বাইডেন-নেতানিয়াহুর বন্ধুত্বে কি ফাটল ধরছে?

বাইডেন-নেতানিয়াহুর বন্ধুত্বে কি ফাটল ধরছে?

আন্তর্জাতিক স্লাইড

মার্চ ২৬, ২০২৪ ৫:২০ অপরাহ্ণ

যুগের পর যুগ ধরে ইসরায়েলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধের ময়দান থেকে শুরু করে বিশ্ব কূটনীতি সব জায়গায় ইসরায়েলের ঢাল হিসেবে কাজ করছে দেশটি। এক বাক্যে বলা চলে গলা গলায় ভাব। চলমান ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে নজর দিলেই এ কথার প্রমাণ মেলে। যুদ্ধে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনের কোনো কমতি রাখেনি যুক্তরাষ্ট্র। লড়াইয়ের শুরু থেকেই অত্যাধুনিক অস্ত্র, গোলাবারুদ ভর্তি বিমান এমনি জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক মঞ্চগুলোতে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আটকে দিয়ে বারবার ইসরায়েলের পাশে দাঁড়াচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে সেই মজবুত বন্ধুত্বে এবার একটু একটু করে ফাটল দেখা দিয়েছে।

যে কারণে ফাটল ধরলো দুই দেশের বন্ধুত্বে?

গাজায় যেভাবে বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, তা নিয়ে আগেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু জাতিসংঘে গাজা সংঘর্ষ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এর আগেও নিরাপত্তা পরিষদে গাজায় যুদ্ধ-বিরতি নিয়ে প্রস্তাবনা এসেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাতে ভেটো দিয়েছে। তবে সোমবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে , যুক্তরাষ্ট্র সেই ভোটে অংশ নেয়নি।

জানা গেছে, এই প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছে পরিষদের অস্থায়ী ১০ সদস্য। ভোটাভুটিতে চার স্থায়ী সদস্য দেশ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন এবং ১০ অস্থায়ী সদস্য প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। তাই এবারের মতো গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আলোর মুখে দেখেছে। যুদ্ধবিরতি ছাড়াও গাজায় হামাসের হাতে বন্দি সব ইসরায়েলিকে মুক্তি দেওয়ারও আহ্বান জানানো হয়েছে।

হামাসের হামলার পর ইসরায়েল সফরে গিয়ে দেশটির পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন

হামাসের হামলার পর ইসরায়েল সফরে গিয়ে দেশটির পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন

তথ্যানুসারে, বাইডেন প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তে মোটেও খুশি হতে পারেনি ইসরায়েল। এর বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

এরই মধ্যে ওয়াশিংটনে ইসরায়েলের একটি প্রতিনিধি দলের সফর বাতিল করেছে তেল আবিব। গাজার রাফাহ শহরে সামরিক অভিযানের বিষয়ে আলোচনার জন্য আগামী সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা ছিল জ্যেষ্ঠ ইসরায়েলি নেতাদের।

রাফাহ শহরে ইসরায়েলের প্রস্তাবিত অভিযানের বিষয়ে অনেকদিন ধরেই আপত্তি জানিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এই অভিযানের সিদ্ধান্তে অনড়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শেষপর্যন্ত নেতানিয়াহু যদি যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি উপেক্ষা করে রাফাহ শহরে অভিযান চালান, তাহলে সেটি দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষতি করতে পারে। এমনকি, এর জেরে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে অস্ত্র সহায়তা দেওয়াও স্থগিত করতে পারে।

এর মধ্যেই নিরাপত্তা পরিষদে গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে আর আপত্তি না করার সিদ্ধান্ত নিলো বাইডেন প্রশাসন।

দুই দেশের বন্ধুত্বের শুরু কবে থেকে?

বন্ধুত্বের শুরুটা ১৯৪৮ সালে। ওই বছরের ১৮ মে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান প্রথম ইসরায়েলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল যখন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস গ্রোভার ম্যাকডোনাল্ড ১৯৪৯ সালের ২৮ মার্চ তার প্রমাণপত্র উপস্থাপন করেছিলেন। তারপর থেকে ধীরে ধীরে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অংশীদার হয়ে উঠে এবং এখনো রয়ে গেছে। ওয়াশিংটন হয়ে ওঠে ইসরায়েলের সামরিক সাহায্যের সবচেয়ে বড় দাতা। তবে সে সময় সম্পর্কে বিশেষ উন্নতি না হলেও পরবর্তীতে সম্পর্ক গভীর হতে থাকে। বিশেষ করে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর থেকে সম্পর্কটি বিকাশ লাভ করতে শুরু করে।

ইসরায়েলকে আর্থিক সহায়তা প্রদান সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব বাতিল হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে (হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস)।

ইসরায়েলকে আর্থিক সহায়তা প্রদান সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব বাতিল হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে (হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস)।

সেই যুদ্ধে ইসরায়েল আরব রাষ্ট্রগুলোর (মিসর, সিরিয়া ও জর্দান) বিরুদ্ধে জয় লাভ করে। যুদ্ধে ইসরায়েল আমেরিকার কোনো সামরিক সহায়তা ছাড়াই ছয় দিনের মধ্যে আরবদের পরাজিত করেছিল। ইসরায়েল জয় লাভের পর সিরিয়া ও মিসরের কিছু অংশ দখল করে। এরপর ফিলিস্তিনের কিছু অঞ্চলও দখলে নেয়। তখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে দ্ব্যর্থহীনভাবে সমর্থন করা শুরু করে। সম্পর্ক বেশ গাঢ় হতে থাকে। ১৯৭৩ সালের দিক থেকে ইসরায়েলকে প্রকাশ্যে সহায়তা করা শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক বন্ধনের পাশাপাশি পারস্পরিক স্বার্থের দ্বারা ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ। মূলত এতে যুক্তরাষ্ট্রেরও অনেকটা স্বার্থ জড়িত ছিল। আরব দেশগুলোর বৈরী আচরণ প্রতিহত করতে যুক্তরাষ্ট্র এ পথ বেছে নেয়। এমনকি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও কূটনীতিকরা বুঝতে পেরেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব কমাতে ইসরায়েল কার্যকরী অস্ত্র হতে পারে।

প্রথমদিকে যুক্তরাষ্ট্র বেশিরভাগ অস্ত্র ইসরায়েলিদের কাছে বিক্রি করত। সেই সঙ্গে তাদের উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার জন্য মার্কিন ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার অনুমতি দিয়েছিল। ১৯৮০ এবং ৯০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল অস্ত্রে গবেষণা, উন্নয়ন ও উৎপাদনে সহযোগিতা শুরু করে। মার্কিন সহায়তা ইসরাইলি অস্ত্রের সক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করেছে। ২০১৯ সালে স্বাক্ষরিত একটি স্মারকলিপির অধীনে ইসরাইল প্রতিবছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩.৮ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা পায়। এটি ২০২২ সালে ইসরায়েলের মোট সামরিক বাজেটের প্রায় ১৬ শতাংশ। আর্থিক সহায়তা ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যৌথ সামরিক অনুশীলন, সামরিক গবেষণা এবং অস্ত্র উন্নয়ন অন্তর্ভুক্ত করতে ইসরায়েলের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের বিনিময়ে অংশগ্রহণ করে।

যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের বৃহত্তম একক ব্যবসায়িক অংশীদার। ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পাঁচটি রফতানি হলো- হীরা, যন্ত্রপাতি, কৃষিপণ্য, বিমান এবং অপটিক ও চিকিৎসা যন্ত্র। ইসরায়েল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পাঁচটি আমদানি হলো- হীরা, ওষুধ পণ্য, যন্ত্রপাতি, অপটিক এবং চিকিৎসা যন্ত্র এবং কৃষিপণ্য। ইসরায়েলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ মূলত উৎপাদন খাতে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল ১৯৮৫ সালে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করে। অর্থনৈতিক সহযোগিতার সুবিধার্থে উভয় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং আগামী বছরের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংস্কার নিয়ে আলোচনা করার জন্য দুই দেশ প্রতিবছর একটি যৌথ অর্থনৈতিক উন্নয়ন গ্রুপ গঠন করে।

ইসরায়েলের বোমার আঘাতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া আল–আকসা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন এক ফিলিস্তিনি

ইসরায়েলের বোমার আঘাতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া আল–আকসা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন এক ফিলিস্তিনি

বাইডেন কেন এখন গাজার পক্ষে

গত অক্টোবরে গাজায় যুদ্ধ শুরু করে ইসরায়েল। এই হামলায় এখন পযর্ন্ত ৩২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। সম্প্রতি গাজায় বর্বরতা চালানো ইসরায়েলকে ক্রমাগত সমর্থন দিয়ে যাওয়ায় এখন নিজ দেশেই চাপের মুখে পড়েছেন বাইডেন। আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দ্বিতীয়বার প্রার্থী হচ্ছেন এ ডেমোক্র্যাট নেতা। ইসরায়েল ইস্যুতে এবার মুসলিম আমেরিকানদের ভোট হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন তিনি।

এছাড়া রাফায় অভিযান নিয়ে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। মার্কিন চাপ উপেক্ষা করে যদি ইসরায়েল রাফায় অভিযানে যায় তাহলে সামরিক সহায়তা বন্ধের মতো বিষয় সামনে এসে পড়েছে। তাই বেশ কয়েক দিন ধরে রাফায় ইসরায়েলি অভিযানের বিকল্প খুঁজছে বাইডেন প্রশাসন। সেই জন্য বেশ কাঠখড়ও পুড়িয়েছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। তবে ইসরায়েল বৈঠক স্থগিত করার কারণে সেই প্রচেষ্টায় নতুন করে বাধা দেখা দিল।

হামাসের ইসরায়েলের সংঘাত শুরুর পরপরই ইসরায়েল উপকূলে বিমানবাহী রণতরী পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ফাইল ছবি

হামাসের ইসরায়েলের সংঘাত শুরুর পরপরই ইসরায়েল উপকূলে বিমানবাহী রণতরী পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ফাইল ছবি

মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, ইসরায়েলের এমন সিদ্ধান্তে হতবাক বাইডেন প্রশাসন। তারা বিষয়টি ইসরায়েলিদের বাড়াবাড়ি বলে মনে করছেন।

মার্কিন রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সাবেক আলোচক অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, বাইডেন প্রশাসন ও নেতানিয়াহুর মধ্যে বিশ্বাসে ছেদ পড়বে। যদি এই সংকট ভালোভাবে সামাল না দেওয়া হয় তাহলে এই পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *