রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে

রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে

অর্থনীতি স্লাইড

অক্টোবর ৩, ২০২২ ৮:৪২ পূর্বাহ্ণ

ডলার সংকট ও রিজার্ভের চাপের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের প্রধান দুটি খাতেই দুঃসংবাদ এসেছে। দুই খাতই আগের প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি। সেপ্টেম্বরে রপ্তানি আয় কমেছে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। রেমিট্যান্স কমেছে ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এদিকে বৈদেশিক মুদ্রাব্যয়ের প্রধান খাত আমদানি গত জুলাইয়ে বেড়েছে। তবে আগস্টে সাময়িক হিসাবে কমেছে।

বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় রিজার্ভের ওপর আরও চাপ বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে আমদানি কমায় কিছু স্বস্তি রয়েছে। এদিকে আগের বকেয়া এলসি ও ঋণের কিস্তি শোধ করায় চাপ বাড়বে। আমদানি ব্যয় মেটাতে এবং ঋণের কিস্তি পরিশোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রয়েছে। এতে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৬৪৪ কোটি ডলার। আগের সপ্তাহে ছিল ৩ হাজার ৬৮৪ কোটি ডলার। রোববার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে সেপ্টেম্বরে রপ্তানি তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রেমিট্যান্সের সেপ্টেম্বরের তথ্য পাওয়া গেছে। একক মাস হিসাবে সেপ্টেম্বরে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৪২০ কোটি ডলার। আয় হয়েছে ৩৯০ কোটি ডলার। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয়ে ঘাটতি হয়েছে ৭ দশমিক ০২ শতাংশ। গত বছরের একই সময় আয় হয়েছিল ৪১৬ কোটি ডলার। সেক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি কমেছে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। গত জুলাইয়ে রপ্তানি আয় হয়েছিল ৪৬১ কোটি ডলার। সে হিসাবে আয় কমেছে ১৫ দশমিক ৪০ শতাংশ।

তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়েছে। একই সঙ্গে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে প্রবৃদ্ধিও।

ইপিবির প্রতিবেদনে বলা হয়, তিন মাসে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১ হাজার ২৪২ কোটি ডলার। আয় হয়েছে ১ হাজার ২৪৯ কোটি ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় শূন্য দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি হয়েছে। পাশাপাশি গত অর্থবছরের একই সময় আয় হয়েছিল ১ হাজার ১০২ কোটি ডলার। সেক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ১৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সাভার ও গাজীপুরের শিল্প এলাকায় তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে উৎপাদনে। অন্যদিকে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোয় মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। এ হার নিয়ন্ত্রণে দেশগুলো সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করে বাজারে টাকার প্রবাহ কমাচ্ছে। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ভোক্তারা পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। পাশাপাশি একাধিক খাতে পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ায় পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এসব কারণে রপ্তানি আয় কমছে।

ইপিবি সূত্র জানায়, রপ্তানি আয় বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেসব দেশ বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি অন্যান্য দেশে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি কার্যক্রম শুরু করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, আগামী দিনে রপ্তানি আয় ও প্রবৃদ্ধি বাড়বে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে জুলাই-সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১ হাজার ২ কোটি ডলার। আয় হয়েছে ১ হাজার ২৭ কোটি ডলার। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় ২ দশমিক ৫২ শতাংশ বেড়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক শূন্য ৪১ শতাংশ। উৎপাদিত পণ্য খাতে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১ হাজার ১৯৮ কোটি ডলার। আয় হয়েছে ১ হাজার ২০৮ কোটি ডলার। এ খাতে আয় বেড়েছে শূন্য দশমিক ৮৬ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ১৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩০ কোটি ডলার। আয় হয়েছে ৩২ কোটি ডলার। আয় বেশি হয়েছে ৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

অন্যদিকে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি। এ খাতে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২৭ কোটি ডলার। আয় হয়েছে ২৪ কোটি ডলার। হিমায়িত খাদ্য খাতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। আয় হয়েছে ১৩ কোটি ২৮ লাখ ডলার। কৃষিপণ্য রপ্তানিতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২৯ কোটি ডলার। আয় হয়েছে ২৭ কোটি ডলার।

রেমিট্যান্স কমছে : বৈধ চ্যানেলে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স কমে গেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে ১৫৪ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক গত ৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, সেপ্টেম্বরে ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৫৩ কোটি ৯৫ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। প্রবাসী আয়ের এ অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৮ কোটি ৭২ লাখ ডলার বা ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ কম। গত বছরের সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৭২ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। এর আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশে ১৪৯ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল। এরপর এটিই সর্বনিম্ন।

চলতি অর্থবছরের টানা দুই মাস ২০০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। গত আগস্টে ২০৩ কোটি ৭৮ লাখ ও জুলাইয়ে এসেছিল ২০৯ কোটি ৬৩ লাখ ডলার। জুলাইয়ে পবিত্র ঈদুল-আজহার কারণে দেশে বিপুল অঙ্কের প্রবাসী আয় এসেছিল। তবে আগস্টে বড় উৎসব ছিল না, তারপরও প্রবাসী আয় ২০০ কোটি ডলার ছাড়ায়। তবে সেপ্টেম্বরে এসে এই উল্লম্ফনে হোঁচট খেয়েছে। এক মাসের ব্যবধানে প্রায় ৫০ কোটি ডলার কমে গেছে।

সূত্র জানায়, ডলার বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে রেমিট্যান্সের ডলারের দাম কমিয়ে দেওয়ায় বৈধ পথে এর প্রবাহ কমে গেছে। ১১ সেপ্টেম্বর রেমিট্যান্সের ডলারের দাম সর্বোচ্চ ১০৮ টাকা বেঁধে দেওয়া হয়। ফলে ওই দরেই ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স কিনছে। এর আগে সরকারি ব্যাংকসহ বেশির ভাগ ব্যাংক সর্বোচ্চ ১১১ টাকা দরে রেমিট্যান্স কিনেছিল। হঠাৎ রেমিট্যান্সের দর কমিয়ে দেওয়ায় প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলার পাঠানো কমিয়ে দেয়। সেপ্টেম্বরে প্রথম দুই সপ্তাহে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছিল। ডলারের দাম কমিয়ে দেওয়ায় সেপ্টেম্বরের তৃতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে এর প্রবাহ কমে যায়। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পুরো মাসের রেমিট্যান্সে।

সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাঁচ ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ২৪ কোটি ৬২ লাখ ডলার। বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ১২৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার। বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৬১ লাখ ডলার। বিশেষায়িত একটি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ২ কোটি ৪১ লাখ ডলার। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। ব্যাংকটিতে প্রবাসীরা ৩৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন। এরপর সিটি ব্যাংকে এসেছে ১১ কোটি ২৮ লাখ ডলার, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে ১০ কোটি ৭২ লাখ, অগ্রণী ব্যাংকে ৯ কোটি ৫৬ লাখ এবং ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে এসেছে ৭ কোটি ৯২ লাখ ডলার প্রবাসী আয়।

রেমিট্যান্সের ডলারের দাম আরও ৫০ পয়সা কমিয়ে সর্বোচ্চ ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়েছে। এই দর ১ অক্টোবর থেকে কার্যকর হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *