মর্মান্তিক মৃত্যু ও সস্তা জীবনের বিষাদ

ফিচার স্পেশাল

জুলাই ২২, ২০২২ ৮:০৪ পূর্বাহ্ণ

মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান (শাশ্বত মনির)

ময়মনসিংহে একটা সড়ক দুর্ঘটনার খবর আমাদের মনে অনেক দুঃখের সঞ্চার করেছে। বাবা নেই, মা নেই, বোন মারা গেছেন। কেবল আশ্চর্যভাবে বেঁচে আছে এক নবজাতক শিশু। ট্রাকচাপায় পরিবারের সবাই মারা গেলেও সে এই পৃথিবীতে এসেছে এক বিস্ময় নিয়ে। শিশুটি বেঁচে আছে, এটি আশার খবর। প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে, মানুষ মরছে। রক্ত ঝরছে।

দুঃখের বিষয় হচ্ছে সড়ক মৃত্যু রোধ হচ্ছে না; সড়কে বেপরোয়া গতি অনিয়ন্ত্রিত চলাচল বন্ধ হচ্ছে না। যে যার মতো গতিতে চলছে উল্টাপাল্টা ওভারটেকিং করে। তাই দুর্ঘটনা বাড়ছে; বাড়ছে মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়ার ঘটনা। বাড়ছে পঙ্গুত্ব আর বাড়ছে চোখের জল।

পথেঘাটে মানুষের জীবন যাচ্ছে অকাতরে। আমরা কি জীবন নিয়ে মোটেও ভাবি? সংশ্লিষ্টদের মোটেও ভাবনা নেই। সর্বনাশ হয়ে যাওয়ার পর ক্ষণিকের জন্য ভাবি আমরা। আহ্ উহ্ করি। তার পর একদম মুখে কুলুপ আঁটা থাকে। চোখে থাকে কাঠের চশমা। তাই প্রাণ যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।

রাজধানী ঢাকায় উবার টেক্সিসহ বেশ কিছু সার্ভিস আমাকে বেশ আশাম্বিত করে। আমি নিজেই এ সার্ভিস নেই মাঝে মাঝে। এতে আমি খুবই উদ্দীপ্ত বোধ করছি। এ সার্ভিসে এখন শিক্ষিত মানুষ যুক্ত হচ্ছেন। উবারের লক্ষ্য হচ্ছে প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষিত বেকার গোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা, শহরগুলোতে চলাচল সুগম করা এবং যানজট ও বায়ুদূষণ কমানো। যদিও উবার সার্ভিসের ব্যাপারে শুরুতে সরকারের যথেষ্ট আপত্তি ছিলো।

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতরা পরোক্ষভাবে হত্যারই শিকার। কিন্তু হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার কাঙ্ক্ষিত উদ্যোগ নেই। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা না কমে জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে। এরশাদ সরকারের আমলে সড়ক দুর্ঘটনা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেলে সরকার গাড়ির চালকের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করে। এতে চালকের দায়িত্বে অবহেলার কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় কারো মৃত্যু ঘটলে চালককে নরহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করার বিধান রাখা হয়। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে পড়ে তা রহিত করতে বাধ্য হয় সরকার। দায়ী চালকদের শাস্তি না হওয়া, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, লাইসেন্সবিহীন ও অদক্ষ চালক কর্তৃক গাড়ি চালানো, আনফিট গাড়ি রাস্তায় চালানো, সড়ক যোগাযোগে অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কারণে এদেশে সড়ক দুর্ঘটনা মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত চালকদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর উদাহরণ খুব অনুজ্জ্বল। সব ক্ষেত্রেই দায়ী চালকরা পার পেয়ে গেছে।

সরকারি হিসাবে গত ১০ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেছে ৩৪ হাজার ৯১৮ জন। প্রতি বছর মারা যায় ৩ হাজার ৪৯১ জন। থানায় মামলা হয়েছে এমন দুর্ঘটনার হিসাব নিয়ে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে দায়িত্বশীলদের তরফে। বেসরকারি হিসাবে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে ২০ হাজার ৩৪ জন। প্রতিদিন গড়ে মারা যাচ্ছে প্রায় ৫৫ জন। সরকারি তথ্য ও বেসরকারিভাবে প্রাপ্ত তথ্যের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান থাকার কারণ হলো, দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের ৬৭ ধরনের প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করে প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। এ ঝামেলার কারণে অনেক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর বিষয়টি যথাযথভাবে রেকর্ডভুক্ত হয় না।

সড়ক দুর্ঘটনাজনিত ক্ষয়ক্ষতির সাম্প্রতিক এক গবেষণা তথ্যে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় ফি বছর ৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদহানি হয়। এই হার দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৯৫ শতাংশের সমান। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির হার উন্নত দেশগুলোর তুলনায় শতকরা ৫০ ভাগ দুর্ঘটনা রোধে চরমভাবে ব্যর্থ সরকারকে দেশের মানুষের স্বার্থে যথাসম্ভব দ্রুত ভাবতে হবে।

উন্নত বিশ্বে অধিকাংশই নিজেদের গাড়ি নিজেরা চালায়। শিক্ষিত মানুষ অর্থাৎ সচেতন জনগুষ্ঠির হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং। ওরা আইন মানে, ওদের আইন মানতে বাধ্য করে তাই ওদের সড়কে মৃত্যুর হারও খুবই কম। শিক্ষিত মানুষ ড্রাইভিংয়ে এলে আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কমবে। সেটি আশা করা যায়। আমাদের দেশে একজন বেকার শিক্ষিত মানুষ না খেয়ে পথে পথে ঘুরে। চাকুরি না পেয়ে ৫/১০ হাজার টাকার একটি অফিস সহকারীর চাকুরিতে তুষ্ট থাকে, অনায়াসে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা সহজেই আয় করা যায় যে ড্রাইভিং পেশায় সেখানে কেউ আসতে চায় না। সবাই ড্রাইভার বলে নাক শিটকায় বলে। ড্রাইভারের কাছে কেউ মেয়েকে বিয়ে দিতে চায় না। এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এ পেশাকে মর্যাদাশীল করতে হবে, তাহলে আমাদের দেশেও শিক্ষিত মানুষ ড্রাইভিং পেশায় যুক্ত হবেন।

আমরা জানি দুর্ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে, ঘটবেও। কেন তা রোধ করা যাচ্ছে না? আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় দেশে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এসব রুখতে হবে। যে কোনো মৃত্যুই দুঃখজনক। সে মৃত্যু যদি অকাল ও আকস্মিক হয়, তবে তা মেনে নেওয়া আরো কঠিন। প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে একের পর এক অকাল মৃত্যু আমাদের শুধু প্রত্যক্ষই করতে হচ্ছে না, এ দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক বিভীষিকাময় ও অরাজক পরিস্থিতিও মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যা আমাদের কারো কাম্য নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *