মৃত ব্যক্তির সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট নিয়ে যা করতে হয়

মৃত ব্যক্তির সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট নিয়ে যা করতে হয়

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি স্পেশাল

এপ্রিল ১৩, ২০২৪ ৬:১২ পূর্বাহ্ণ

হেইলি স্মিথের স্বামী ম্যাথিউ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দুই বছর আগে মারা যান। সেই সময় তার বয়স হয়েছিল ৩৩ বছর। হেইলি এখনো ভাবছেন ম্যাথিউয়ের সামাজিক মাধ্যমের অ্যাকাউন্ট নিয়ে কী করা যায়।

যুক্তরাজ্যে বসবাসরত এই দাতব্য কর্মী হেইলি স্মিথ বলেন, কিছু মানুষ জানেই না যে ম্যাথিউ মারা গেছে, তারা এখনো জন্মদিনের নোটিফিকেশন পায়, তার ফেসবুক ওয়ালে গিয়ে ‘শুভ জন্মদিন’ লেখে। এটা খুব একটা ভালো লাগে না। আমি ম্যাথিউয়ের ফেসবুক অ্যাকাউন্টকে মেমোরিয়ালাইজড করতে চেষ্টা করেছি। আর এটি করতে তার মৃত্যুর সনদপত্র আপলোড করতে হয়। আমি ২০ বারের ওপরে সেটা করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু এটি নিচ্ছেই না- ফলে কিছুই হচ্ছে না। ফেসবুকের সঙ্গে যোগাযোগ করে এর সমাধান করার মতো শক্তি আমার আর নেই।

মেমোরিয়ালাইজড অ্যাকাউন্ট কী?

প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষ সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করছে। ফলে মৃত্যুর পর কারো অনলাইনে উপস্থিতির কী হয় সেটি বেশ বড়সড় আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কোনো স্বজন সামাজিক মাধ্যমকে ব্যক্তির মৃত্যু সম্পর্কে না জানানো পর্যন্ত তার অ্যাকাউন্ট সক্রিয় থাকে। ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মৃত্যুর খবর জানালে কিছু সামাজিক মাধ্যম প্রোফাইল বন্ধ করে দেয়ার সুযোগ দেয়। আবার কিছু সামাজিক মাধ্যম দেয় বিকল্প। যেমন- মেটার মালিকানাধীন ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রামে ব্যক্তির মৃত্যু সনদপত্র দিলে হয় অ্যাকাউন্টটি ডিলিট করে দেওয়া হয় অথবা মেমোরিয়ালাইজড করে দেওয়া হয়- অর্থাৎ অ্যাকাউন্টটি একসময় আটকে যাবে এবং ব্যবহারকারীকে স্মরণ করবে। এ সময় অন্যরা অ্যাকাউন্টটিতে ছবি ও স্মৃতি পোস্ট করতে পারবে।

মৃত ব্যক্তির অ্যাকাউন্টের নামের পাশে ‘ইন মেমোরিয়াম’ বা ‘স্মরণে’ লেখা থাকবে। কেউই ঐ অ্যাকাউন্টে লগ ইন করতে বা চালাতে পারবে না, যদি না ব্যবহারকারী মৃত্যুর আগে কোনো ‘লিগ্যাসি কন্ট্যাক্ট’ দিয়ে যায়। সাধারণত পরিবারের কোনো সদস্য বা বন্ধুকে ‘লিগ্যাসি কন্টাক্ট’ হিসেবে দেওয়া যায়। তারা মৃত ব্যক্তির অ্যাকাউন্টের কন্টেন্ট পরিচালনা কিংবা ডিঅ্যাক্টিভেটের (নিষ্ক্রিয়) অনুরোধ করতে পারে।

ফেসবুকে ‘পিপল ইউ মে নো’ বা ‘যাদের হয়তো আপনি চেনেন’ তালিকায় সম্ভাব্য ভার্চুয়াল বন্ধুদের কাছে মেমোরিয়ালাইজড অ্যাকাউন্ট দেখানো হয় না। আর মৃত ব্যক্তির বন্ধুদের কাছে তার জন্মদিনের কোনো নোটিফিকেশনও যায় না।

গুগলের মালিকানাধীন ইউটিউব, জিমেইল ও গুগল ফটোসের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিষ্ক্রিয় থাকা অ্যাকাউন্ট ও এর উপাত্তের কী হবে তা ‘ইনঅ্যাক্টিভ অ্যাকাউন্ট’ সেটিংসে গিয়ে পরিবর্তনের সুযোগ থাকে ব্যবহারকারীদের।

এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে কারো প্রোফাইল মেমোরিয়ালাইজড করার সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে ব্যক্তির মৃত্যু হলে কিংবা অ্যাকাউন্টের মালিক তা ব্যবহারে অক্ষম হলে অ্যাকাউন্টটি কেবল ডিঅ্যাক্টিভেট করা যাবে।

প্রযুক্তি বিষয়ক সাংবাদিক জো টিডি বলেন, বিভিন্ন পন্থা রয়েছে, কিন্তু সব কোম্পানিই মৃত ব্যক্তির গোপনীয়তাকে অগ্রাধিকার দেয়। লগইন বিষয়ে কোনো তথ্য দেওয়া হবে না আর সুনির্দিষ্ট অনুরোধের ভিত্তিতে আপনি কেবল নির্দিষ্ট কিছু জিনিস যেমন ছবি এবং ভিডিও দেখতে পারবেন। সেখানেও কখনো কখনো আদালতের আদেশ প্রয়োজন হয়। টিকটক এবং স্ন্যাপচ্যাটের মতো নতুন সামাজিক মাধ্যমগুলোতে অবশ্য এমন কোনো শর্ত নেই।

আমাদের কি ডিজিটাল লিগ্যাসি উইল প্রস্তুত করা উচিত?

মৃত ব্যক্তির অ্যাক্টিভ প্রোফাইলের উপাত্ত, ছবি বা অন্যান্য কন্টেন্ট ভুল হাতে পড়লে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। প্রোফাইলের কিছু ডেটা ডাউনলোড করে কিংবা পুরো অ্যাকাউন্টের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও তা করা হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন সাইবার-অপরাধ বিশেষজ্ঞ সাসা জিভানোভিচ।

তিনি বলেন, একই নামে মিথ্যা অ্যাকাউন্ট তৈরির ক্ষেত্রে ছবি, তথ্য এবং ভিডিওগুলো ব্যবহৃত হতে পারে। আর যারা জানেন না যে ঐ ব্যক্তি মারা গেছেন তার পরিচিত এবং বন্ধুদের কাছ থেকে অর্থও আদায় করা হতে পারে।

যুক্তরাজ্যের ডিজিটাল লিগ্যাসি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জেমস নরিস বলেন, সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোতে কী আপলোড করা হচ্ছে তা নিয়ে চিন্তা করা ও সম্ভব হলে ব্যাকআপ রাখা সবার জন্যই জরুরি।

ফেসবুকের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, আপনি আপনার আগের সব ছবি ও ভিডিও ডাউনলোড করতে পারেন এবং তা আপনার আত্মীয়দের পাঠাতে পারেন।

জেমস নরিস আরো বলেন, সুতরাং যদি আমার কোনো দুরারোগ্য রোগ ধরা পড়ে আর আমার একটি ছোট বাচ্চা থাকে যে ফেসবুকে নেই, সেক্ষেত্রে আমি আমার সমস্ত ছবি ও ভিডিও ডাউনলোড করতে পারি। ইনবক্সের বার্তাগুলো সরিয়ে ফেলতে পারি, কারণ আমি চাইবো না আমার সন্তান আমার ব্যক্তিগত বার্তা দেখুক, আমার প্রিয় ছবিগুলো পছন্দ করে প্রতিটির সঙ্গে একটি গল্প লিখে যাবো।

তিনি মনে করেন, মৃত্যুর পর সামাজিক মাধ্যমের অ্যাকাউন্টগুলোর সঙ্গে কী ঘটবে তার নিয়ে আগে থেকেই পরিকল্পনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সবাইকে একটি ডিজিটাল নিগ্যাসি উইল প্রস্তুত করারও পরামর্শ দেন।

যুক্তরাজ্যের ডিজিটাল লিগ্যাসি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, দিন শেষে সামাজিক নেটওয়ার্কিং একটি ব্যবসা। এই প্ল্যাটফর্মগুলো আপনার ডিজিটাল লিগ্যাসির অভিভাবক না। আপনিই আপনার ডিজিটাল লিগ্যাসির অভিভাবক।

তবে তিনি মনে করেন, সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো শোকাহত স্বজনদের জন্য প্রক্রিয়াটিকে সহজ করে তুলতে পারে। প্ল্যাটফর্মটি কী প্রদান করে, এতে কোন ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে সে সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর মতো বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ কারণ সবাই জানে না যে সেগুলো আছে।

ডিজিটাল লিগ্যাসি কেবল সোশ্যাল মিডিয়ার বিষয় না

যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি দাতব্য সংস্থা মেরি কুরির গবেষণা নার্স সারাহ অ্যাটানলি বলেন, ডিজিটাল লিগ্যাসি একটি বড় বিষয়। মানুষের কেবল সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট নিয়েই না, ডিজিটালি তাদের মালিকানাধীন সবকিছু নিয়ে এবং মৃত্যুর পর এগুলোর কী হবে সে বিষয়েও ভাবতে হবে। ডিজিটাল ছবি এবং ভিডিওতে অনেক স্মৃতি থাকতে পারে। আবার আমরা এখন ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে অনেক অনলাইন আর্থিক ব্যবস্থাপনা ব্যবহার করি।

তিনি বলেন, প্লেলিস্টের জন্য মিউজিক অ্যাকাউন্ট তৈরি করা হচ্ছে। আমরা অনলাইন গেমিংয়ের ব্যবহার বাড়তে দেখছি। যেখানে মানুষজন তাদের অবতার তৈরি করতে ও অনলাইন স্পেসে থাকতে চেষ্টা করছে ও সময় দিচ্ছে। সুতরাং এটা বলা প্রয়োজন যে, ডিজিটাল লিগ্যাসি কেবল সোশ্যাল মিডিয়ারই বিষয় না।

সারাহ অ্যাটানলি বলেন, আমরা কি চাই কেউ আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট দখল করুক? আমরা কি চাই কেউ তাদের স্মরণ করুক? আমরা কি আমাদের বাচ্চাদের ডিজিটাল ছবির একটা অ্যালবাম দিতে চাই? অথবা আগে যেমন মানুষ সুন্দর, মুদ্রিত ছবির অ্যালবাম ব্যবহার করতো তেমন করে ছবি প্রিন্ট করতে চাই যাতে করে মৃত্যুর পর সেটা কাউকে দেওয়া যায়? ডিজিটাল লিগ্যাসি অবশ্যই এমন কিছু যা নিয়ে চিন্তা করা এবং কথা বলা দরকার।

বিয়ের মাত্র এক বছরের কিছু সময় পর ২০১৬ সালের জুলাই মাসে যখন ম্যাথিউ গ্লিওব্লাস্টোমা স্টেজ ৪-এ আক্রান্ত হবার খবর জানতে পারে তখন তার বয়স ২৮ বছর।

ডাক্তার তখন ম্যাথিউকে বলেন, আপনার জীবন চিরতরে পরিবর্তন হতে চলেছে আর সেটা ভালোর জন্য নয়।

হেইলি বলেন, আমাদের বিল থেকে শুরু করে সবকিছুতে ম্যাথিউর নাম ছিল। এ সবকিছু পরিবর্তন করাটা আমার জন্য খুব কঠিন ছিল। এসব করতে আমার প্রায় ১৮ মাসেরও বেশি সময় লেগেছিল।

তিনি বলেন, এখনো ম্যাথিউর ফেসবুক পেজকে মেমোরিয়ালাইজড করে রাখতে চাই, তবে এই মুহূর্তে সেটা নিয়ে কাজ করছি না। আমার মনে হয় ক্রমাগত মৃত্যু সনদের মতো একটা নথির দিকে তাকিয়ে থাকা সত্যিই বেদনাদায়ক। এই কারণেই আমি এটি করা এড়িয়ে চলেছি। এটা একটা ভয়ঙ্কর কাগজের টুকরো। আমি মনে করি এটি সত্যিই অনেক জটিল একটি প্রক্রিয়া। শোকাহত মানুষদের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই প্রক্রিয়া সহজ করা উচিত।

সূত্র: বিবিসি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *