নিঃশব্দেই কি বিদায় নিচ্ছেন ‘সাইলেন্ট কিলার’?

নিঃশব্দেই কি বিদায় নিচ্ছেন ‘সাইলেন্ট কিলার’?

খেলা স্পেশাল

মার্চ ১৪, ২০২৩ ৭:৩১ পূর্বাহ্ণ

গুঞ্জন ছিল অনেকদিন ধরেই। নতুন কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে আসার পর শঙ্কা আরো বাড়ে। শেষ পর্যন্ত হলো সেটাই। আয়ারল্যান্ড সিরিজের ওয়ানডে দল থেকে বাদ পড়েছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।

দেশের ক্রিকেটে সাইলেন্ট কিলার নামেই পরিচিত রিয়াদ। তার স্কোয়াডে না থাকার বিষয়ে নির্বাচকরা বিশ্রাম শব্দটি ব্যবহার করলেও বাস্তবে এটা যে শেষের ইঙ্গিত, তা যেন এক ওপেন সিক্রেট। ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে থাকা এই ক্রিকেটারের শুরুটা ছিল দারুণ।

২০০৭ সালের ২৫ জুলাই শ্রীলংকার বিপক্ষে ওয়ানডেতে প্রথম দুই ম্যাচ হেরে সিরিজ খুইয়েছিল বাংলাদেশ। বাকি ছিল সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডে। কলম্বোতে নিয়ম রক্ষার সে ম্যাচেই টাইগার শিবিরে ডাক পান মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, হয় অভিষেক।

অভিষেক ম্যাচে পাঁচ ওভার বল করে ২৮ রান দিয়ে দুই উইকেট নেন রিয়াদ। এরপর শ্রীলংকার দেওয়া ১৯৭ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে লোয়ার অর্ডারে ব্যাটিংয়ে নেমে ৩৪ করে সাজঘরে ফেরেন। এ ম্যাচটি বাংলাদেশ হারলেও রিয়াদের অভিষেক ছিল মনে রাখার মতোই।

এরপর নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ধীরে ধীরে জাতীয় দলে ভরসার নাম হয়ে ওঠেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশ দলের পঞ্চপান্ডবের অন্যতম একজন সদস্য বনে যান তিনি।

অভিষেক টেস্টেই আলো ছড়ান রিয়াদ

অভিষেক টেস্টেই আলো ছড়ান রিয়াদ

দীর্ঘ ১৬ বছরের ক্যারিয়ারে তিন সংস্করণে সবমিলিয়ে ৩৮৯ ম্যাচ খেলেছেন রিয়াদ। সব ফরম্যাট মিলিয়ে ৬ হাজার ৬৮২ রান ও ১৬৩ উইকেট শিকার করেছেন এ অলরাউন্ডার।

জাতীয় দলের হয়ে সবশেষ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলেন রিয়াদ। বাজে ফর্মের কারণে এ সিরিজে নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি তিনি। এজন্য আসন্ন আয়ারল্যান্ড সিরিজের তাকে বাদ রেখেই দল ঘোষণা করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)।

মূলত এরপর থেকেই ক্রিকেটাঙ্গনে বাংলাদেশ দলের অভিজ্ঞ এ ক্রিকেটারের পক্ষে-বিপক্ষে শুরু হয়েছে যুক্তিতর্ক। অনেকেরই ধারণা, এখানেই হয়তো শেষ হচ্ছে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ক্রিকেটীয় যাত্রা।

রিয়াদের শেষের গল্পটা লেখার আগে চোখ বোলানো যাক তার চিরস্মরণীয় কিছু কীর্তির দিকে…

সাদা পোশাকে অভিষেকেই রিয়াদের পাঁচ

এক দিনের আন্তর্জাতিক (ওডিআই) ক্রিকেটে অভিষেকের প্রায় দুই বছর পর টেস্ট দলে ডাক পান মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। আর অভিষেকেই অনন্য এক রেকর্ড গড়ে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেন এ ক্রিকেটার।

অল্প সময়ের মাঝেই দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে উঠেছিলেন রিয়াদ

অল্প সময়ের মাঝেই দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে উঠেছিলেন রিয়াদ

২০০৯ সালে উইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ খেলতে যায় বাংলাদেশ। প্রথম টেস্টেই দলে সুযোগ পান রিয়াদ। এ ম্যাচে আগে ব্যাট করে ২৩৮ রানেই গুটিয়ে যায় টাইগাররা। প্রথম ইনিংসে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে রানের খাতা লম্বা করতে পারেননি তিনি।

ব্যক্তিগত মাত্র ৯ রানেই আউট হয়ে যান এ ডানহাতি ব্যাটার। তবে বল হাতে ছড়ান আলো। প্রথম ইনিংসে শিকার করেন ৩ উইকেট। কিংসটাউনে রিয়াদের ঘূর্ণির সামনে অসহায় আত্মসমর্পণ করে ক্যারিবীয়রা। ৩০৭ রান করে অলআউট হয়ে যায় তারা।

এরপর দ্বিতীয় ইনিংসে আবারো ব্যাটিংয়ে ব্যর্থ হন তিনি। ৮ রান করে সাজঘরে ফেরেন। তবে বল হাতে রেকর্ড গড়ে পাঁচ উইকেট তুলে নিয়ে বাংলাদেশকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেন এ অলরাউন্ডার।

বিশ্বমঞ্চে রিয়াদের ৩ সেঞ্চুরি

বিশ্বকাপের যেকোনে আসরেই তারকা ক্রিকেটারদের খুব বেশি কীর্তি নেই। যে’কটি আছে সেটিও আবার হাতে গোনা। তবে এখানেই যেন সবার চেয়ে আলাদা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।

২০১৫ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে দুটি ও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে এক সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে অনন্য রেকর্ড করেন রিয়াদ।

প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপে সেঞ্চুরির পর রিয়াদ

প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপে সেঞ্চুরির পর রিয়াদ

অ্যাডিলেইডে ওয়ানডে বিশ্বকাপের ৩৩তম ম্যাচে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ। এ ম্যাচে আগে ব্যাট করে রিয়াদের দুর্দান্ত সেঞ্চুরিতে ২৭৫ রান করে টাইগার বাহিনী। যা ছিল ওয়ানডে বিশ্বকাপে কোনো বাংলাদেশি ব্যাটারের প্রথম সেঞ্চুরির কীর্তি।

এটা আবার রিয়াদের ক্যারিয়ারেরও প্রথম সেঞ্চুরি। যদিও ইনিংসটি লম্বা করতে পারেননি তিনি। ইংলিশ পেসার ওকসের হাতে রান আউট হওয়ার আগে ১৩৮ বলে ১০৩ রানের ইনিংস খেলেন রিয়াদ। বিশ্বমঞ্চে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে হন ম্যাচসেরাও।

এরপর একই আসরে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও সেঞ্চুরির দেখা পান রিয়াদ। এর মধ্য দিয়ে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি করে রেকর্ড গড়েন এ অলরাউন্ডার। কিউইদের বিপক্ষে ১২৩ বলে অপরাজিত ১২৮ রানের ইনিংস খেলেন তিনি।

রিয়াদ ওয়ানডে ক্যারিয়ারের তৃতীয় সেঞ্চুরির দেখা পান চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে। প্রতিপক্ষ ছিল সেই নিউজিল্যান্ড। অদম্য রিয়াদের ১০২ রানের ইনিংসে ভর করে অবিশ্বাস্য ও ঐতিহাসিক এক জয়ের দেখা পায় লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা।

নিদাহাস ট্রফিতে শ্রীলংকা বধ

আন্তর্জাতিক টি-২০তে বাংলাদেশের সুখস্মৃতি হাতে গোনা। এর মধ্যে নিদাহাস ট্রফির সেমিফাইনাল অন্যতম হয়ে থাকবে। এ ম্যাচের শেষ মুহুর্তের নাটকীয়তা ক্রিকেট পাগল ভক্তরা কখনোই ভুলতে চাইবেন না। ক্ষণে ক্ষণে রং বদলানো এ ম্যাচে শেষ হাসিটা হেসেছিল বাংলাদেশই।

চুপিসারে রিয়াদের বিদায় হয়তো ক্রিকেট বিধাতাও মানতে পারবেন না।

চুপিসারে রিয়াদের বিদায় হয়তো ক্রিকেট বিধাতাও মানতে পারবেন না।

এ ম্যাচ জয়ের কৃতিত্বের অন্যতম দাবিদার হয়ে থাকবেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদই। শেষ ওভারে শ্রীলংকা পেসার উাদানাকে রীতিমতো ধোলাই করে ম্যাচ জয়ের নায়ক বনে যান তিনি।

নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে যেতে শেষ ওভারে বাংলাদেশের প্রয়োজন ১২ রান। ২২ গজে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে আছেন মুস্তাফিজ, অন্যপ্রান্তে রিয়াদ। শেষ ওভারের শুরুতেই এক্সট্রা বাউন্সে ফিজকে বোকা বানান উদানা। পরের বলটি আবারো বাউন্সার দেন তিনি। আর এবারই বাঁধে বিপত্তি।

লেগ স্কয়ারে দাঁড়ানো আম্পায়ারের কাছে নো বলের আবেদন করে রানের জন্য দৌঁড় দেন ফিজ-রিয়াদ। তবে গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই রান আউট হন কাটার মাস্টার। নো বল না পেয়ে টাইগার অধিনায়ক সাকিব অসন্তুষ্ট হয়ে খেলোয়াড়দের মাঠ ছাড়তে বলেন। তবে নানা নাটকীয়তা শেষে রিয়াদ ও রুবেলকে বুঝিয়ে ক্রিজে ফেরায় শ্রীলংকা।

এরপর স্ট্রাইক পান রিয়াদ। ওভারের তৃতীয় বলে চার, চতুর্থ বলে দ্রুতগতির দুই রান নেন ব্যাটাররা। ওভারের পঞ্চম বলে পায়ের গোড়ালির কাছ থেকে বল টেনে তুলে বাউন্ডারির বাইরে ফেলেন মাহমুদউল্লাহ। রুদ্ধশ্বাস এ ম্যাচে রিয়াদের ব্যাটে ভর দিয়ে নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে পৌঁছে যায় টিম টাইগার্স।

বাংলাদেশকে এভাবে বেশ অনেকবার অবিশ্বাস্য কিছু জয় এনে দিয়েছেন সাইলেন্ট কিলার। দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এ ক্রিকেটারের বিদায়টা যদি সত্যিই এভাবে চুপিসারে হয়, তাহলে ক্রিকেট বিধাতাও সন্তুষ্ট হবেন কি? উত্তরটা না হয় সময়ের কাছেই তোলা থাক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *