ডেঙ্গুর ক্লাসিক উপসর্গ ভয় জাগাচ্ছে

ডেঙ্গুর ক্লাসিক উপসর্গ ভয় জাগাচ্ছে

স্বাস্থ্য স্লাইড

জুলাই ১৮, ২০২৩ ৮:৩৬ পূর্বাহ্ণ

একজন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে সাধারণত প্রথমে তার জ্বর, মাথা ও শরীরে ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। আগের বছরগুলোতে দেশে ডেঙ্গু রোগীর ক্ষেত্রে এমন উপসর্গগুলোই বেশি দেখা গেছে।

তবে এবার এসব উপসর্গ ছাড়াও ডেঙ্গুর ক্লাসিক সাইন সিম্পটম (মেশানো বা বিভিন্ন উপসর্গ) দেখা যাচ্ছে। প্রতিদিন হাসপাতালে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা নিয়ে আসা ব্যক্তিদের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ডেঙ্গুর এমন উপসর্গ ধরা পড়ছে।

চিকিৎসকরা জানান, এবার বিপুল সংখ্যক রোগী ডেঙ্গুর স্বাভাবিক উপসর্গ ছাড়াও আক্রান্ত হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে বুঝতে না পারায় তারা দেরিতে হাসপাতালে আসছেন। এতে করে আক্রান্তদের অনেকের শারীরিক পরিস্থিতি খুবই নাজুক হচ্ছে।

প্রথাগত ডেঙ্গু উপসর্গ না থাকায় রোগী বেশি মারা যাচ্ছে। বিভিন্ন উপসর্গ যুক্ত ডেঙ্গুর প্রকোপে গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ১ হাজার ৫৮৯ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এ সময় আটজনের মৃত্যু হয়েছে। এটি চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর নতুন রেকর্ড।

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান বলেন, ক্লাসিক সিম্পটম বা মেশানো উপসর্গ গত বছরে তেমন দেখা যায়নি। এবার এমন সমস্যা নিয়ে অসংখ্য রোগী আসছে। অস্বাভাবিক কিছু উপসর্গ থাকা রোগীদের কমপ্লিকেটেড (জটিল) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত বলা হচ্ছে। জ্বরের শুরুতে বা দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে আক্রান্তদের ভয়াবহ জটিলতা দেখা দিচ্ছে।

পাশাপাশি শরীর ব্যথা ছাড়াও ডায়রিয়া, বমিভাব, তীব্র বমি, পেট ব্যথা, মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা ও পাতলা পায়খানা, বুকে পানি জমে যাওয়া ও খিঁচুনি হচ্ছে। শরীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে। অধিকাংশ রোগীর শক সিনড্রোম দেখা দিচ্ছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাসপাতালে ভর্তির ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ৮০ শতাংশ রোগী মারা যাচ্ছেন। ফলে কারও জ্বর, খারাপ লাগা বা অন্য অস্বাভাবিক উপসর্গ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন বলেন, ডেঙ্গুতে প্রথমবার আক্রান্তের পর তেমন জটিল লক্ষণ দেখা দেয় না। দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে শরীরের ছোট ছোট রক্তনালি ফেটে রক্ত থেকে পানি বের হয়। এটা শরীরের যে কোনো জায়গা থেকে বের হতে পারে। ফলে এ সময় যাদের জ্বর হচ্ছে।

যারা ডেঙ্গু বা এডিস মশাপ্রবণ এলাকায় আছেন, তাদের যে কোনো ধরনের অসুস্থতা বা শরীরে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি লক্ষ্য করলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে দ্রুত ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে। মনে রাখতে যে কোনো ধরনের উপসর্গতেও এবার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। এক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিষ্ক, লিভার বিভিন্ন অঙ্গে একেকজনের একেক রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই উপসর্গ থাক বা না থাক শরীরে অস্বাভাবিক কোনো কিছু মনে হলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করে নিশ্চিত হবে।

বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, আগের বছরগুলোর তুলনায় এবার হাসপাতালে যারা ভর্তি হচ্ছেন তাদের মধ্যে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন এমন রোগীর সংখ্যা বেশি। তারা হয়তো আগে একটি ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত হয়েছিল। এখন তারা হয়তো অন্য একটি ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত। ফলে যে উপসর্গগুলো নিয়ে তারা আসছেন-সেগুলো প্রথাগত ডেঙ্গু উপসর্গের মতো নয়। চিকিৎসা পরিভাষায় একে কমপ্লিকেটেড ডেঙ্গু সিনড্রোম বা এক্সটেনডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম বলা হয়। উপসর্গগুলো কোনোভাবেই অবহেলা করার সুযোগ নেই।

কিন্তু প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক এ ধরনের ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ছুটে আসছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ডেঙ্গুতে আটজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে এ বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ১১৪ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৫৮৯ জনসহ এ বছর হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২২ হাজার ৪৬৭ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু নিয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে ঢাকায় ৮৪৭ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ৭৪২ জন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৫ হাজার ৪৪১ জন রোগী। তাদের মধ্যে ঢাকায় ৩৩৪৭ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ২০৯৪ জন।

ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের মতো দীর্ঘমেয়াদি কোনো অসুখে ভুগছেন-এমন ব্যক্তিদের ডেঙ্গু পজিটিভ হলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম। সোমবার ঢাকার মুগদা জেনারেল হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে তিনি বলেন, যাদের কোমরবিডিটি আছে, বিশেষ করে ডায়াবেটিস, হাইপার টেনশন, ক্যানসারে আক্রান্ত বা ক্যানসারের ওষুধ সেবন করেন তাদের ডেঙ্গু ধরা পড়লে অবশ্যই হাসপাতালে আসতে হবে। না হলে পরে সামাল দেওয়া যাবে না। বাড়িতে বসে ওই ধরনের রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া যাবে না। তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গুর টাইপের ওপর চিকিৎসা নির্ভর করে না। যে ধরনেই আক্রান্ত হোক-চিকিৎসা একটাই। ডেঙ্গুর গাইডলাইন অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে সারা দেশের চিকিৎসকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেই প্রটোকল অনুযায়ী সবাইকে (চিকিৎসকদের) চিকিৎসা করতে বলা হয়েছে। সারা বছর ধরে ডেঙ্গু বিষয়ে ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রিউমাটোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান বাতরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সৈয়দ আতিকুল হক বলেন, ডেঙ্গুর বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। চিকিৎসকদের উচিত ডেঙ্গুর চিকিৎসাবিধি বা প্রটোকল অনুসরণ করে চিকিৎসা দেওয়া। এক্ষেত্রে ডেঙ্গু পরীক্ষা এনএস-ওয়ান পজিটিভ থাকে জ্বর হওয়ার প্রথম তিন থেকে চার দিন। সুতরাং তিন দিনের মধ্যে রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে। কারণ পঞ্চম দিন থেকে নেগেটিভ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

এজন্য আইজিজি ও আইজিএম এ তিনটা পরীক্ষা করতে হবে। যদি দেখা যায় শুধু আইজিজি পজিটিভ এবং আইজিএম নেগেটিভ তাহলে এটা ডেঙ্গু নয়। টাইফয়েড বা অন্য কোনো ভাইরাস থেকে জ্বর। যদি আইজিএম পজিটিভ আইজিজি নেগেটিভ তাহলে বুঝতে হবে- এটা প্রাইমারি ইনফেকশন। আর যদি দুটিই পজিটিভ হয় তাহলে বুঝতে হবে-দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *