বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষে নকলা প্রেসক্লাবে সচেতনতামূলক সভা

বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষে নকলা প্রেসক্লাবে সচেতনতামূলক সভা

দেশজুড়ে

মার্চ ২৩, ২০২৩ ৪:১৯ অপরাহ্ণ

দেলোয়ার হোসেন, নকলা (শেরপুর)

২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তর ও সংগঠনের উদ্যোগে এই দিবসটি বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যদিয়ে পালিত হয়েছে।

এ দিবস উপলক্ষে শেরপুর জেলার নকলা প্রেসক্লাবের উদ্যোগে সচেতনতামূলক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ‘পানি ও স্যানিটেশন সংকট সমাধানে পরিবর্তন ত্বরান্বিত করা’ —এই প্রতিপাদ্যকে মনেপ্রাণে ধারন করে রাত ৮টার সময় প্রেস ক্লাব অফিসে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

নকলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি মো. মোশারফ হোসাইন —এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সচেতনতা মূলক সভায় বক্তব্য রাখেন— এইএফডিসি’র মনিটিরিং অফিসার কৃষিবিদ আব্দুর রব ও সহকারী মনিটিরিং অফিসার কৃষিবিদ মো. আব্দুছ সালাম, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ, প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন সরকার বাবু ও সদস্য শিমানুর রহমান সুখন; পরিবেশ রক্ষাকমীর্ ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের শিক্ষা-মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক রাজিব হাসান, নকলা ইউপির সচিব (প্রস্তাবিত উপসহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা) পরিবেশ রক্ষাকমীর্ এমদাদুল হক ও পরিবেশ রক্ষাকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অন্যতম সংগঠক আনোয়ার হোসেন প্রমুখ।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ তাঁর বক্তব্যে বলেন, বিশ্বে সুপেয় পানির যথেষ্ট সংকট রয়েছে। এখনই পানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারলে সুপেয় পানির প্রকট সংকটের সম্ভাবনা রয়েছে। সংকটের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। পানির অপচয় রোধ না করলে কৃষি জমিতে সেচের পানির সংকট দেখা দিতে পারে বলে তিনি মনে করছেন। তিনি জানান, বর্তমান এদেশে এক কেজি বোরো ধান উৎপাদন করতে গড়ে ৩ হাজার লিটার পানি ব্যবহার করতে হয়। এরপরেও আমাদের কৃষকরা তাদের ধান ক্ষেতে প্রয়োজনের বেশি পানি ব্যবহার করেন। কৃষকের বোরো জমিতে ২/৩ ইঞ্চি পানি রাখলেই যেখানে যথেষ্ট, সেখানে কৃষকরা নাবুঝে তাদের বোরো আবাদের জমিতে ৫/৬ ইঞ্চি পানি জমা রাখেন। না বুঝে এমন অতিরিক্ত পানি ব্যবহার ও দৈনন্দিন জীবনে পানির অপচয়ের ফলে দিন দিন ভূগর্ভস্থ পানির লেয়ার নিচে নেমে যাচ্ছে। তাই পানির ব্যবহার কম লাগে তথা সেচ কমদিতে হয় এমন ফসল চাষাবাদ করার পরামর্শ দেন তিনি।

কৃষিবিদ মো. আব্দুছ সালাম বলেন, যেহারে পানি ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে সুপেয় পানির অভাব সুষ্পষ্ট। পানি ব্যবহারে এখনই সাবধান না হলে, আর এভাবে চলতে থাকলে এমন একদিন আসবে যেদিন পানির নিচের স্তরে থাকা আর্সেনিকসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর পদার্থ পানির সাথে উঠে আসবে। ওই পানি পান করার ফলে আমরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবো। তাই পানির সুষ্ঠ ববহার নিশ্চিত করা জরুরি বলে তিনি মন্তব্য করেন।

রাজিব হাসান বলেন, এবারের বিশ্ব পানি দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘পানি ও স্যানিটেশন সংকট সমাধানে পরিবর্তন ত্বরান্বিত করা’—এই প্রতিপাদ্যকে মনেপ্রাণে ধারন করে পানি ব্যবহার করা উচিত। পানির সংকট সমাধানে পানির ব্যবহারে কৌশল অবলম্ভনের পাশাপাশি জন সচেতনতা তৈরী করা জরুরি বলে তিনি মনে করেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, দেশে বিদেশে ঘটা করে কতইনা দিবস উদযাপন করা হয়! অথচ অতি জরুরি ‘পানি দিবস’ —এ জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কোন কর্মসূচি পালন করা হয়না। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপদ ও সুপেয় পানি প্রাপ্তির বিষয় মাথায় রেখে সুপরিকল্পিত ভাবে পানি ব্যবহার করার অনুরোধ জানান তিনি।

তরুণ স্বেচ্ছাসবক আনোয়ার হোসেন বলেন, পানির সুষ্ট ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে আগে নিজের পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। দৈনন্দিন জীবনে পানির অপচয় রোধ করে একান্ত প্রয়োজনে পানি ব্যবহার করার প্রতি তিনি অধিক গুরুত্বারূপ করেন। তিনি বলেন আমরা প্রায় কাজেই বৈদ্যুতিক পাম্পের সাহায্যে পানি ব্যবহার করি। অনেক সময় প্রয়োজনের চেয়েও বেশি পানি ভূগর্ভ থেকে তুলে অপচয় করি। এটা বন্ধ করা জরুরি বলে তিনি মনে করেন। এতে করে একদিকে পানির অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ছে। ফলে মানুষকে অতিরিক্ত বৈদ্যুতিক বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। তাই পানি ব্যবহারে অধিক সচেতনতা অবলম্ভন করা উচিত বলে তিনি জানান।

শিমানুর রহমান সুখন বিভিন্ন তথ্য-সূত্রের ভিত্তিতে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ অর্জনের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ পানি ব্যবস্থাপনা, স্যানিটেশন, কৃষিকাজ, শিল্প খাত বিবেচনায় রেখে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পানি চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় আমাদের সরকার পানি অবকাঠামো সংস্কার, নদীর তীর সংরক্ষণ, নদীর নাব্যতা রক্ষার্থে ড্রেজিং, খাল পুনঃখনন, প্রাকৃতিক জলাধার রক্ষণাবেক্ষণ এবং নতুন জলাধার ও ব্যারেজ নির্মাণের কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। একই সঙ্গে নদীর তীরবতীর্ ভূমি পুনরুদ্ধার করে বনায়ন, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং জলাবদ্ধতা দূরীকরণে জনসচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম অব্যাহত আছে।’

তথাপিও দেশের ৪১ শতাংশ মানুষ এখনো নিরাপদ পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বাড়িতে নিরাপদ স্যানিটেশন সুবিধা পায় না ৬০ শতাংশ মানুষ। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, অপর্যাপ্ত বাজেট; সমন্বয় ও ব্যবস্থাপনার ত্রুটি; সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা ও অসচেতনতার কারণে নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের সুবিধা থেকে এসব মানুষ এখনো দূরে রয়েছে। তিনি জানান, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি)-৬ অনুসারে ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ মানুষের কাছে নিরাপদ পানি পৌঁছাতে হবে। কিন্তু দেশে নিরাপদ পানি পৌঁছানো গেছে ৫৯ শতাংশ মানুষের কাছে। দুর্গম এলাকা, গ্রামাঞ্চল ও শহরের বস্তি এলাকায় নিরাপদ পানি সহজে পাওয়া যায় না। পানিতে জীবাণু, আর্সেনিক ও লবণাক্ততা রয়েছে। এসডিজি লক্ষ্য পূরণ করতে হলে নিরাপদ পানির জন্য এখন কমপক্ষে চার গুণ সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তাই সকলের মাঝে সচেতনতা বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।

দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বক্তারা জানান, নিজ জেলা শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার বুরুঙ্গা, কোচপাড়া, কালাপনি, বাতকুচি, আন্ধারুপাড়া ও লক্ষ্মীকুড়া গ্রামে নলকূপে পানির সংকট দেখা দিয়েছে। জেলার সীমান্তঘেঁষা কোচপাড়া গ্রামে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ৫০টি পরিবারের প্রায় ৫০০ মানুষের বসবাস। এখানে পাহাড়ের টিলার ওপর একটিমাত্র গভীর নলকূপ রয়েছে। এই পরিবারের সদস্যদের অনেক কষ্ট করে আধা কিলোমিটার উঁচু-নিচু পথ মাড়িয়ে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে হয়। আর সারা বছর চেল্লাখালি নদীর পানি দিয়ে ঘরের কাজ করতে হয় তাদের। বিশেষ করে বছরের ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ মাসে মায়াঘাসী গ্রামের অগভীর নলকূপে পানি থাকে না। এখানকার লোকজন বাধ্য হয়ে মসজিদের বা আশেপোশের কোন গভীর নলকূপের পানি সংগ্রহ করতে হয়। বাকি পরিবারগুলো সেচের পাম্প থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করেন বলে বিভিন্ন তথ্যে জানা গেছে। পানির সুষ্ঠ ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারলে এসব এলাকার মানুষের জীবন মান যেমনই হোক না কেন, পানির সংকট তীব্র আকার ধারন করতে পারে বলে সকলে আশঙ্কা করছেন।

এসময় প্রেসক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক নূর হোসেন, দপ্তর সম্পাদক সেলিম রেজা ও অর্থ বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল-আমিন; পরিবেশ রক্ষাকর্মী ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. তরিকুল ইসলাম, স্বাস্থ্য-জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক পরিবেশ রক্ষাকর্মী মো. রফিজ উদ্দিন, পরিবেশ রক্ষাকর্মী মোশারফ হোসেন ও আব্দুর রাজ্জাকসহ প্রেস ক্লাবের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ও সদস্য সাংবাদিকগন উপস্থিত ছিলেন।

উল্লেখ্য, ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে জাতিসংঘ পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্মেলনের (ইউএনসিইডি) এজেন্ডা ২১-এ প্রথম বিশ্ব জল দিবস পালনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। সেখানে পানি সম্পদের জন্য একটি বিশেষ দিন ঘোষণার দাবি তোলা হয়। ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ সাধারণ সভা ২২ মার্চ তারিখটিকে বিশ্ব জল দিবস বা বিশ্ব পানি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং ১৯৯৩ সালেই প্রথম বিশ্ব জল দিবস পালিত হয়। এরপর থেকে এই দিবস পালনের গুরুত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *