এভারেস্ট আরোহনের ৭০ বছরেও যে বিতর্কের সমাধান মেলেনি

এভারেস্ট আরোহনের ৭০ বছরেও যে বিতর্কের সমাধান মেলেনি

ফিচার স্পেশাল

মে ৩০, ২০২৩ ৮:২২ পূর্বাহ্ণ

সাউথ কলে তুষার ঝড়ে আটকে পড়ে দু’টো দিন নষ্ট করে ২৮ মে ৮ হাজার ৫০০ মিটার উচ্চতায় বহু কষ্টে তাঁবু ফেলেন। ভয়ংকর সেই অনিশ্চয়তার সেই রাতটি কোন ভাবে কাটল। ঈশ্বর তাদের সহায় হয়েছিলো ঠিকই। তাই তো পরিস্কার ও শান্ত আকাশ পেয়েছিলেন। কিন্তু সামনে অপেক্ষা করছে চল্লিশ ফুট উচ্চতার পাথরের খাড়া দেয়াল। একবার পা ফসকালেই জীবন শেষ, তারা দুজনেই ভালো করেই জানেন। তাই বলে কি তারা এখানেই থেমে যাবেন? না। পায়ের নীচে সকল মৃত্যুফাঁদকে উপেক্ষা করে এগিয়ে গেছেন তারা। ১৯৫৩ সালের ২৯ মে আজকের এই দিনে ঠিক সকাল ১১:৩০ মিনিটের সেই ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণে অজয় অক্ষয় পৃথিবীর সর্বোচ্চ উচ্চতার পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টের (৮ হাজার ৮৪৮.৮৬ মিটার বা ২৯ হাজার ৩১.৭ ফুট) শিখরে পা রাখলেন এডমন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগে।

‘নয় নম্বর ক্যাম্পের সেই সকালের কথা আমার খুব মনে পড়ে। ২৮ হাজার ফুট উচ্চতায় ছোট্ট একটি তাবুতে আমি এবং হিলারী সেই রাতটি কাটিয়ে ছিলাম। আর এই রাতটিই ছিলো আমাদের সর্বোচ্চ উচ্চতার ঘুম। রাতে প্রচন্ড ঠান্ডা পড়েছিল। হিলারির বুট জোড়া তাবুর বাইরে থাকায় ঠান্ডায় জমে গিয়েছিল। আমরাও প্রায় ঠান্ডায় জমে গিয়েছিলাম। যখন আমরা হামাগুড়ি দিয়ে তাবুর বাহিরে তাকালাম তখন দেখতে পেলাম চারদিকে ধূসর আলো। বাতাসও তেমন ছিল না। আকাশটা ছিল পরিষ্কার ও শান্ত। আমরা দেখছি। সপ্তাহ মাস ধরে। এভারেস্টের চূড়া আমাদের নিকটেই। এখন শুধু পার্থক্য এটুকুই যে, আমাদের থেকে মাত্র হাজার ফুট দূরের উচ্চতায় অজেয় সেই চূড়া। আমাদের আকাশসম স্বপ্নটা এখন আর দূরের স্বপ্ন নয়। কিন্তু এটাও সত্য যে, শক্ত পাথর ও তুষার আরোহণ কঠিন হবে। তবু আমরা প্রস্তুত এবং এটি আমরা আরোহণ করবো। ঈশ্বরের সাহায্যে অবশ্যই আমরা শেষ পর্যন্ত আরোহণ করবো।’ এভারেস্টের চূড়ায় আরোহন প্রসঙ্গে এভাবেই অনুভূতি প্রকাশ করেছেন তেনজিং নোরগে।

সকল প্রতিবন্ধকতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মানুষের জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে বীরের বেশে হিলারি-তেনজিং নেমে এলেন এভারেস্ট আরোহনের বিস্ময়কর গল্প নিয়ে। শিখর আরোহন করে নেমে আসার পর যে মানুষটির সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল তিনি ছিলেন এই ঐতিহাসিক অভিযানের আরেকজন সদস্য জর্জ লোয়ে। তিনি ছিলেন হিলারির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। জর্জ লোয়ে হিলারি ও তেনজিং এর জন্য গরম স্যুপ হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। বন্ধুকে দেখে হিলারি কাছে এসে বলেছিলেন, ‘Well, George, we knocked the bastard off.’ তার এই কথাটি এখন ঐতিহাসিক অনুভূতি প্রকাশ হিসেবে অমর হয়ে আছে।

এভারেস্টে প্রথম অভিযান হয় ১৯২১ সালে। তারপর ১৯২২ ও ১৯২৪ সালে আরো দুটি অভিযান হয়। আর এই তিনটি অভিযানেই অংশ নেন বিখ্যাত পর্বতারোহী জর্জ ম্যালোরি। তিনি ছিলেন পাইওনিয়ার ব্রিটিশ পর্বতারোহী। তিনি পৃথিবীর সব পর্বতারোহীর পথিকৃৎ ও একজন অনুপ্রেরণাদানকারী পর্বতারোহী। এভারেস্টে তাঁর তৃতীয় অভিযানের সময় ১৯২৪ সালের ৮ জুন বেলা ১২:৫০টায় তাঁকে ও সঙ্গী এ্যান্ড্রু আরভিনকে শেষবারের মতো দেখা যায় শিখর থেকে ৮০০ ফুট নিচে। মাত্র ৩৮ বছর বয়সে এভারেস্টের চিরশ্রেষ্ঠ প্রতিদ্বন্দ্বী চিরতরে হারিয়ে যান সেই এভারেস্টেই।

জর্জ ম্যালোরি ও এ্যান্ড্রু আরভিন। Image: Chester Chronicle

জর্জ ম্যালোরি ও এ্যান্ড্রু আরভিন। Image: Chester Chronicle

হিলারি ও তেনজিংয়ের এভারেস্ট আরোহনের ঠিক আগের বছর ১৯৫২ সালের শুরুতে এক সুইস অভিযাত্রি দল এভারেস্ট অভিযান করে। প্রচন্ড খারাপ আবহাওয়ার কারণে তারা চূড়া থেকে মাত্র ৮০০ ফুট নীচ থেকে ফিরে এসেছিলেন। ১৯৫৩ সালে শুরু হলো ব্রিটিশ অভিযান। জন হান্টের নেতৃত্বে এই অভিযাত্রি দলের সদস্য হিসেবে ছিলেন টম বুর্দিল, চার্লস ইভান্স, আলফ্রেড গ্রেগরি, জর্জ লোয়ে এবং এডমন্ড হিলারিসহ আরো অনেক বিখ্যাত সব পর্বতারোহী। এই অভিযান ছিল সকল দিক থেকেই ঐতিহাসিক। ২০ জন শেরপা, ৩৬২ জন কুলি, চারশতাধিক অভিযাত্রি এবং তাদের জন্য দশ হাজার পাউন্ড মালপত্র নিয়ে ছিল এই বৃহৎ অভিযান।  ২৬ মে প্রথম শৃঙ্গজয়ের চেষ্টা করেন টম বুর্দিল ও চার্লস ইভান্স। কিন্তু ইভান্সের অক্সিজেন সিলিন্ডার সমস্যা দেখা দিলে চূড়া ৩০০ ফুট নীচ থেকে ফিরে আসেন। এরপর চূড়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ান হিলারি এবং তেনজিং। আর তারাই ইতিহাস রচনা করেই ফিরে আসেন।

এভারেস্ট জয়ের খবর সারা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে গেল। হিলারি ও তেনজিং হয়ে উঠলেন জাতীয় বীর। অভিযানের দলনেতা জন হান্ট ও হিলারিকে ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথ ‘নাইটহুড’ উপাধিতে ভূষিত করলেন। আর তেনজিং নোরগে ব্রিটিশ উপনিবেশের নাগরিক না হওয়ার কারণে ‘নাইটহুড’ উপাধি পেলেন না। তবে বিদেশিদের জন্য সর্বোচ্চ সম্মান ব্রিটিশ এম্পায়ার মেডেল বা জর্জ মেডেল লাভ করেন। এরপর শুরু হলো নতুন প্রশ্ন, হিলারি না তেনজিং এভারেস্টে আরোহন করেছেন? এটা শুধু একটা প্রশ্নের মধ্যেই আটকে রইলো না, জন্ম দিলো নতুন এক বিতর্কের।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই বিষয় নিয়ে এডমন্ড হিলারি বলেন, ‘১৯৫৩ সালের ২৯ মে’র সেই সকাল থেকেই, যখন তেনজিং এবং আমি প্রথমবারের মত পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ আরোহণ করতে সক্ষম হলাম, আমাকে এক মহান অভিযাত্রি হিসেবে বর্ণনা করা হতে থাকে। কিন্তু আমি আসলে বরফে এক পোড় খাওয়া কিউই, যে জীবনের বহু প্রতিকূলতাকে উপভোগ করেছে মনে-প্রাণে।’ হিলারি তার নিজের আত্মজীবনী ‘High Adevntures’ এবং তার আরেকটি বই ‘View from the Summit’-এ লিখেছেন, ‘আমরা একসঙ্গে শীর্ষে পৌঁছালাম।’

এই প্রশ্নের উত্তর যে শুধু হিলারিকেই দিতে হয়েছে তা কিন্তু নয়। এক হিলারির উত্তরে এই বিতর্কের অবসান ঘটলো না। তেনজিংকেও এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে অসংখ্যবার। তারা এক পর্যায়ে এই প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তেনজিং একটা সময় বিরক্ত হয়ে জবাব দেন, ‘যদি এভারেস্টে হিলারির এক কদম পিছনে থেকে দ্বিতীয় মানুষ হিসেবে আরোহণ কোন লজ্জাজনক বিষয় হয়ে থাকে, তাহলে এই লজ্জা নিয়েই আমাকে বাকি জীবন অতিবাহিত করতে হবে।’

এভারেস্টের চূড়ায় আইস-এক্স হাতে তেনজিং নোরগে দাঁড়িয়ে আছেন

এভারেস্টের চূড়ায় আইস-এক্স হাতে তেনজিং নোরগে দাঁড়িয়ে আছেন

তিনি তার আত্মজীবনী ‘Man of Everest’ বইতেও এই বিষয়ে স্পষ্ট করেই বলেন, হিলারিই প্রথম শিখর জয় করেছিলেন এবং সেই চল্লিশ ফুট উঁচু আপাত-অসম্ভব পাথুরে দেওয়ালটি, যার নামকরণ পরবর্তীতে করা হয় ‘হিলারি স্টেপ’, অতিক্রমের উপায় হিলারিই খুঁজে বের করেছিলেন এবং আমি তাকে কেবল অনুসরণ করে শিখরে পৌঁছেছিলাম।

প্রথম এভারেস্ট আরোহনের সময় চূড়ায় দাঁড়ানো শুধুমাত্র একটি ছবিই সারা পৃথিবী দেখেছে। আর সেই ছবিতে আইস-এক্স হাতে তেনজিং নোরগে দাড়িয়ে আছে। এভারেস্টের চূড়ায় হিলারির কোন ছবি নাই। এই ছবি নিয়েও অনেক প্রশ্ন উঠে। আর তার জবাবে তেনজিং বলেন, “আমি হিলারির ছবি তুলে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু অজ্ঞাত কোন কারণে হিলারি নিষেধ করেন এবং বলেন, ‘শিখরে কে আগে উঠেছে সেটা কাউকে না বলতে।’ হিলারি যে শুধু একজন এভারেস্ট আরোহনকারী বিখ্যাত পর্বতারোহীই ছিলেন না, তিনি এভারেস্টের মতো বড় মনের মানুষও ছিলেন।”

প্রচারবিমুখ মানুষ এই হিলারিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ‘থার্ড পোল’ বা ‘তিন মেরু’ অর্থাৎ পৃথিবীর তিন মেরু-উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরু এবং এভারেস্ট জয় করেন। ভাবতে অবাক লাগছে? তাহলে আসুন আরো একটু অবাক করা তথ্য দেই। উত্তর মেরু জয়ের সময় তার সাথে সঙ্গী হিসেবে ছিলেন চাঁদে পা রাখা প্রথম মানুষ নীল আর্মস্ট্রং।

এভারেস্ট অভিযানে বাংলাদেশের পর্বতারোহীরাও পিছিয়ে নেই। পর্বতারোহী এম এ মুহিত ২০১১ ও ২০১২ সালে এভারেস্ট আরোহন করেন। দেশের প্রথম নারী হিসেবে ২০১২ সালে এভারেস্ট আরোহন করেন নিশাত মজুমদার এবং দ্বিতীয় নারী হিসেবে একই বছর এভারেস্ট আরোহণ করেন ওয়াসফিয়া নাজরীন। ২০১৩ সালে পর্বতারোহী সজল খালেদ এভারেস্ট আরোহণ করে নেমে আসার পথে মৃত্যুবরণ করেন। ২০১০ সালে দেশের আরেক পর্বতারোহী মুসা ইব্রাহীম এভারেস্ট আরোহনের দাবি করলেও তা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে।

যাইহোক এভারেস্ট অভিযান শুরু হয়েছিল সেই ১৯২১ সালে যা এখনো থামেনি। যদিও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে অভিযান সাময়িক বন্ধ থেকেছে। প্রতিবছরই অজয়কে জয় করার রোমাঞ্চ প্রিয় দুঃসাহসিক মানুষগুলো অজানা আকর্ষণে সম্মোহিত হয়ে ছুটে আসে এই মহাধিরাজ শ্বেতশুভ্র পুতপবিত্র এভারেস্টের কাছে। কেউ কেউ তার লক্ষ্যে পৌঁছায়, কেউ বা হরিয়ে যায় বরফ শীতলতায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *