জেনে নিন, মানসিক স্বাস্থ্য কেন গুরুত্বপূর্ণ

জেনে নিন, মানসিক স্বাস্থ্য কেন গুরুত্বপূর্ণ

স্বাস্থ্য

অক্টোবর ১১, ২০২৩ ২:২০ অপরাহ্ণ

আমাদের জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি আমাদের জীবনের সামগ্রিক ভারসাম্য রক্ষা করে এবং জীবনকে প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করে।

আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের ন্যায় মানসিক স্বাস্থ্য সমান গুরুত্বপূর্ণ, এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সব কুসংস্কার, নেতিবাচক বদ্ধমূল ধারণা দূর করে, আশার সঞ্চার করতে হবে।

মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব না দিলে, আমরা উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারব না। তাই এখনি সময় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার।

মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন অত্যাবশকীয় একটি বিষয়। আমাদের প্রতিদিন বিভিন্ন ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়। এর মধ্যে কোনো কোনো ঘটনা আমাদের মনে সুখানুভূতি তৈরি করে, আবার কোনো কোনো ঘটনা আমাদের মনে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না, এমন কিছু ঘটনাও ঘটে যার কারণে আমাদের মনে বিষাদ, রাগ-ক্ষোভ কিংবা দুঃখের কালো মেঘ নিয়ে আসে। যখন আমরা মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন হব, তখন এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করা সহজ হবে, দ্রম্নত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা সম্ভব হবে।

যে কারো জীবনে দুঃখ-দুর্দশা, হতাশা- নৈরাশ্যের কালো মেঘ বাসা বাঁধতে পারে, তাই বলে জীবন কিন্তু ব্যর্থ হয়ে যায় না। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমরা কীভাবে খারাপ সময় বা পরিস্থিতির মোকাবিলা করছি এবং মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি কতটা যত্নবান হচ্ছি।

মানসিক স্বাস্থ্য কি?

মানসিক স্বাস্থ্য কী তা বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে স্বাস্থ্য কী? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা WHO এর মতে স্বাস্থ্য হলো ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক এই তিন অবস্থার একটি সুস্থ সমন্বয়।

সুতরাং আমরা বলতে পারি, একজন মানুষের স্বাস্থ্য হলো রোগবালাই মুক্ত সুস্থ শরীর ও সেই সঙ্গে ভয়, হতাশা, বিষন্নতা, মানসিক চাপ থেকে মুক্ত মন এবং সমাজের নানাবিধ চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করতে সক্ষম মন। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, স্বাস্থ্যের অন্যতম উপাদান হলো মনের সুস্থতা বা মানসিক স্বাস্থ্য। মানুষের চিন্তা, আবেগ ও আচরণ এই তিন মিলেই হলো মানসিক স্বাস্থ্য।

এককথায় মানসিক স্বাস্থ্য বলতে বোঝায় ‘Full and harmonious functioning of whole personality’.

আমাদের প্রত্যেককেই কোনো না কোনো সময়ে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয় তা সে কর্মজীবনে হোক বা ব্যক্তিগত জীবনে। অনেক সময় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হতে গিয়ে আমাদের মানসিক অবসাদ, বিষন্নতার শিকার হতে হয়। আমরা যখন দেখি আমাদের স্বাভাবিক কাজগুলো ব্যাহত হচ্ছে তখনি মানসিক অসুস্থতার প্রশ্নটি সামনে আসে। দেখা যায় যে, আমরা শারীরিক স্বাস্থ্য নিয়ে যতটা সচেতন, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে ততটা সচেতনতা দেখাই না। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ থাকলে তা শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর ভীষণ ভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ শারীরিক স্বাস্থ্য এবং মানসিক স্বাস্থ্য ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।

WHO এর তথ্য থেকে জানা যায় যে প্রায় ৭.৫% ভারতীয় কোনো না কোনো প্রকার মানসিক সমস্যার শিকার। এদেশে আক্রান্তের পরিমান বিশ্বের মোট আক্রান্তের প্রায় ১৫%, আরো চিন্তার বিষয় হলো WHO এর মতে সঠিক ব্যবস্থা না নিলে আগামী দিনগুলোতে আরো বেশি মানুষ এই মানসিক অবসাদের শিকার হবে। কিন্তু বর্তমানের এই উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থায় কি এর সুরাহা সম্ভব নয়? যদিও এই সমস্যার সমাধানে চিকিৎসকরা সাহায্য করতেই পারেন, কিন্তু আমাদের দেশে এই বিপুল জনসংখ্যার জন্য রয়েছে মাত্র ৪০০০ থেকে ৪৫০০ সাইক্রাটিস্ট।

মানসিক সমস্যার রূপ গুলো নানা প্রকার। যেমন- অবসাদ, মানসিক উদ্বিগ্নতা, এছাড়াও রয়েছে স্কিৎজোফ্রেনিয়া এবং বাইপোলার সমস্যা।

মানসিক স্বাস্থ্য গুরুত্বপূর্ণ কেন?

সুস্থ ও সুন্দর জীবনের জন্য শরীরকে সুস্থ রাখা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হলো মনকে সুস্থ রাখা।

ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকলে সে-

(ক) দৈনন্দিন কাজকর্ম সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করতে পারে।
(খ ) বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে।
(গ ) পরিবার ও সমাজের সঙ্গে সঙ্গতি বিধান করে চলতে পারে। স্বাভাবিক ও সুষ্ঠ অভিযোজনে সক্ষম হয়।
(ঘ ) বিভিন্ন বিষয়ে দ্রুত ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
(ঙ ) আরো উৎপাদনশীল হয়ে ওঠে এবং নিজের ও সমাজের উন্নয়নে আরো বেশি ভূমিকা রাখতে পারে।

মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার উপায়

মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে আমরা যা যা করতে পারি-

(১) নিজের যত্ন নেওয়া: মানসিক সুস্থতা ও সুস্থ ভাবাবেগ পেতে নিজের যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। অবদমিত আবেগ প্রকাশের ফলে মানসিক চাপ ও জটিলতা কমে যায়। নিজের জন্য কিছুটা সময় আলাদা রাখো, নিজের মনের কথা শোনো, বই পড়ো গান শোনো। অতীত ও ভবিষ্যৎ ভুলে বর্তমানে থাকার চেষ্টা করো।

(২) পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ: বিভিন্ন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা এটাই দেখেছেন যে সুষম ও পুষ্টিকর খাবার কেবল আমাদের শরীরকেই নয় , মনকেও ভালো রাখে। অন্যদিকে অস্বাস্থ্যকর ফ্যাটি খাবার আমাদের বিষন্নতার জন্য মারাত্মক দায়ী। ভিটামিন বি -১২, ওমেগা -৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার আমাদের মস্তিষ্কের আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী হরমোনগুলোকে চাঙ্গা রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া তাজা ফলমূল ও সবজি একটা বড় ভূমিকা রাখে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যে।পুষ্টিকর খাবার নিয়মিত খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ফলে শারীরিক ও মানসিক উভয় স্বাস্থ্যই সুস্থ থাকে।

(৩) পর্যাপ্ত ঘুম: শরীর সুস্থ রাখতে যেমন পর্যাপ্ত ঘুমের বিকল্প নেই; তেমনই মনকে সুস্থ রাখতেও ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। কারণ পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে আমাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠে ফলে আমরা ক্লান্তিবোধ করি, কমে যায় কর্মস্পৃহাও। ঘুমের সময় আমাদের শরীর ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলো সারিয়ে তোলে আমাদের মন ও মেজাজকে চাঙ্গা রাখে। তাই মানসিক স্বাস্থ্য সুস্থ রাখতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম জরুরি।

(৪) নিয়মিত ব্যায়াম: মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য শারীরিক ব্যায়াম খুবই জরুরি। স্ট্রেস ও বিষন্নতা কাটাতে ব্যায়াম ভীষণ কাজে আসে। ব্যায়ামের ফলে শরীরে স্ফূর্তি আসে, ক্লান্তি ও মানসিক চাপ হ্রাস পায়। তাই মনকে চাঙ্গা রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম করার অভ্যেস গড়ে তোলো।

(৫) শখের কাজ করা: নিজের শখের কাজগুলো করতে পারলে মন ভালো থাকে, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। দুশ্চিন্তা মাথায় আসে না এবং অবদমিত আবেগগুলোও প্রকাশ পায়। যেমন- বাগান করা, রান্না কিংবা সেলাই করা, নতুন কোনো কিছু শেখা ইত্যাদি। ফলে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে।

(৬) নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখা: নিজের দুর্বলতাগুলো মেনে নিয়ে নিজের ক্ষমতার ওপর বিশ্বাস রাখলে জীবনে এগিয়ে চলার সাহস পাওয়া যায়। আমরা কেউই নিখুঁত নই। অন্যের সঙ্গে নিজের তুলনা করে নিজের দুর্বলতাগুলো নিয়ে চিন্তা করা বোকামির কাজ। এতে করে হীনমন্যতা, হতাশা, বিষন্নতা বৃদ্ধি পায়। তার থেকে নিজের দুর্বলতাগুলো মেনে নিয়ে কিংবা তা দূর করার প্রয়াস করলে নিজের প্রতি বিশ্বাস বাড়বে।

(৭) কৃতজ্ঞ থাকা: সারাদিন কী কী পেয়েছো তার একটা লিস্ট বানাও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো। যা পাওনি তা নিয়ে কষ্ট পেও না, যতটুকু পেয়েছো তাতে খুশি থাকার চেষ্টা করো এতে করে মনের ভেতর ইতিবাচকতা জন্ম নেবে।

(৮) প্রিয়জনদের সঙ্গে বেশি করে সময় কাটাও: প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটালে মন সুস্থ থাকে। নিজেকে ঘরবন্দি রাখলে হতাশা ও দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকবে ফলে মানসিক সমস্যার দেখা দিতে পারে। বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সঙ্গে মন খুলে মেশো। একটু হাসি একটু আলিঙ্গন মনকে সুস্থ করে তুলতে দারুন উপযোগী।

(৯) সক্রিয় থাকা: অলস হয়ে বসে থাকলে নানা দুশ্চিন্তা মাথায় ভিড় জমাতে থাকে। তাই সবসময় কাজের মধ্যে থাকো তাহলে মন এমনিতেই ভালো থাকবে।

(১০) ক্ষমা করা: দীর্ঘদিন ধরে কারো প্রতি ক্ষোভ জমতে থাকলে মানসিক অসুস্থতার সূত্রপাত হতে পারে। তাই ক্ষমা করে দাও ক্ষমাই পারে মানসিক প্রশান্তি দান করতে। ক্ষমা করো সুস্থ থাকো।

এতক্ষন ধরে যে উপায়গুলো বলা হলো সেগুলো আমাদের হাতে রয়েছে যা অবলম্বন করে আমরা মানসিক ভাবে সুস্থ থাকতে পারি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ মানসিক সমস্যা নিরাময় এর জন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
শারীরিক ক্ষতি ভালো হলেও মানসিক ক্ষতি সহজে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। আমাদের চারপাশে রোজ কিছু নৃশংস ঘটনা ঘটছে, যারা ভুক্তভোগী তাদের মধ্যে সাংঘাতিক মানসিক চাপ, ভয়, বিষন্নতা, হতাশাসহ নানা ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। আমাদের উচিত তাদের পাশে থাকা, তাদের হেয় চোখে না দেখে কীভাবে তারা পুরোপুরি সুস্থ জীবন পেতে পারে তার ব্যবস্থা করা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *