ভুলে যাচ্ছে বিভীষিকাময় সেই যুদ্ধের স্মৃতি; শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ বেড়েছে রোহিঙ্গা শিশুদের

ভুলে যাচ্ছে বিভীষিকাময় সেই যুদ্ধের স্মৃতি; শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ বেড়েছে রোহিঙ্গা শিশুদের

জাতীয় স্লাইড

নভেম্বর ২৯, ২০২৩ ৯:১৮ পূর্বাহ্ণ

বিশেষ প্রতিবেদন: শামীম রহমান রিজভী

গত ২৫ আগস্ট ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে লাখো রোহিঙ্গা শরণার্থী সীমান্ত পাড়ি দিয়ে স্রোতের মতো বাংলাদেশে পালিয়ে আসা শুরু করেন। নতুন শরণার্থীরা আগে থেকে বসবাসরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাথে যুক্ত হওয়ার কারনে খুব দ্রুতগতিতে বাংলাদেশের কক্সবাজারে তৈরি হয় বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শরণার্থী সংকট! এই শরণার্থীদের মধ্যে ছিল হাজার হাজার অন্তঃস্বত্তা নারী এবং অসংখ্য নারী ও শিশু। মিয়ানমারের সেনা অভিযানের পরের পাঁচ মাসে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ১৯৭৮ সাল থেকে শুরু করে সর্বশেষ আসা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে।

ওই সময় বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার শিশু মানবেতর পরিস্থিতিতে ছিল। যেখানে ১৮ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা শিশুকে এতিম শনাক্ত করা হয়৷ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর আগ্রাসন থেকে পালিয়ে আসা এই শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন বিশ্ব উদ্বিগ্ন, তখন বিশ্ব দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় রোহিঙ্গা শিশুদের সকল সুযোগ-সুবিধার জন্য কাজ করে গেছে বাংলাদেশ। বর্তমান সময়ে শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ বেড়েছে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুদের বলে অভিমত দাতা সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের। এছাড়াও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এসব শিশুরা শান্তিময় পরিবেশ পেয়ে ধীরে ধীরে ভুলে যাচ্ছে ভয়ঙ্কর সেই যুদ্ধের স্মৃতি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, প্রতি বছর ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিচ্ছে। অর্থাৎ এই ৬ বছরে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা শিশুর সংখ্যা বেড়েছে। এতদিন একজন রোহিঙ্গা শিশু যে হারে রেশন পায়, একজন বয়স্ক রোহিঙ্গাও সে হারে রেশন পায়।

রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিক। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী স্কুল বন্ধ থাকার কারণে পড়াশোনা বন্ধ থাকলেও ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে প্রায় এক লাখ ৬৪ হাজার রোহিঙ্গা শিশু বিদ্যালয়ে ফিরে। ওই সময় বিদ্যালয় খোলার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায় সেভ দ্য চিলড্রেন এবং পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে পাঠ্যক্রম ব্যবহার করে একটি পাইলট প্রোগ্রামের জন্য অনুমতি দেয়ার প্রস্তাব করে এই সংগঠনটি। কারণ প্রায় দুই বছর ধরেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মাতৃভাষা শেখা থেকে বঞ্চিত হয় মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া এই রোহিঙ্গা শিশুরা। মিয়ানমারের কারিকুলাম অনুযায়ী ১০ হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে পাইলটিং করার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে তা পিছিয়ে যায়।

ইউনিসেফ এর তথ্য মতে, ২০২০ সালের মার্চে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের পর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়। ফলে প্রায় দুই বছর মাতৃভাষাসহ প্রাথমিক শিক্ষা বঞ্চিত হয় রোহিঙ্গা শিশুরা। তবে বর্তমানে ক্যাম্পজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ৩,৪০০টি শিক্ষা কেন্দ্রের মাধ্যমে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২,৮০০টি কেন্দ্র ইউনিসেফের সহায়তায় পরিচালিত। শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে ইংরেজি, বার্মিজ, গণিত, বিজ্ঞান ও বিভিন্ন জীবন দক্ষতা বিষয়ে শেখানো হয়, এবং এগুলোর চাহিদাও অনেক। ৬ থেকে ১১ বছর বয়সী রোহিঙ্গা শিশুদের ৮০ শতাংশ এখন শিক্ষা কেন্দ্রে ভর্তি রয়েছে। শিক্ষা কেন্দ্রে ভর্তির হার ছেলে-মেয়ে উভয় ক্ষেত্রেই বেশি। মায়ানমারের পাঠ্যক্রমের ভিত্তিতে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় এই কার্যক্রম রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং মর্যাদাপূর্ণ উপায়ে যদি রোহিঙ্গা শিশুদের মায়ানমারে ফিরে যাবার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তবে পরীক্ষামূলক এই কার্যক্রম মায়ানমারের শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজের সাথে তাদের একীভূত হবার সুযোগ সৃষ্টিতে সহায়তা করবে। স্থানীয় সম্প্রদায়ের একজন বাংলাদেশী শিক্ষক এবং রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের একজন বার্মিজ ভাষা প্রশিক্ষকের মাধ্যমে ক্লাশগুলো পরিচালিত হয়।

ইউনিসেফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি তোমো হোজুমি বলেন, “বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায়, সকল রোহিঙ্গা শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের তাদের সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশে সহায়তা করতে আমরা শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধির কার্যক্রমকে সম্প্রসারিত করছি। রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রমকে সহযোগিতা করার জন্য যে দাতাসংস্থা ও শিক্ষাখাতের অংশীদাররা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, তাদেরকে আমি ধন্যবাদ জানাই। এই নতুন ইতিবাচক বিকাশকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে আমাদেরকে এখনও একটি চ্যালেঞ্জিং পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে আমরা সবাই যদি একসাথে কাজ করি, তাহলে সব কিছুই করা সম্ভব বলে আমি মনে করি।”

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেনটাল হেলথের সহযোগী অধ্যাপক মনোবিশেষজ্ঞ হেলাল উদ্দিন আহাম্মেদ জানান, শিশুদের চিন্তা-ভাবনা এবং আচরণ আশপাশের পরিবেশের ওপর প্রতিফলিত হয়। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আর সহিংসতা শিশুদের চিন্তা প্রকাশ ভঙ্গির মধ্যে সেই আগ্রাসন আর যুদ্ধের প্রতিছবি ফুটে উঠায়। ঠিক যেভাবে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের শিশুদের মধ্যে হয়েছে। কিন্তু যখনই এসব শিশুরা একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরে পেয়েছে, সেবা পাচ্ছে এবং নিরাপত্তা পাচ্ছে। তখন তারা নিরাপদ বোধ করছে এবং আনন্দিত হচ্ছে। যার ফলে তারা ফুল আর শান্তির ছবি আঁকছে। তাই শিশুদের জন্য সবসময় এই শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আসার পর থেকে চিকিৎসায় কোন ঘাটতি রাখা হয়নি। রোহিঙ্গা শিশুদের বিভিন্ন রোগের টিকা দেওয়া হয়ে আসছে নিয়মিতভাবে। বেশীরভাগ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে কক্সবাজারের বিভিন্ন হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। উখিয়া, টেকনাফ ও বান্দরবান এলাকায় শরণার্থীদের জন্য বাড়তি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করা হয়েছে। পাশাপাশি অনেকগুলো নতুন স্বাস্থ্যকেন্দ্র খোলা হয়েছে। শরণার্থী এলাকাগুলোতে ৪০টির বেশি বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্বাস্থ্য কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। সেখানে রোগ প্রতিরোধ, পুষ্টি ও সেবার পাশাপাশি পরিবার পরিকল্পনা সেবা দেওয়া হচ্ছে।

এর আগে, কক্সবাজারের টেকনাফের থ্যাংখালিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শিশু নুরুল জোহারের সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করে বাংলাদেশ। ক্যাম্পে অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলার সময় নুরুলের শরীরের ওপর দিয়ে টমটম গাড়ির চাকা চলে যায়। এতে গুরুতর আহত হয় নুরুল, পেট ফুলে যায়। পেটের ভেতরের অনেক রক্তক্ষরণ এবং খাদ্যনালী-লিভারসহ খাদ্য বিপাকক্রিয়ায় সহায়ক অভ্যন্তরীণ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ আঘাতপ্রাপ্ত হয়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ফিল্ড হাসপাতালে প্রথমে পেটে অস্ত্রোপচার করা হয়, রক্তক্ষরণ আর আঘাতের কারণে তার প্লিহা কেটে বাদ দিতে হয়। এরপর কক্সবাজারের ডুলাহাজরাতে মেমোরিয়াল খ্রিস্টান মিশনারি হাসপাতালে দ্বিতীয় অস্ত্রোপচার হয় নুরুলের। পরে তৃতীয় অস্ত্রোপচারের সময় দেখা যায়, তার ক্ষুদ্রান্ত-লিভার ও আশেপাশের অন্যান্য অঙ্গ একসঙ্গে পেঁচিয়ে আটকে ছিল। ওই হাসপাতালের মার্কিন সার্জন ডা. নাথান শিশু চিকিৎসায় বিশেষায়িত ছিলেন না। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ ‍মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান ও সার্জারি অনুষদের ডিন এবং হেপাটোবিলিয়ারি অ্যান্ড প্যানক্রিয়েটিক সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. জুলফিকার রহমান খানের সঙ্গে ডা. নাথান ফোনে যোগাযোগ হয়। পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সব দফতরের সহায়তায় ঢামেক হাসপাতালে নুরুলের সফল অস্ত্রোপচার হয়। ডা. জুলফিকার রহমান খানের নেতৃত্বে অস্ত্রোপচার দলে ছিলেন অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক কাজল, অধ্যাপক ডা. কানিজ হাসিনা শিউলি, ডা. জগলুল গাফফার খান, ডা. বিপ্লব, ডা. পার্থ, ডা. আদিল, ডা. জিয়া, ডা. মোরশেদসহ অন্যরা।

ইউনিসেফ এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে নবজাতকদের বেঁচে থাকা ও সার্বিক সুস্থতার মান উন্নয়ন হয়েছে। ২০২১ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ইউনিসেফের সহায়তাপ্রাপ্ত কেন্দ্রগুলোতে মারাত্মক অপুষ্টিতে (এসএএম) ভোগা পাঁচ বছরের কম বয়সী ৬,৯২৩ জন শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হয়, যা বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার ১০৭ শতাংশ। এদের মধ্যে ৬ থেকে ৫৯ মাস বয়সী ৮৬৯ জন রোহিঙ্গা শিশুকে অন্য কোন চিকিৎসাজনিত জটিলতা না থাকায় কেএস রিলিফের সহায়তায় গড়ে ওঠা এবং ইউনিসেফের সহায়তায় পরিচালিত সমন্বিত পুষ্টি কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। ইউনিসেফের সহায়তাপুষ্ট পিএইচসিকে সম্প্রতি একটি সাধারণ স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে উন্নত করা হয়েছে। কেন্দ্রটিতে নিরাময়মূলক যত্ন, টিকাদান ও শৈশবকালীন অসুস্থতা পরিষেবার কমিউনিটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনা প্রদান করে। মাতৃসেবার আওতায় সেখানে নবজাতক, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা পরিষেবাসহ প্রসবপূর্ব ও প্রসোবত্তর সেবা, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার (জিভিবি) ঘটনা শনাক্তকরণ ও প্রতিকারের জন্য যথাযথ স্থানে পাঠানোর সেবা প্রদান করা হয়। সেখানে অন্তঃসত্ত্বা, স্তন্যদায়ী নারী ও শিশুদের যারা দেখাশোনা করে তাদের জন্য কাউন্সেলিং সেশন এবং তাদের শিশুদের জন্য একটি খেলার স্থান রয়েছে। বর্তমানে এই কেন্দ্রে একটি জরুরি সেবার বুথ, সব সরঞ্জামে পরিপূর্ণভাবে সজ্জিত একটি সন্তান প্রসবের কক্ষ, একটি প্রসবোত্তর ওয়ার্ড ও একটি ল্যাবরেটরি আছে, যেখানে আল্ট্রা-সনোগ্রাম ও অন্যান্য পরীক্ষা করা হয়। এর পাশাপাশি এখানে একটি ‘ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার’ কক্ষও রয়েছে। রোহিঙ্গা মায়েদের মধ্যে নবজাতক ও ছোট শিশুদের খাদ্যভ্যাস (ইনফ্যান্ট অ্যান্ড ইয়াং চাইল্ড ফিডিং- আইওয়াইসিএফ) সম্পর্কিত জ্ঞান এবং চর্চা বাড়াতে ইউনিসেফ পুষ্টি বিষয়ক পরামর্শ প্রদানের পাশাপাশি শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানো ও সর্বোত্তম পরিপূরক খাবার দেওয়ার অনুরোধ জানায়। পুষ্টি কেন্দ্রগুলোতে একজন পরামর্শকের মাধ্যমে সরাসরি পরামর্শ সেবা দেওয়া হয়।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানায়, রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে বসবাসকারী প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার অর্ধেকেরও বেশি হচ্ছে শিশু। জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিতে তাদের অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমেই সবাইকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী রোহিঙ্গা শিশুর প্রায় শতভাগকে টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্ব এবং ইউএনএইচসিআর, জাতিসংঘের অন্যান্য সংস্থা, মানবিক অংশীদার ও আশ্রয়প্রার্থী স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তার মাধ্যমে। এক লাখ ১০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা শিশু ও কিশোর কভিড-১৯-এর প্রথম ডোজ টিকা পেয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির আওতায় এবং জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও), ইউনিসেফ ও অন্যান্য মানবিক সংস্থার সহায়তায় এ টিকা দেওয়া হয়েছে। প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা কভিড-১৯ টিকার প্রথম ডোজ পায়। ১২ থেকে ১৭ বছর এবং ১৮ বছরের বেশি বয়সী রোহিঙ্গাদের ৯০ শতাংশই টিকা পায়। টিকা গুরুতর কভিড সংক্রমণ কমানোর চাবিকাঠি।

বালুখালী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা মো. আলম মাঝি বলেন, আমরা বাংলাদেশের কাছে কৃতজ্ঞ এবং রোহিঙ্গা জনগণের অসাধারণ সহিষ্ণুতা ও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয়দানকারী স্থানীয় জনগণের উদারতায় অত্যন্ত মুগ্ধ হই ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।

এদিকে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার সবার জন্য বিশেষ করে মেয়েদের জন্য শিক্ষার সুবিধা নিশ্চিত করার উপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেয় এবং একইভাবে, সরকার ক্যাম্পের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য শিক্ষা কার্যক্রম সহজতর করছে। এটি গভীর উদ্বেগের বিষয় যে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক (এফডিএমএন)/রোহিঙ্গা শিশুদের শেখার সুবিধা সম্পর্কে অপপ্রচার করা হচ্ছে, যখন বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ সংস্থাগুলোর সঙ্গে মিয়ানমারের পাঠ্যক্রমের আওতায় ধীরে ধীরে শেখার সুবিধা আনতে, স্বেচ্ছাসেবকদের প্রবাহিত করার জন্য কাজ করছে। শিক্ষকদের ব্যস্ততা এবং তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নীতি গ্রহণ করছে সরকার। শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করা, শিক্ষক বা শিক্ষার্থীদের সেখানে উপস্থিত হতে বাধা দেওয়ার খবর মিথ্যা ও বানোয়াট। প্রায় ৫ হাজার ৬১৭ রকম শিক্ষার সুবিধার মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার ক্যাম্পের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য শেখার সুযোগের ব্যবস্থা করেছে। যার সবগুলোই চালু আছে এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শিক্ষা সেক্টর অপারেটর বা ইউনিসেফ (শিক্ষার প্রধান সংস্থা) কোনো শিক্ষার সুবিধা বন্ধ করার বিষয়ে কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেনি। এফডিএমএন শিশুরা ইউনিসেফ এবং ব্র্যাকের অধীনে ‘লার্নিং কম্পিটেন্সি ফ্রেমওয়ার্ক অ্যান্ড অ্যাপ্রোচ (এলসিএফএ)’ নামের একটি পাঠ্যক্রম সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ক্যাম্পে অধ্যয়ন করে। ২০২১ সালের শেষ থেকে, মিয়ানমার কারিকুলাম পাইলট (এমসিপি) নামে একটি পাইলট প্রকল্প, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চালু করা হয়েছে যা মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে এবং প্রাথমিকভাবে মিয়ানমারের ভাষায় পরিচালিত হয়। এটি ধীরে ধীরে এলসিএফএ প্রতিস্থাপন করবে।

ইউনিসেফ হলো শিবিরের অভ্যন্তরে মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম বিনামূল্যে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে শেখার কেন্দ্রে চালু করার জন্য প্রধান সংস্থা এমনটা জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সহায়তায় সরকারি সংস্থাগুলো মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম অনুসারে শিক্ষার ব্যবস্থা করছে যা প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীকে তাদের সংস্কৃতি, মাতৃভাষা এবং জাতীয় পরিচয়ের সঙ্গে উন্মোচিত হতে সাহায্য করবে। এটি তাদের স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনের পরে রাখাইন রাজ্যে তাদের পূর্বপুরুষদের সমাজে সুষ্ঠুভাবে পুনঃএকত্রীকরণকে সহজতর করবে। কোভিড-১৯ সম্পর্কিত বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য পরামর্শের পর, শিক্ষাকেন্দ্রগুলোকে অত্যন্ত জনাকীর্ণ রোহিঙ্গা শিবিরে স্থগিত করা হয়েছিল এবং করোনাভাইরাস পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রাক-কোভিড পরিস্থিতি হিসেবে পুনরায় চালু করা হয়েছে। এখন বাংলাদেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতোই সব শিক্ষা সুবিধা নিয়মিত চলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *