রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জন্মহার এত বেশি কেন?

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জন্মহার এত বেশি কেন?

জাতীয় স্লাইড

সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৩ ১২:৪৮ অপরাহ্ণ

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন গড়ে জন্ম নিচ্ছে প্রায় একশ শিশু। এরই মধ্যে গেল ছয় বছরে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দুই লাখ। এমন ঊর্ধ্বমুখী জন্মহার যেমন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, ঠিক তেমনি বড় সংকটও তৈরি করছে। ক্যাম্প জীবনে বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির এমন হার বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরগুলোর বেশির ভাগ উখিয়ার কুতুপালংয়ে। যেটিকে বলা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আশ্রয় শিবির। যেখানে ছোট একটি এলাকার মধ্যেই ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার বসবাস।

শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) সরেজমিন দেখা যায়, উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের বাসিন্দা নুর কবির সাত সন্তান ও স্ত্রীসহ নয়জনের পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন ক্যাম্পের ডি-৫ ব্লকে। এর মধ্যে বড় ছেলের বয়স ১৮ আর ছোট মেয়ের বয়স তিন বছর।

নুর কবির বলেন, ‘সাত সন্তানের মধ্যে চার ছেলে ও তিন মেয়ে। এখন যদি সামনে আল্লাহ আরও দেয় তাহলে বাচ্চা আরও নেব।’

শুধু নুর কবির নন, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয় শিবিরে বসবাস করা রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে বেশির ভাগের সন্তান সংখ্যা চারজনের বেশি। এমনকি যাদের পরিবারে পাঁচ থেকে ছয়জনের বেশি সন্তান রয়েছে তারা আরও সন্তান নিতে আগ্রহী।

কুতুপালংয়ের ক্যাম্প ২ ইস্টের বাসিন্দা খায়রুল আমিন বলেন, ‘মিয়ানমারের ওপারে আমার কোনো বাচ্চা ছিল না। বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়ার পর এই ক্যাম্পেই জন্ম নিয়েছে চারটি বাচ্চা। আর বাচ্চা দেয়া না দেয়া এটা আল্লাহর ওপর। মন চাইলে নিব, মন না চাইলে আর নিব না।’

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয় জানিয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন গড়ে জন্ম নিচ্ছে প্রায় ১০০ শিশু। এরই মধ্যে গেল ছয় বছরে জন্ম নিয়েছে ২ লাখের কাছাকাছি। ক্যাম্পে দায়িত্বরত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, পরিবার-পরিকল্পনা সম্পর্কে অনাগ্রহ, রেশন বৃদ্ধি ও ক্যাম্প জীবনে তেমন কোনো বিনোদনের ব্যবস্থা না থাকায় বেশি সন্তান জন্মদানের মূল কারণ।

উখিয়ার কুতুপালয়ের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মিডওয়াইফ সুপারভাইজার আসমা আকতার বলেন, রোহিঙ্গাদের দীর্ঘমেয়াদি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিতে কোনো আগ্রহ নেই। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে স্ত্রী-স্বামী ও শাশুড়িকে এনে কাউন্সেলিং করি। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ৩, ৫ বা ১০ বছরের পদ্ধতিগুলো একদম নিতে চায় না তারা। রোহিঙ্গারা মনে করে, বাচ্চা যত বেশি জন্ম নেবে মাথাপিছু রেশন তত বেশি হবে। এ জন্য রোহিঙ্গারা জন্মদানে বেশি আগ্রহী।

একই ক্যাম্পের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার ডা. ফাতেমা আকতার বলেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে বাচ্চা জন্মদানের প্রবণতা অনেক বেশি। কারণ, তাদের কোনো কাজ নেই। বাচ্চা জন্ম দেয়া তাদের কাছে বিনোদনের ব্যবস্থা।

এদিকে কক্সবাজার জেলার মোট জনসংখ্যা প্রায় ২৪ লাখের মতো। এখন ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক, যা নতুন করে মাথাব্যথার কারণ হিসেবে দেখছেন স্থানীয়রা।

উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গাদের যদি কন্ট্রোল করা না যায়, তাহলে তারা বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়াবে। তাদের জন্মহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাহমুদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘যেভাবে রোহিঙ্গারা লাখে লাখে একসঙ্গে এসেছিল, ঠিক এমন করেই তাদের ফেরত নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে দেখা যাবে, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রোহিঙ্গা এখান থেকে যাচ্ছে এবং তার বেশি চেয়ে রোহিঙ্গা শিশু ক্যাম্পে জন্ম নিচ্ছে।’

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের জন্মহার বাংলাদেশিদের তুলনায় বেশি। ক্যাম্পে গড়ে প্রতিদিন ১০০-র মতো শিশু জন্মগ্রহণ করছে। এটি আমাদের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ, এখানে ঘনবসতি রয়েছে, জায়গার সংকট রয়েছে। মাত্র আট হাজার একর জায়গার মধ্যে প্রায় ১০ লাখ লোক বাস করে। এখন নতুন নতুন শিশু জন্মগ্রহণ করছে তাদের জন্য আমরা জায়গা কোথায় থেকে দেব। এটা একটা বড় সংকট।’

কমিশনার মো. মিজানুর রহমান আরও বলেন, পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ চলছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাও কাজ করছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা ও ইমামদের সম্পৃক্ত করে সচেতনতার কাজ করে যাচ্ছি।

প্রতিবছর আশ্রয় শিবিরে বাড়ছে জনসংখ্যা আর কমছে খাদ্য সহায়তা। সব মিলিয়ে দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হলে নানামুখী সংকট যুক্ত হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন তিনি।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, আশ্রয় শিবিরগুলোতে মোট পরিবার রয়েছে প্রায় দুই লাখের মতো। এর মধ্যে তিন শতাংশ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১০ জনের বেশি। ১০ শতাংশ পরিবারের সদস্য সংখ্যা আট থেকে নয়জন। ২৩ শতাংশ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছয় থেকে সাত জন। ২৮ শতাংশ পরিবারে সদস্য সংখ্যা এক থেকে তিনজন। গড়ে প্রতি পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচজন।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে নিপীড়নের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে ৯০-র দশকেও অনেক রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। সব মিলিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে বসবাস করছে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *