সায়েন্সল্যাবে দুর্ঘটনা: তিন কারণ সামনে রেখে চলছে তদন্ত

সায়েন্সল্যাবে দুর্ঘটনা: তিন কারণ সামনে রেখে চলছে তদন্ত

দেশজুড়ে স্লাইড

মার্চ ৭, ২০২৩ ১০:২৩ পূর্বাহ্ণ

রাজধানীর সায়েন্সল্যাবের শিরিন ম্যানসনের বিস্ফোরণ হয়েছে জমে থাকা মিথেন গ্যাস থেকে। কোনো বদ্ধ জায়গায় বাতাসে ৫ শতাংশ মিথেন গ্যাস থাকলেই তা ঝুঁকিপূর্ণ। এমন মাত্রায় মিথেনের উপস্থিতিতে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট বা যেকোনো উৎস থেকে সামান্য স্পার্ক (স্ফুলিঙ্গ) হলেই ঘটতে পারে বড় ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনা। অথচ সায়েন্সল্যাবের ভবনটির তৃতীয়তলায় বিস্ফোরণের পরও সময়ভেদে ৫ থেকে ১১ মাত্রায় মিথেনের উপস্থিতি ছিল। যা ঝুঁকিপূর্ণ মাত্রার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। তবে বিস্ফোরণের আগে এই গ্যাসের পরিমাণ আরও বেশি ছিল। তদন্তসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
রোববারের বিস্ফোরণের পর বিষয়টি নিয়ে একাধিক সংস্থা তদন্ত করছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। পাশাপাশি সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, সিআইডি ও বিস্ফোরক পরিদপ্তরও বিস্ফোরণের ঘটনাটি নিয়ে কাজ করেছে। ইতোমধ্যে সবাই নিশ্চিতভাবে জানিয়েছে, এটি নাশকতা নয়, দুর্ঘটনা। বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট নিশ্চিত হয়েছে, বিস্ফোরণের উৎপত্তি হয়েছে তৃতীয়তলার ফিনিক্স ইন্সুরেন্স কোম্পানি লি. থেকে।
জানতে চাইলে সিটিটিসি’র বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিটের প্রধান অতিরিক্তি উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, ভবনটির তৃতীয়তলার বদ্ধ এসি কক্ষে মিথেন জমা হয়। এখন আমরা গ্যাসের উৎস নিয়ে কাজ করছি। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ দলেরও মতামত নিচ্ছি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্যাসের উৎস নির্ধারণে সম্ভাব্য তিনটি বিষয় সামনে রেখে চলছে তদন্ত। সেগুলো হলো-ভবনটিতে পুরোনো কোনো গ্যাস সংযোগ রয়েছে কিনা এবং থাকলে তার বর্তমান অবস্থা। দ্বিতীয়ত, বর্জ্য বা সুয়ারেজ লাইন থেকে গ্যাস এসেছে কিনা। তৃতীয়ত, এসি বা সিলিন্ডার থেকে কোনো গ্যাস জমা হয়েছে কিনা।
সিটিটিসির তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাস যে সবসময় বিস্ফোরণস্থল থেকেই জমা হবে এমন নয়। অনেক সময় ৫০ মিটার দূর থেকেও সেটি জমা হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে রোববার থেকে দফায় দফায় বৈঠক করেছে সিটিটিসির বিশেষজ্ঞ দল। সবারই কথা হলো-বিস্ফোরণস্থলই গ্যাসের উৎপত্তিস্থল এমন নয়। গ্যাসের কনসিলড লাইন (গোপন লাইন) থেকে এমনটি হয়েছে। একটি বিল্ডিংয়ে এমন অনেক লাইন থাকতে পারে। এসব লাইন থেকে আবার চ্যানেল সৃষ্টি হতে পারে। পুরোনো ভবন হওয়ায় এই ঝুঁকি আরও বেশি। তবে ঘটনাস্থলে হাইড্রোজেন সালফাইডের উপস্থিতি ছিল কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
মিথেন গ্যাসের সহনীয় মাত্রা এবং ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এ এস মাকসুদ কামাল যুগান্তরকে বলেন, মিথেন গ্যাস দাহ্য পদার্থ। বদ্ধ রুমে বাতাসে মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি ৫-১৫ শতাংশ বা তার বেশি হলে সেটি ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে যদি কোনো আগুনের উৎস থাকে, সেটা হোক স্পার্ক, ম্যাচের কাঠি বা অন্য কিছু; তাহলে বড় ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটবে।
তদন্তকারীরা জানান, শিরিন ম্যানসনের তৃতীয়তলায় তিনটি প্রতিষ্ঠান ছিল। বিস্ফোরণের উৎপত্তিস্থল ফিনিক্স ইন্সুরেন্স কোম্পানি লি. হলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নিউ জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড। ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানটির তিন কর্মী নিহতও হয়েছেন। এর কারণ হিসাবে তদন্তকারীরা বলছেন, জমে থাকা গ্যাসে বিস্ফোরণের শক্তি সঞ্চার হলে সেগুলো বেরিয়ে যেতে ভবনের শক্তিশালী অংশের পরিবর্তে দুর্বল অংশের দিকে যায়। প্রাথমিকভাবে তারা ধারণা করছেন, ভবনটির নিউ জেনারেশন কোম্পানির অংশটির অবকাঠামো তুলনামূলক দুর্বল ছিল। তদন্তকারীদের এমন ধারণার সঙ্গে মিলে যায় নিউ জেনারেশন কোম্পানির স্বত্বাধিকারী আকরাম হোসেনের বক্তব্যও। শিরিন ম্যানসনের দুর্বল অবকাঠামোর বিষয়ে জানিয়ে তিনি বলেন, এর আগেও বেশ কয়েকবার ভবনের মালিককে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সম্পর্কে জানিয়েছিলাম। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
এদিকে সোমবার এক অনুষ্ঠানে সায়েন্সল্যাবের বিস্ফোরণের বিষয়ে কথা বলেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘এটা বড় দুর্ঘটনা। প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, সম্ভবত দীর্ঘদিন জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।’
আহত আটজনের অবস্থা গুরুতর : এদিকে বিস্ফোরণের ঘটনায় আহতদের মধ্যে আটজনের অবস্থা গুরুতর। এর মধ্যে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি দগ্ধ ছয়জনের অবস্থা শঙ্কামুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আহত দুজনের শারীরিক অবস্থাও ভালো নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট সূত্র জানায়, বিস্ফোরণের পর আগুনে দগ্ধ নূর নবী, আকবর আলী, আশরাফুজ্জামান, আশা, হাবিবুর রহমান এবং জহুর আলী নামে ছয়জন সেখানে ভর্তি হন। তাদের সবারই শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। এরা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা আছে বলে জানিয়েছেন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন। তাদের প্রয়োজনে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হবে বলেও জানান ডা. সেন।
বিস্ফোরণের ঘটনায় জিডি : ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, বিস্ফোরণের ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। এর মাধ্যমে তদন্ত করে বিস্ফোরণের কারণ বেরিয়ে এলে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। যেহেতু এটি টেকনিক্যাল বিষয়, তাই কোন ধারায় মামলা হবে সেটি বোঝার বিষয় আছে। এর আগে ধারা দেওয়া যাচ্ছে না। তবে নিহতের পরিবার বা ভুক্তভোগীরা মামলা করলে, তা নিয়ে আমরা তদন্ত করব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *