ওই ফ্রেমওয়ার্কের ওপর ভিত্তি করেই এ বছরের শুরু থেকে ব্যাংক একত্রীকরণের তোড়জোড় দেখা যায়।

গত সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে ব্যাংক-কোম্পানি একত্রীকরণের একটি নীতিমালাও প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সবল ব্যাংকগুলোকে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে নীতি সহায়তা দেয়ার কথা বলা হয়েছে নতুন নীতিমালায়।

এতে বলা হয়েছে, ‘ভালো ব্যাংকটি দুর্বল ব্যাংকের কার্যক্রম তথা আমানত, গ্রাহক, শাখার নেটওয়ার্ক,অপারেশন,কৌশল, গবেষণা ও আধুনিক প্রযুক্তি ও একই কারিগরি সিস্টেম এবং ব্যবস্থাপনার আরো ভালোভাবে ব্যবহার করে সাশ্রয়ী ব্যয়ে আরো বড়, দক্ষ ও শক্তিশালী হওয়ার কারণে দুই ব্যাংকেরই লাভবান হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলছেন, এই নীতি সহায়তাকে কাজে লাগিয়ে দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একত্রীকরণ থেকে লাভবান হতে পারবে দুর্বলদের দায়িত্ব নেয়া ব্যাংকগুলো।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ছয় ধরনের নীতি সহায়তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

এর অন্যতম ‘ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ, সিআরআর বা ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও, এসএলআর বা স্ট্যাচুটরি লিকুইডিটি রেশিও, এলসিআর বা লিকুইডিটি রেশিও সংরক্ষণে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট অংশ অব্যাহতি প্রদান।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘এতে ঋণ দেয়া বা লগ্নি করার জন্য বাড়তি অর্থের যোগান পাবে ব্যাংক। এর মুনাফা দিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে তারা।’

তিনি উদাহরণ টানেন, ‘ধরা যাক, কোনো ব্যাংক এসএলআরে অতিরিক্ত পাঁচ শতাংশ অব্যাহতি পেল। তাদের ঋণ দেয়ার সামর্থ্য তাহলে পাঁচ শতাংশ বেড়ে যাবে।’

‘অর্থাৎ, ৫০ হাজার কোটি টাকার ঋণপ্রদানের সক্ষমতা থাকলে তা বেড়ে আরো আড়াই হাজার কোটি টাকা বেশি ঋণ দেয়ার সক্ষমতা হবে ব্যাংকটির,’ যোগ করেন তিনি।

নীতিমালায় আরো বলা হয়, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তারল্য সুবিধা পাবে ব্যাংকগুলো।

ব্যাংক কোম্পানী আইন ও বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার অনুযায়ী অন্যান্য সহায়তা দেয়ার কথাও বলা হয়েছে এতে।

কিন্তু, এসব সুবিধার বিপরীতে খারাপ ব্যাংকের দায় নিয়ে ক্ষতি পোষানো ভালো ব্যাংকের জন্য চ্যালেঞ্জের হবে বলে মনে করেন, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

নীতিমালায় বলা হয়েছে, অধিকৃত ব্যাংকের কর্মচারীদের তিন বছরের মধ্যে চাকরিচ্যুত করা যাবে না।

মনসুরের মতে, এতে ভালো ব্যাংকগুলোর চাপ বাড়বে।

আগ্রহের কারণ কী?

শুরু থেকেই উদ্যোক্তাদের আশাবাদ ছিল যে, নিশ্চয়ই তারা সরকারের তরফে কোনও না কোনও সুবিধা পাবেন।

ব্যাংক একীভূত করার আলোচনা শুরুর পর দোসরা ফেব্রুয়ারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান যেমন বলেছিলেন, ‘একীভূত করা নিয়ে ভালো ব্যাংকের অবজারভেশন আপাতত এটাই, হোয়াট ইজ দেয়ার ফর আস?’

তাহলে, নীতিমালা ঘোষণার পর ব্যাংকাররা কী ভাবছেন?

বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের অন্যতম আর্থিক প্রতিষ্ঠান দ্য সিটি ব্যাংক।

স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে যে, সিটি ব্যাংকের সাথে দীর্ঘদিন ধরে সংকটে থাকা বেসিক ব্যাংক একীভূত করা হবে।

যদিও, এখনো সিটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে কোনো নির্দিষ্ট ব্যাংকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়নি। দুই-তিনটি ব্যাংক নিয়ে পর্যালোচনা চলছে বলে জানিয়েছেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন।

বেসিক ব্যাংকের ৭২ টি শাখা ও ৩৬ টি উপশাখা রয়েছে।

আরেফিন বলছেন, এতগুলো শাখাসহ কোনো ব্যাংক যুক্ত হলে স্বাভাবিকভাবেই ‘নেটওয়ার্কটা আরো বড় হবে’।

অপর ব্যাংকের নিয়মিত গ্রাহকরাও তাদের তালিকায় যুক্ত হয়ে যাবেন।

তিনি জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সহায়তার পাশাপাশি সরকারের আর্থিক সহায়তাসহ করের ক্ষেত্রেও কিছু সুবিধার আশ্বাস পেয়েছেন তারা। যা তাদেরকে উৎসাহিত করেছে।

‘সরাসরি মার্জ হবে না। আগে দুর্বল ব্যাংককে পুনর্গঠন করা হবে তারপর একত্রীকরণ করা হবে।’

তিন থেকে পাঁচ বছর ধরে ‘রি-স্ট্রাকচারিং’ চলবে বলে জানান তিনি।

‘পারফরম্যান্স ম্যানেজমেন্টের মধ্য জনবল ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হবে। কে না চাইবে একটা ভালো ক্যারিয়ার গড়তে?’ প্রশ্ন রাখেন তিনি।

দ্য সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দাবি, সরকারের সহায়তা এবং তাদের অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে অপেক্ষাকৃত খারাপ একটা ব্যাংককে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে।

ব্যাংক একীভূতকরণের এই প্রথমে এক্সিম ব্যাংকের সাথে পদ্মা ব্যাংকের একীভূত করার ঘোষণা আসে। তখন দেখা গেছে, পদ্মা ব্যাংকের যে ৬০-৭০টি শাখা আছে সেগুলো পরিচালনা করার জন্যও এক্সিম ব্যাংকের জনবলের দরকার হবে।

সে কারণে তারা নতুন করে কোন জনবল নিয়োগ করতে চায় না। বরং বর্তমানে থাকা পদ্মা ব্যাংকের জনবল দিয়েই সেগুলো পরিচালনা করতে চায় বলে জানিয়েছিলেন এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার।

তবে অর্থনীতিবিদরা প্রশ্ন তুলেছেন, দুর্বল ব্যাংকের সম্পদ, খারাপ ঋণ ও দায়ের কী হবে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. হাসিনা শেখ বলেন, ‘সম্পদের বণ্টন কীভাবে হয় এবং ল্যায়াবিলিটিটা অনেক বড় ইস্যু হয়ে যাবে এখানে। একটা ভাল ব্যাংক ল্যায়াবিলিটির কতটা শেয়ার করবে?ব্যাড লোনের একটা বড় ইস্যু আছে। তার চেয়েও অনেক বড় ইস্যু আছে মার্কেট রেপুটেশন,কাস্টমারের ট্রাস্ট,কাস্টমারের কনফিডেন্স এগুলো বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে।’

তবে সরকারের সহায়তা পেলে এ সবই নিজেদের দক্ষতায় উতরে যেতে পারবেন বলে দাবি, মাসরুর আরেফিনের।

২০০৭ সালের দিকে সিটি ব্যাংক নিজেই একটি দুর্বল ব্যাংক ছিলো বলে জানান আরেফিন।

তিনি বলেন, সেই জায়গা থেকে অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে নিয়ে এসেছেন তারা।

‘এই অভিজ্ঞতা একীভূত হওয়া ব্যাংকের ক্ষেত্রে কাজে লাগবে।’

সাবেক ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ নুরুল আমিন পদ্মা ও এক্সিম ব্যাংক একীভূতকরণের প্রথম উদ্যোগের সময় বলেছিলেন,’লাভের হিসেব করলে বলা যায়,ব্যবস্থাপনার দিক থেকে কিছুটা ব্যয় কমবে। শাখার সংখ্যা বাড়লে ব্যবসার পরিধি বাড়বে। কিন্তু খারাপ ঋণের বিষয়টি এখান থেকে বাদ দিতে হবে আগে।’

তবে সব মিলিয়ে লাভের পরিমাণটাই বেশি হবে বলে মনে করেন তিনি।

স্বেচ্ছায় একীভূতকরণ?

নীতিমালায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনক্রমে এবং মধ্যস্থতায় কোনো ব্যাংক-কোম্পানি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একীভূত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।

কিন্তু অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, স্বেচ্ছায় একীভূতকরণের কথা বলা হলেও এখানে কর্তৃপক্ষের তরফে প্রচ্ছন্ন চাপ ছিলো। অন্তত ভালো ব্যাংকগুলোর প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণে তার তেমনই মনে হয়েছে।

‘সবল ব্যাংকগুলোর উৎসাহটা দেখিনি। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে নিরপেক্ষ অডিট করে তাদের প্রকৃত আর্থিক চিত্র তুলে ধরা দরকার। যা এখনো করা হয়নি।’

‘নইলে, ভালো ব্যাংকের জন্য ইট’স আ লস,’ যোগ করেন তিনি।

অন্যদিকে সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন এমন ধারণাকে নিছকই ‘নেতিবাচক মানসিকতা’ উল্লেখ নাকচ করছেন।

‘সরকারের পক্ষ থেকে শুধুই সাজেশন ছিল, বাকি ডিসিশন আমাদেরই’, তিনি বলেন।

তারা অন্তত কোনো রকম বাধ্যবাধকতার শিকার হননি বলেও তিনি জানান।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *