বাজেটে পলিথিনের ভূত ও ভয়ানক দুঃসংবাদ!

ফিচার স্পেশাল

জুলাই ৭, ২০২২ ১:০২ অপরাহ্ণ

মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান (শাশ্বত মনির)

দখল-দূষণ ও নানা অব্যবস্থাপনায় আমাদের পরিবেশ বিপর্যস্ত, মৃতপ্রায়। খালবিল দূষিত, মরতে বসেছে নদীগুলো। এর অন্যতম কারণ নিষিদ্ধ পলিথিনের ইচ্ছামতো ব্যবহার। পলিথিনের বিকল্প ব্যবহারের জন্য যখন আমরা উদগ্রীব, চিন্তা করছি পাটজাত পণ্যের বহুমুখি ব্যবহারের। ঠিক সেই সময়েই নিষিদ্ধ পলিথিনকে আরও উৎসাহিত করার প্রয়াস দেখা গেল এবারের বাজেটে। এ যেন মৃত পরিবেশের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া।

এবারের বাজেট উপলক্ষে গণমাধ্যমকর্মীদের মাঝে সুদর্শন পাটের ব্যাগে বাজেট বিষয়ক বেশকিছু বই ও নথি সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু সেই পাটের ব্যাগের ভেতরেই লুকিয়ে ছিল ‘পলিথিনের ভূত’ ও পরিবেশের জন্য ভয়ানক এক দুঃসংবাদ। বাজেট প্রস্তাবে সব ধরনের পলিব্যাগ, প্লাস্টিক ব্যাগ (ওভেন প্লাস্টিক ব্যাগসহ) ও মোড়ক সামগ্রীর ওপর গত অর্থবছরে যে ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল, তা এবার প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এতে দেশে পলিথিন ব্যাগের দাম কমবে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে বাড়বে পলিথিনের ব্যবহার ও পরিবেশ দূষণ।

বাংলাদেশে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে পলিথিনের ব্যবহার শুরু হয় ১৯৮২ সালে। পরিবেশের বিপদ উপলব্ধি করে বিশ বছর পর ২০০২ সালে আইনের মাধ্যমে পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। এর বিশ বছর পর সেই নিষিদ্ধ পলিথিনের জন্য শুল্ক ছাড়ের প্রস্তাব বয়ে আনবে ভয়াবহ বিপদ।

আমাদের প্রতিবেশী দেশ বিপদ আঁচ করতে পেরে এরইমধ্যে পলিথিন নিষিদ্ধের ঘোষণা দিয়েছে। রুয়ান্ডা ২০০৮ সালে প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছে, ক্যালিফোর্নিয়া ২০১৪ সালে, কেনিয়া ২০১৭ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ২০২০ সালে, থাইল্যান্ড ২০২০ সালে পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মনে সদিচ্ছা জাগছে- অথচ আমরা তার উল্টোপথে হাঁটছি। আমরা গোটা বাংলাদেশকে বানাতে চাইছি বিশ্বের অন্যতম ওয়াস্ট হাবে। দেশকে বানাতে চাইছি পলিথিনের বৃহত্তর ডাস্টবিন।

গত বছর বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দশম স্থানে রয়েছে। ২০০৫ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে এর ব্যবহার তিন গুণের বেশি বেড়েছে। ঢাকায় একবার ব্যবহারের পর এগুলোর ৮০ শতাংশ মাটিতে ফেলা হচ্ছে। নদীর মাধ্যমে সাগরে প্রবাহিত প্লাস্টিক ও পলিথিন-দূষণে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। দেশে বছরে ১৭ হাজার টন পাতলা প্লাস্টিক ও পলিথিন মাটিতে পড়ছে। এ সব প্লাস্টিক ও পলিথিনের ৭৩ শতাংশ মিশে যাচ্ছে মাটি ও পানিতে।

পলিথিন নিষিদ্ধ করতে আইন থাকলেও তার উপযুক্ত প্রয়োগ নেই। বাজার-ঘাটে দৈনন্দিন পর্যায়ে পলিথিন সহজলভ্য হওয়ায় এর ব্যবহার বাড়ছে এটি নিদারুণ বাস্তবতা। আইনকে তোয়াক্কা না করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে পলিথিন কারখানা। যার সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। অধিকাংশ কারখানা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। ঢাকার পলিথিন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে একাধিক প্রভাবশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। ‘জরুরি রপ্তানি কাজে নিয়োজিত’ লেখা ট্রাকে করে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন। এগুলো দেখেও না দেখার ভান করছি। ফলে বোঝা যাচ্ছে- আমাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও অঙ্গীকারের বড্ড অভাব।

পলিথিন ও প্লাস্টিকখাতে সম্পূরক শুল্ক হার কমানোয় হয়ত ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন। কিন্তু এর বিপরীতে বিস্তার ঘটবে পলিথিনের। আমরা কি একবার ভেবেছি এই পলিথিনের ব্যবহার সামনের দিনগুলোতে আরও কত মারাত্মক হতে পারে? যে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেই নিষিদ্ধ জিনিসে শুল্ক কমানো কি ভালো ফল বয়ে আনবে?

টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠায় স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদি সহ চারটি ধাপে অ্যাকশন প্ল্যান হাতে নিয়েছে সরকার। অ্যাকশন প্ল্যান অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ ভাগ পলিথিন রিসাইক্লিং হওয়ার করা, ২০২৬ সালের মধ্যে পলিথিনের ব্যবহার ৯০ ভাগ কমিয়ে আনা হবে। ২০৩০ সালে প্লাস্টিক পণ্যের উৎপাদন কমিয়ে আনা হবে ৩০ ভাগ। এরকম অ্যাকশন প্ল্যান যখন হাতে তখন বাজেটে এমন প্রস্তাব অনাকাঙি্ক্ষত, দুঃখজনক।

পরিবেশ আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, নিষিদ্ধ পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। কিন্তু সেই আইনের শতভাগ বাস্তবায়ন নেই মাঠ পর্যায়ে। বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) সমীক্ষা অনুযায়ী- রাজধানী ঢাকায় ব্যবহৃত পলিথিন ব্যাগ থেকে উৎপাদিত মোট বর্জ্য প্রায় পাঁচ হাজার ৯৯৬ টন। সারাদেশে এটি প্রায় ৭৮ হাজার ৪৩৩ টন। আর অবৈধ পলিথিন ব্যাগের দৈনিক উৎপাদন ৫০ লাখ।

দেশে যে সব পলিথিন ব্যবহার করা হচ্ছে তার অধিকাংশ আঘাত হানছে ড্রেনেজ ব্যবস্থায়, পলিথিনগুলো ভেসে যাচ্ছে নদীতে। ঢাকার বুড়িগঙ্গাসহ আশেপাশের সব নদী দূষণে মরণাপন্ন। বুড়িগঙ্গার তলদেশে জমা ৬-১০ ফুট পলিথিনের স্তর। ঢাকার খালগুলো মরে যাওয়ার জন্যও অনেকাংশে দায়ী পলিথিন। পলিথিনকে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যতে সুয়্যারেজ লাইন বন্ধ হয়ে যাবে, নদী মরে যাবে, প্রাণিজ সম্পদ ধ্বংস হওয়ার মাধ্যমে পরিবেশের মহাবিপর্যয় ঘটবে।

বর্তমানে পলিথিনের পাশাপাশি ওয়ানটাইম বোতল, প্লেট, চামচ, কাপ সামগ্রী ব্যবহারে মানুষ ঝুঁকে গেছে। এ থেকে আমাদের উত্তরণের উপায় খুঁজতে হবে। প্রতিবছরই পাটপণ্যের মেলা হচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকে পাটজাত পণ্যের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে নানা পদক্ষেপের কথা শোনানো হচ্ছে। ২০১০ সালে নির্দিষ্ট কিছু পণ্যে পাটের ব্যাগ বাধ্যতামূলক করা হয়। এ ছাড়া পাট দিয়েও পলিথিন উৎপাদন করা যায়। পরীক্ষামূলকভাবে সোনালী ব্যাগের উৎপাদন আশা জাগিয়েছে। আশা জাগলেও ‘লাল ফিতার’ মারপ্যাচে সোনালী ব্যাগ এখনও সাধারণের নাগালের মধ্যে আসেনি। এমন অবস্থায় সরকারকে আরও উদ্যোগী হতে হবে।

সরকার চাইলে পলিথিনের পরিবর্তে পাটজাত ব্যাগকে এখনও জনপ্রিয় করে তোলা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে পাটজাত ব্যাগ উৎপাদনে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করতে হবে। প্রয়োজনে পাট উৎপাদনে কৃষককে বিনা মূল্যে সার প্রদান, পাট পচনে সহায়তা ও পাটের উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। কৃষকদের দিতে হবে সহজ শর্তে ঋণও।

সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, এর বিপরীতে গজিয়ে উঠেছে শত শত পলিথিন কারখানা। বুঝতে হবে কতখানি বিপদের পদধ্বনি আমরা শুনছি। আমাদের বিশ্বাস করতে হবে পরিবেশ ধ্বংস হলে ধ্বংস হবে প্রকৃতি, ধ্বংস হবে মানুষও। আমরা ক্রমশ ধ্বংসের পথে যাব নাকি আমরা বাঁচব?

লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, সাপ্তাহিক শীর্ষ খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *