করোনায় শিক্ষা থেকে আরও ঝরে পড়েছে “আবর্জনায় বেড়ে ওঠা শিশুরা”

করোনায় শিক্ষা থেকে আরও ঝরে পড়েছে “আবর্জনায় বেড়ে ওঠা শিশুরা”

জাতীয় স্লাইড

নভেম্বর ২৯, ২০২৩ ৯:২০ পূর্বাহ্ণ

বিশেষ প্রতিবেদন: শামীম রহমান রিজভী

ফুটফুটে সুমাইয়া (১৪), এই বয়সে তার স্কুলে যাওয়া এবং খেলাধুলা করার সময়। কিন্তু “লকডাউনের” বিষাক্ত ছোবলে এই শিশুটিই এখন ১১ মাসের শিশুর জননী।

আবর্জনায় মা-বাবার সাথে জীবিকা নির্বাহ করা সুমাইয়াও পড়ালেখা করে শিক্ষিত হতে চেয়েছিলেন। তাই তো দেরিতে হলেও ভর্তি হয়েছিলেন বিদ্যালয়ে। সেখানে অবশ্য বেতন দিতে হতো না। তাই শিক্ষা গ্রহণ ভালোভাবেই চলছিল সুমাইয়ার। কোভিড-১৯ এর প্রকোপ ছড়ানোর আগে ৩য় শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যায়ন করতে পারেন সুমাইয়া। এরপরই ২০২০ সালে আসে কোভিড-১৯, এরই সাথে শিক্ষার স্বপ্নও মাটি চাপা পড়ে যায় শিশুটির।

শুধু সুমাইয়া নয়, এমন সুবিধাবঞ্চিত ৫০ শতাংশের বেশি শিশু কোভিড-১৯ নামক মহামারির জন্য শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়েছে বলে জানিয়েছে “গ্রাম বাংলা উন্নয়ন কমিটি” নামক একটি বেসরকারি সংগঠন।

সুমাইয়া বলেন, “লকডাইনের” সময় সকল কাম-কাজ বন্ধ আছিলো। তহন একজনের খাওন জোগাড় করাও কষ্টের আছিলো। বস্তির ভাড়াও দিতে পারতাছিলাম না। বস্তির মালিকও ভাড়ার জন্য তাড়াইতাছিলো। তাই বাপ-মা আমারে বিয়া দিয়া গ্রামে চইলা যায়।”

পড়ালেখা করতে ইচ্ছে করে না? জিজ্ঞেস করলে শিশুটি তার ১১ মাস বয়সের সন্তানের দিকে তাকিয়েছিল, কিন্তু কোন উত্তর দেয় নি।

এমনই একজন হাফিজা (১৫) ৫ম শ্রেণীর চূড়ান্ত পরীক্ষা পর্যন্তও অপেক্ষা করেনি তার অভিভাবক। ২০২০ এ “লকডাউন” শেষ হলেই বিদ্যালয়ের পরিবর্তে কাজে পাঠিয়ে দেন হাফিজার অভিভাবক।

হাফিজা বলেন, “আমি আরো পড়ালেখা করতে চাই। কিন্তু আমার বাবা চান না আমি আর পড়ালেখা করি। বাবা বলে সংসারের জন্য উপার্জন করতে। লকডাউন থাকায় ‘টোকানোর’ কাজ করে এখন আর তেমন ইনকাম হয় না। তাই আমাকেও একটি কার্টন তৈরির কারখানায় কাজে লাগিয়ে দিয়েছে বাবা। কিন্তু আমি একদিন গিয়ে আর যাই নাই। আমি পড়ালেখা করতে চাই।”

১৭ বছর বয়সী শুভ মন্ডল। কোভিড-১৯ শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত রাজধানীর যাত্রাবাড়িতে একটি বেসরকারি এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছিলেন। হয়ত “লকডাউন” শুরু না হলে এতো দিনে মাধ্যমিক (এসএসসি) পরীক্ষা দিয়ে দিতেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তার জন্য অপেক্ষা করছিলো। ২০২০ সালে করোনার প্রকোপ বাড়ার পর পরিবারসহ গ্রামে চলে যান শুভ। কারণ রাজধানীতে সকল পণ্যের বাড়তি দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জীবন যেন অনেক অসহায় হয়ে গিয়েছিল তাদের। এছাড়া কোন উপার্জনও ছিলোনা তাদের। ২০২১ সালের পর জীবন স্বাভাবিক হওয়া শুরু করলে বাবা-মা’র সঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের “ল্যান্ডফিলের” আবর্জনায় জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন। এরই সঙ্গে আবর্জনার স্তুপে চাপা পড়ে যায় শুভ’র শিক্ষা জীবন।

ওই বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতে তো টাকার দরকার হয়নি, তাহলে ঢাকায় এসে কেন পড়ালেখা শুরু করলেন না? এমন প্রশ্নের জবাবে শুভ বলেন, “টাকা না লাগিলেও সময় তো লাগিবে। এহন সময় কো! বাড়িত আরো দুইডা ছোড ভাই-বোইন আছে। বাপ-মা’র ইনকামে তো অয় না। জিনিস-পত্রে দাম যে বাড়িছে তাতে না খাইয়ে মরা লাইগবে। এহন তো দাম আকাশে উঠিছে। কয়দিন পর ছোড ভাই-বোইন দুইডারেও কামে লাগাইতে হইবে।”

ইউনিসেফ এর তথ্য অনুসারে, করোনার জন্য শিশুদের কাঠামোগত শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি এবং শিশুশ্রম ও বাল্য বিয়ে বৃদ্ধি; এই ভয়াবহ পরিণতিগুলোর মধ্যে অনেকগুলো ইতোমধ্যে অসংখ্য শিশুকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং অনেকগুলো আগামী বছরগুলোতে অনুভূত হতে থাকবে। মহামারিজনিত কারণে স্কুল থেকে শিশুদের, বিশেষ করে মেয়ে শিশু এবং দরিদ্র ও প্রান্তিক পরিবারের শিশুদের, ঝরে পড়ার বর্ধিত ঝুঁকি সাম্প্রতিক দশকগুলোতে স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে অর্জিত অগ্রগতিকে উল্টে দিতে পারে।

বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি মি. শেলডন ইয়েট বলেন, “১৮ মাস বন্ধ রাখার পর বাংলাদেশে যখন স্কুলগুলো খুলে দেওয়া হয়, তখন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ রেখে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিশুদের সাহায্য করার জন্য দ্রুততার সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণে আমাদের প্রচেষ্টায় কোনো ঘাটতি রাখা উচিত নয়। শিক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে এবং ডিজিটাল বৈষম্য কমিয়ে আনতে বিনিয়োগ করার এখনই সময়।”

সেভ দ্য চিলড্রেন এর তথ্য অনুসারে, দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকায় অনেক শিশুকে শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন তাদের বাবা-মা। কাউকে আবার অল্প বয়সে বিয়ের পিঁড়িতেও বসিয়ে দেয়া হয়েছিল।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশের কোর গ্রুপ সদস্য শাহীন আনাম এক প্রতিবেদন উল্লেখ করে বলেন, মোট ২১টি জেলায় জরিপ চালানো হয়। বিদ্যালয় থেকে ঝড়ে পড়ার মূলে রয়েছে বাল্য বিয়ে ও শিশুশ্রম। মহামারির সময় প্রায় ১০ থেকে ১২ শতাংশ মেয়ে বাল্য বিয়ের শিকার। গত দুই বছরে শিশুশ্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি যতটা না অর্থনৈতিক, তার থেকেও অনেক বেশি সামাজিক সঙ্কট। অন্তত ১৫-২০ শতাংশ পরিবারে শিশু খাদ্যের ক্ষেত্রেও ব্যয় সঙ্কোচন করতে হয়েছে, যা শিশুদের পুষ্টিহীনতা অনেকাংশে বাড়িয়েছে। মহামারির কারণে শিশুশ্রম ও অল্পে বেতনে শিশুশ্রমিক নিয়োগ বেড়েছে। ৯ম ও ১০ম শ্রেণির মেয়েরা স্কুলে ফিরছে না, কারণ তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সের প্রায় ১৩ হাজার মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে যা আশঙ্কাজনক। যৌন নির্যাতন ও শারীরিক সহিংসতাও এর মধ্যে বেড়েছে।

বেসরকারি সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর তথ্য অনুসারে, করোনায় বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে। আগে এটা ছিলো ২০.৫ শতাংশ। চরম দরিদ্র অবস্থার মধ্যে আছেন ২৮.৫ শতাংশ মানুষ। করোনায় বাল্য বিয়েও বেড়েছে। এই সবগুলোর অভিঘাতই পড়েছে শিক্ষার উপর। বাংলাদেশে সাধারণভাবে প্রাথমিক পর্যায়ে ড্রপআউট শতকরা ১৭ ভাগ। মাধ্যমিক পর্যায়ে ৩৭ ভাগ।

সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দ্রব্যমূল্যের যে পরিস্থিতি সেটা আরও বেশ কিছুকাল থাকবে। বৈশ্বিক যে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে তার একটা প্রতিক্রিয়া আমাদের দেশে আছে। এই পরিস্থিতির মধ্যে মধ্যবিত্ত ও নিন্মবিত্তরা সবসময়ই চিন্তা করবে পরিবারের খরচ যত কম করা যায়। তাই তাদের আর্থিক সহায়তা যেন দেওয়া যায় সেখানে গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে। লকডাউনের শুরুর দিকে সরকার যেমন অনেক পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল। অন্য কোথাও সাপোর্ট না দিয়ে এখনও তেমনিভাবে আরো বেশি সংখ্যক পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিলে, সেটা যদি ৫০ লাখ পরিবারেরও বেশি হয়, তাহলে আরও ভালো।

তিনি আরও বলেন, যাদের তালিকা ও তথ্য আছে, এ ধরনের পরিবারগুলোকে যদি সল্পমূল্যে পণ্য সরবরাহ অথবা ৩০ কেজি চাল অথবা অর্থ সহায়তা দিতে পারে, তাহলে অন্তত সাময়িকভাবে হলেও বাড়তি ব্যয় কমানোর সুযোগ তৈরি হবে। পাশাপাশি বিদ্যালয়ের বেতন-ভাতা যদি দুই-তিন মাসের জন্য স্থগিত রাখা যায় এবং পরবর্তী সময়ে কয়েকটা ধাপে যদি তা আদায় করা যায়, তাহলে হয়তো শিক্ষার্থীদের উপরে বেতনের কারণে যে স্কুলে না যাওয়ার প্রভাব, সেটা কিছুটা হলেও কমবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *