বিশ্বে প্রতিবছর উচ্চ রক্তচাপের কারণে মারা যাচ্ছেন প্রায় ৭০ লাখ মানুষ। বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ২১ শতাংশ রোগটিতে ভুগলেও, ৮৯ শতাংশেরই নিয়ন্ত্রণে নেই রক্তচাপ। এর কারণ হিসেবে, সঠিক নিয়মে রক্তচাপ নির্ণয় করতে না পারাকেই দায়ী করছেন চিকিৎসকেরা । তাদের মতে, রক্তচাপ নির্ণয়ে সঠিক জ্ঞান না থাকায় স্বাস্থ্যগত মহাবিপর্যয় ডেকে আনছে মানুষ। বাড়ছে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকজনিত মৃত্যু, বাড়ছে পঙ্গুত্ব।
কর্মরত অবস্থায় অসুস্থ বোধ করেন পেশায় গাড়ি চালক মো. মিলন মিয়া। হঠাৎই মাথা ঘোরা, বমিবমিভাব আর বুব ধড়ফর শুরু হয়। পূর্ব অভিজ্ঞতা আর সচেতনতা থাকায় রক্তচাপ নির্ণয়ের জন্য চলে আসেন পাশ্ববর্তী ওষুধের দোকানে।
অনেকটা হন্তদন্ত ও আতঙ্কিত হয়ে ছুটে আসার সঙ্গে সঙ্গেই মিলন মিয়ার রক্তচাপ নির্ণয় শুরু করেন দোকানি মাওলানা মোহাম্মদ মফিদুল ইসলাম। নিজেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক দাবি করা মফিদুল রাজধানীর বনানী এলাকার কড়াইল গোডাউন বস্তিতে ওষুধের দোকান চালান। কিছু সময়ের ব্যবধানে নির্ণয় হলো মিলনের রক্তচাপ।
স্ফিগমোম্যানোমিটার, রক্তচাপ মাপার যন্ত্রের নাম না জানা হয়তো খুব বেশি দোষের কিছু নয়। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, রক্তচাপ নির্ণয়ের সঠিক নিয়মের কতোটুকুই মেনেছেন মফিদুল?
আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ হাসপতালের নেফ্রোলজি বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. এমএ সামাদ জানান, যখনই প্রেসার মাপা হয়, তার মিনিমাম ৩০ মিনিট আগে থেকে রেস্টে থাকতে হয়। এছাড়া প্রেসার মাপার আগে চা-কফি কিংবা ধূমপান করবে না। আগের রাতে যেন ভালো ঘুম হয় সে বিষয়ে খেয়াল রাখবে। এবং প্রেসার মাপতে এসে ৩০ মিনিট বসবে। তার পরে ব্লাড প্রেসার মাপা হবে।
চিকিৎসকরা বলছেন, সঠিক নিয়ম-কানুন না জেনে রক্তচাপ মেপে ভুলভাল তথ্য প্রদান হতে পারে ভয়াবহ মারাত্মক। ডেকে আনতে পারে স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্লিনিক্যাল কার্ডিওলজি প্রধান অধ্যাপক ডা. হারিসুল হক বলেন, ব্লাড প্রেসার মাপা একটা জটিল ব্যাপার। যেমন একটা বাচ্চার হাত ছোট থাকে, সেক্ষেত্রে তাকে যদি বড়দের কাফ দিয়ে ব্লাড প্রেসার মাপা হয়, তাহলে আমরা সঠিক ব্লাড প্রেসার পাবো না। এছাড়া একজন মোটা মানুষের কিংবা মাঝারি গড়নের মানুষের জন্য আলাদা আলাদা ব্লাড প্রেসার মাপার যন্ত্র রয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা যদি সবার জন্যই একই যন্ত্র ব্যবহার করি, তাহলে সঠিক হিসেব পাওয়া সম্বভ না। এছাড়া প্রেসার মাপার কাফ বাধার নিয়ম আছে। খুব বেমি শক্তও করা যাবে না, আবার লুজও করা যাবে না।
এতো গেলে রক্তচাপ নির্ণয়ের পদ্ধতিগত বিষয়। এবার দৃষ্টি দেয়া যাক হাসপাতালে। রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন হাসপতালে ডায়ালাইসিস চলছে, ৬৫ বছর বয়সী মো. আব্দুস সালামের। অবসরপ্রাপ্ত এই ব্যাংক কর্মকর্তার দাবি খাওয়া-দাওয়া ও জীবন-যাপনে তেমন কোনো অনিয়ম না করলেও ১৮ বছর ধরে তিনি ভুগছেন অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপে। যা এক পর্যায়ে কিডনি বিকল করে দেয় তার।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী জানান, তিনি ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণের পুরোপুরি চেষ্টা করেছেন। ডক্টরের দেয়া ঔষুধও তিনি নিয়মিত খেয়েছেন।
শুধু কিডনি বিকলই নয়, অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগ, স্ট্রোকসহ আরও অনেক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। যা মানুষের অকাল মৃত্যুর পাশাপাশি কর্মক্ষমতা নষ্ট করে পঙ্গু করে দেয়।
আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ হাসপতালের নেফ্রোলজি বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. এমএ সামাদ বলেন, যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে তাদের ৩০ ভাগ মানুষের কিডনি ড্যামেজ হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। আমরা যারা অলস জীবনযাপন করি, এ জীবনযাপন আমাদের অনেক অনেক রোগের জন্ম দেয়। হার্ট ডিজিজ, কার্ডিও ভাসকুলাইটিস, কিডনি ডিজিজ এ সবই হয় অলস জীবনযাপনের জন্য।
আজকাল কমবয়সী তরুণ তরুণীদেরও উচ্চ রক্তচাপ হচ্ছে জানিয়ে, সব বয়সীদেরই কায়িক পরিশ্রম ও সুষম খাবার গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
মানুষের মৃত্যুর সংখ্যার দিক দিয়ে প্রথম স্থানে থাকা স্ট্রোক ও হৃদরোগের অন্যতম কারণ উচ্চ রক্তচাপ। অথচ পরিসংখ্যান বলছে, দেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ২১ শতাংশ রোগটিতে ভুগলেও ৮৯ শতাংশেরই নিয়ন্ত্রণে নেই রক্তচাপ। আবার আক্রান্তের অর্ধেকই জানেন না নিজের রোগের বিষয়টি। আর তাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, নিরব ঘাতক উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে সব থেকে জরুরি সর্বস্তরে জনসচেতনা বৃদ্ধি।