ঝিনাইদহে ড্রাগনের নিঃশ্বাসে অর্থনৈতিক স্বস্তি

দেশজুড়ে স্পেশাল

সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৩ ৩:৪৪ অপরাহ্ণ

আতিকুর রহমান, ঝিনাইদহ প্রতিনিধি : ঝিনাইদহের মাঠে মাঠে রঙ ছড়িয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে আফ্রিকান ফল ড্রাগন। অর্থনৈতিক স্বস্তির নতুন আলোর সন্ধান খুঁজে পেয়েছেন স্থানীয় চাষীরা। ফলে ঝিনাইদহ এখন ‘ড্রাগন জেলায়’ রূপ নিয়েছে।

চলতি মৌসুমে ঝিনাইদহ জেলায় সাড়ে তিন’শ কোটি টাকার ড্রাগন ফল বিক্রি হবে বলে আশা ব্যক্ত করছেন কৃষকরা। কৃষকদের ভাষ্য এ জেলায় দ্রুত বাড়ছে ড্রাগন ফলের চাষ। লাভ বেশি হওয়ায় ঝিনাইদহের কৃষকরা ড্রাগন চাষে ঝুকছে। চলতি বছরে ঝিনাইদহে ৬ হাজার ২২৫ বিঘা জমিতে (৮৩০ হেক্টর) ড্রাগন ফলের চাষ হয়েছে। ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এই জেলায় আনুমানিক সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার ড্রাগন ফল উৎপাদন হবে।

তথ্য নিয়ে জানা গেছে, ২০০২ সালের দিকে প্রথম ঝিনাইদহে জেলায় শখের বশে অনেকে ড্রাগন ফল চাষ করতেন। ২০১৬ সালের দিকে জেলার কালীগঞ্জের কৃষক বোরহান উদ্দিন ও শহিদুল ইসলাম বানিজ্যকভাবে ড্রাগন ফলের চাষ শুরু করেন।

ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ড. আব্দুর রহিমের মাধ্যমে ঝিনাইদহের কৃষকরা চারা সংগ্রহ করেন। তাদের দেখাদেখি আরো অনেকে বাণিজ্যিকভাবে ড্রাগন ফল চাষ শুরু করেন। অনেকে এ ফলের চাষ করে লাভবান হয়েছেন। তাদের একজন কালীগঞ্জ উপজেলা শিবনগর গ্রামের সুরত আলী। তিনি জানান, ২০১৭ সাল থেকে তিনি ড্রাগনের চাষ শুরু করেন। ২৫ বিঘা জমির ওপর তার ড্রাগন বাগান। প্রথম বছর ফল কম ধরে। বাগানের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে ফল উৎপাদন বাড়তে থাকে।

কৃষক সরোত আলীর ভাষ্যমতে, এক বিঘায় ড্রাগনের বাগান করতে দেড় লাখ টাকা খরচ হয়। এ বছর আবহাওয়া বৈরী। এজন্য ফল কম ধরছে। তবে বিঘাপ্রতি ৫ লাখ টাকার ফল বিক্রি হবে বলে তিনি আশা করেন। কালীগঞ্জ উপজেলা তত্তীপুর গ্রামে ১৬ বিঘাতে ড্রাগনের বাগান করেছেন ঝিনাইদহের তরুণ উদ্যোক্তা আহসানুল ইসলাম ডন। তিনি পাঁচ বছর ধরে ড্রাগনের চাষ করছেন। ড্রাগন চাষ করে তিনি স্ববলম্বি হয়েছেন।

জেলার হরিণাকুন্ডু পৌরসভার মান্দারতলা গ্রামের কৃষক বিপ্লব জাহান ওরফে রবিউল পায়রাডাঙ্গা গ্রামের চারাতলা বাজার এলাকায় ১১ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন আল্ট্রা হাইডেনসিটি ড্রাগন বাগান। যার নাম দিয়েছেন “বাংলা পদ্ধতি”। যেখানে এক বিঘায় ৮৫০টি চারা রোপণ করেন, সেখানে বিপ্লব জাহানের এই বাগানে ২ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ চারা লাগানো হয়েছে। যা স্বাভাবিকের চেয়ে তিন গুণ বেশি। এতে ফলনও হচ্ছে তিন গুণ। কৃষক বিপ্লব জাহান জানান, ডিপ ইরিগেশন সিস্টেমের মাধ্যমে লাগানো তার বাগানের প্রতিটি গাছ সমানভাবে খাদ্য, পানি ও পুষ্টি পাচ্ছে। পানির কোনো অপচয়ও নেই এই পদ্ধতিতে। এই বাগানে বিঘা প্রতি ১০ টন করে ফলন আশা করছেন তিনি।

কোটচাঁদপুর উপজেলার ড্রাগন চাষী হারুন-অর রশিদ মুসা বলেন, ড্রাগন ফলে আয় বেশি তবে সাধারণ কৃষকরা পুরোপুরি সুফল পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, প্রথম দিকে এই ফলের বাগান তৈরি করতে খরচের পরিমাণ বেশি হয়। যে কারণে সাধারণ কৃষকরা ইচ্ছে করলেও ড্রাগান চাষ করতে পারেন না। ফলে তাদের নাগালের বাইরেই রয়ে যাচ্ছে এ অপার সম্ভাবনার হাতছানি।

কালীগঞ্জ উপজেলা বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের শেখ আবুল কাশেমের ছেলে ড্রাগন চাষী রাসেল আহমেদ বলেন, একবার এই ফলের বাগান তৈরি করতে পারলে ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। এতে একজন কৃষকের ভাগ্য বদলাতে
সহজ হয়।

ঝিনাইদহ শহরের উপ-শহর পাড়ার ড্রাগন চাষি হাফেজ আকতার হোসেন জানান, বর্তমান পাইকারি বাজারে এ গ্রেড ড্রাগন ফল ২৬০ টাকা কেজি ও বি গ্রেড ফল ১৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ফল ভালো হলে বিঘাপ্রতি ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা আয় হয়। ফলের দোকানগুলোতে অন্যান্য ফলের সঙ্গে ড্রাগন ফল বিক্রি হচ্ছে। চাহিদাও ভালো। মহেশপুর উপজেলার গৌরীনাথপুর গ্রামের মফিজুর রহমান বলেন, দুই বছর আগে ড্রাগন ফলের চাষ শুরু করেছেন। তার ১৫ বিঘার ওপর ড্রাগন বাগান। তিনি জানান, এ বছর বৃষ্টি কম ও গরমের কারণে ফলন কম হচ্ছে। এতে লাভ কম হবে।

গৌরীনাথপুর গ্রাম জুড়ে শুধুই ড্রাগন ফলের বাগান। এসব বাগানে কর্ম করে শত শত মানুষ জীবিকা অর্জন করছেন। গৌরীনাথপুরে ড্রাগনের হাট বসেছে ১০ মাস আগে। সেখানে অন্তত ৫০টি আড়তে ড্রাগন ফল কেনাবেচা চলে। এই বাজার থেকে ড্রাগন ফল ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ফেনী, নোয়াখালী, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, নওগাঁ, সৈয়দপুর ও নিলফামারীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যাচ্ছে।

বাজারের আড়তদার জসিম উদ্দিন জানান, গৌরীনাথপুরে তিনি প্রথম ড্রাগন ফল কেনাবেচার আড়ত খোলেন। তার দেখাদেখি আরো অনেকেই আড়ত খুলেছেন। তিনি জানান, বর্তমানে প্রতিদিন গৌরীনাথপুর হাটে তিন থেকে চার কোটি টাকার ড্রাগন কেনাবেচা হয়। তিনি নিজেই প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকার ড্রাগন ফল কেনাবেচা করেন বলে জানান।
এ বিষয়ে ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আজগর আলী বলেন, এই জেলায় অন্য ফসলের চেয়ে ড্রাগন ফলের চাষ বাড়ছে। এ পর্যন্ত ৮৩০ হেক্টর জমিতে ড্রাগনের চাষ হয়েছে। দিনকে দিন ড্রাগন ফলের চাহিদাও বেড়ে চলছে। হাটবাজারে ফলের দোকানগুলোতে প্রচুর ড্রাগন ফল শোভা পাচ্ছে। বিক্রিও ভালো হয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তারা ফলের জাত ও মান উন্নয়নের জন্য কারিগরি পরামর্শ দিচ্ছেন বলেও তিনি জানান।এদিকে ঝিনাইদহের কিছু অসাধু কৃষক ড্রাগনে ক্ষতি কারক হরমোন বা টনিক প্রয়োগ করে দ্রুত ফল বর্ধমান প্রক্রিয়া চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে মানবদেহের জন্য ক্ষতি সাধিত হবে বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র।

/এসএস/শীখ/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *