প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য থেকে শুরু করে অধুনিক সাহিত্যেও বঙ্গ-বালার শ্বাশত সুন্দর রূপের প্রতিচ্ছবি আঁকতে কাজল কালো চোখ, আর কপালে টিপের কথা বহু জায়গায় উল্লেখ করেছেন সাহিত্যিকেরা। উপমহাদেশে টিপের ইতিহাস বেশ পুরানো।
বেদ, মহাভারত কিংবা রামায়ণের নারী-পুরুষের উভয়েরই টিপ ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। মানবসভ্যতায় বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সৌন্দর্য ভাবনার শুরু হয়। এজন্য শুধু নারীরাই নয়; পুরুষেরাও প্রসাধন এবং সাজে যত্নশীল ছিলেন। পুরুষেরা লম্বা-কোঁকড়ানো চুলে সুগন্ধি তেল মাখাতেন; নখও রাঙাত।
ঋকবেদেও টিপের উল্লেখ রয়েছে, এ থেকে বোঝা যায় প্রায় পাঁচ বছর ধরে টিপের প্রচলন রয়েছে। ষাট-সত্তরের দশকের নারীরাও কপালের ভ্রু’র বেশ কিছুটা ওপরে মাঝারি কিংবা ছোট্ট টিপ পরতেন। সম্প্রতি নারী শিক্ষকের টিপ পরা নিয়ে পুলিশ সদস্যের কটূক্তির রেশ ধরে গণমাধ্যম ও সামাজিকমাধ্যমে তোলপাড় চলছে।
ভারতীয় উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে মানুষের মনে ‘ভাগকর শাসন কর’ নীতির যে বিরূপ প্রভাব বিরাজমান, তার কারণেই ভারতে হিজাব বিতর্ক কিংবা বাংলাদেশে টিপ বিতর্কের সৃষ্টি। কিন্তু সহজেই বোঝা উচিত জাতীয় সংস্কৃতি আর ধর্মীয় সংস্কৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
কোনো অঞ্চলের মানুষের জীবন অভ্যাস গড়ে ওঠেছে তার সংস্কৃতি আর ধর্মীয় বিশ্বাস দিয়ে। তবে ধর্মবোধ জীবনে প্রভাব ফেলে এও সত্য। তাই বলে সব জাতিরই নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে, যা ধর্মবোধের বাইরে থেকে স্বতন্ত্র। শুধু ধর্ম বিশ্বাস দিয়ে জাতি রাষ্ট্র তৈরি যে অসম্ভব, তা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সারা বিশ্বে প্রমাণিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিকও ছিল সাংস্কৃতিক মুক্তি।
পাকিস্তান সরকার ‘কালমে ইকবাল’ বাধ্যতামূলক করে রবীন্দ্র সঙ্গীত বন্ধ করে দিয়েছিল। ফলাফল স্বরূপ বাঙালি মনে ক্ষোভ বেড়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সনাতন জনগোষ্ঠী মুসলিম হয়নি। আবার জাতীয় কবি পূর্ব দেশের নারীর পরিচয়ে যখন লেখেন, ‘শঙ্খ নগর হতে আনিয়াছি শাঁখা, অভয় শঙ্খ। ছিল ছেনে এনেছি সুনীল কাজল, বিল ছেনে অনাবীল চন্দন পঙ্খ।’
তখন ধর্মীয় সংস্কৃতির চোখে সনাতন নারীর রূপ দেখেন রক্ষণশীল মুসলিম সমাজ। একই কবি যখন লু হাওয়ায় ওড়না উড়ানো পরী নটিনীকে দেখেন, তখন আবার রক্ষণশীল সমাজের চোখে সেটা পরিচিত। কারণ পরী নটিনী বাঙালি হলেও লু হাওয়া আরব মরু থেকে আগত। সব কিছুর ঊর্দ্ধে জাতীয় সংস্কৃতি আর ব্যক্তি স্বাধীনতা। কারণ নাগরিকের নান্দনিক ভাবনা একান্ত তার ব্যক্তিগত, সেখানে ধর্ম, রাষ্ট্র বা আইনের বেড়াজাল না-থাকাই উত্তম।