ডেঙ্গু চিকিৎসায় আইসিইউ ব্যয়ে রোগীদের নাভিশ্বাস

ডেঙ্গু চিকিৎসায় আইসিইউ ব্যয়ে রোগীদের নাভিশ্বাস

জাতীয় স্লাইড

সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৩ ১০:১৩ পূর্বাহ্ণ

চলতি বছর ডেঙ্গুর ধরন পরিবর্তন হওয়ায় আক্রান্তদের শরীরে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিচ্ছে। জ্বর, ডায়রিয়া, বমি, পেট ও ফুসফুসে পানি জমাসহ ডেঙ্গু শক সিনড্রোম ও ডেঙ্গু হেমরোজিক ফিভারে অধিকাংশ রোগীর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ ও পিআইসিইউ) প্রয়োজন হচ্ছে।

তবে চাহিদার তুলনায় সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা কম থাকায় ৯০ শতাংশ রোগী বেসরকারি হাসপাতালে ছুটছেন। আর এ অসহায়ত্ব পুঁজি করে বেসরকারি হাসপাতালের মালিক ও একশ্রেণির অসাধু চিকিৎসক রীতিমতো গলাকাটা ব্যবসা করছে। আইসিইউ ব্যয় মেটাতে গিয়ে রোগীর স্বজনের নাভিশ্বাস উঠেছে। রাজধানীর একাধিক হাসপাতাল ঘুরে ও ভুক্তভোগী স্বজনের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

রাজধানীর বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আবদুর রউফ পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ইয়াদ মুরসালিন (১৩) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে তিন দিন ধরে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রয়েছে। তার বাবা ইকবাল হোসেন কেরানীগঞ্জের নূরজাহান স্কুলের শিক্ষক। পরিবার নিয়ে থাকেন কামরাঙ্গীরচর এলাকায়।

ইকবাল হোসেন জানান, রোববার রাত থেকে ছেলের প্রচণ্ড জ্বর ও পাতলা পায়খানা শুরু হয়। কল্যাণপুরের ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষায় পজিটিভ আসে। সেখানে শয্যা না পেয়ে রায়েরবাজারের সিকদার মেডিকেলে তাকে ভর্তি করি। সেখানে তিন দিন চিকিৎসা করিয়ে কোনো উন্নতি হয়নি। বৃহস্পতিবার রাত থেকে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে থাকে। পেট ও লাংয়ে পানি জমে যায়। প্লাটিলেটের পরিমাণ ৩০ হাজারের নিচে নেমে আসে। তখন চিকিৎসকরা ছেলেকে দ্রুত আইসিইউতে নেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু সেখানে কোনো আইসিইউ শয্যা ফাঁকা না থাকায় এখানে ছেলেকে ভর্তি করেছি।

তিনি আরও বলেন, শিকদার মেডিকেলে তিন দিনে একবার প্লাটিলেট নেওয়া, চার ব্যাগ রক্ত দেওয়াসহ ৪৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আনোয়ার খান মডার্নে ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম জমা দিয়ে আইসিইউ সিট পেয়েছি। এখানে প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। এক সপ্তাহে ছেলের পেছনে প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আইসিইউতে যত দিন থাকবে ততই খরচ বাড়বে। আমি সাধারণ শিক্ষক এত টাকা কোথায় পাব। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। কিন্তু ছেলের জীবন তো বাঁচাতে হবে।

ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে আইসিইউ কক্ষের সামনে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের মানিক অধিকারীর সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। মানিকের মা সুমিতা অধিকারী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দুদিন ধরে আইসিইউতে। মানিক জানান, বুধবার মায়ের প্রচণ্ড জ্বর ও বমি শুরু হয়। বাড়িতে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে তিনি সুস্থ হননি। ডেঙ্গু ধরা পড়ায় চিকিৎসকরা তাকে ঢাকায় রেফার করেন। অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করি। শয্যা না পেয়ে মেঝেতে মাকে রাখি। শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়াসহ মায়ের অবস্থা খারাপ হতে থাকলে রাত আড়াইটায় ল্যাবএইডের আইসিইউতে ভর্তি করি।

সুমিতা অধিকারীর আরেক ছেলে অনিক অধিকারী আক্ষেপ করে বলেন, আমরা সাধারণ মানুষ। বাবা সামান্য কৃষক। দুই ভাই বেকার। ধারদেনা করে মায়ের চিকিৎসা করাচ্ছি। অনেক জায়গায় আইসিইউ না পেয়ে বাধ্য হয়ে এখানে ভর্তি করেছি। এখন হয়তো জমিজমা বিক্রি করে মায়ের ব্যয় মেটাতে হবে। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

ল্যাবএইডের কাস্টমার কেয়ার শাখার কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে জানান, এখানে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় আইসিইউর ভাড়া ৫০ হাজার টাকা। সিঙ্গেল কেবিন ১২ হাজার, শেয়ার কেবিন সাত হাজার ৩০০ টাকা। জেনারেল বেড ৬ হাজার টাকা করে। এছাড়া ওষুধপত্র, থাকা-খাওয়াসহ প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা খরচ পরে।

শুধু ল্যাবএইড বা আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতাল নয়, রাজধানীর স্কয়ার, সেন্ট্রাল, পপুলার, বাংলাদেশ হাসপাতাল, জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ, নিউলাইফ, গ্রিনলাইফ, আসগর আলী, এভার কেয়ার, ইমপালস, ইউনিভার্সেল মেডিকেল হাসপাতাল ও সিটি হাসপাতালসহ অন্তত ১২টি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর স্বজন ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে উচ্চ চিকিৎসা ব্যয়ের তথ্য পাওয়া গেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বি চৌধুরী বলেন, ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে আক্রান্ত অনেক রোগীর আইসিইউ সাপোর্ট লাগতে পারে। এছাড়া ডেঙ্গু পজিটিভ রোগীদের রক্তচাপ অনিয়ন্ত্রিত হলে, পালস পাওয়া কঠিন হলে, ডেঙ্গুর জ্বরের অসুস্থতায় হার্টের সমস্যা, ব্রেন ইনফেকশন ও অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহে রোগীর আইসিইউ লাগতে পারে।

ডা. ফজলে রাব্বি আরও বলেন, প্রাইমারি, সেকেন্ডারি, টারশিয়ারি লেভেলে ডেঙ্গুর সংক্রমণ হচ্ছে। এ কারণে বেশি জটিলতা দেখা দিচ্ছে। অনেকের শরীরে ইনফেকশনে সেপসিস, লাং ফেইলুরের ক্ষেত্রেও এ সাপোর্ট লাগতে পারে। কোমরবিডিটিতে ভোগা ব্যক্তিরা ডেঙ্গুর ডেন-২ ধরনে আক্রান্ত হলে তাদের অনেকের আইসিইউ প্রয়োজন।

সরকারি হাসপাতালে কত খরচ

বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ ব্যয় আকাশচুম্বী হলেও সরকারিতে তেমন কোনো খরচ নেই। শুধু ওষুধপত্রের জন্য খরচ করতে হয়। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি এক রোগীর স্বজন জানান, ডেঙ্গু আক্রান্ত তার শাশুড়ির অবস্থার অবনতি হলে তাকে বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করি। প্রতিদিন ৪০ হাজার টাকা বেশি খরচ হচ্ছিল। খরচ কুলাতে না পেরে অনেক কষ্টে সরকারি হাসপাতাল মুগদা মেডিকেলের আইসিইউতে ভর্তি করি। এখানে আইসিইউতে তেমন খরচ নেই। তিনি জানান, এখানে দুদিনে ওষুধপত্র-খাওয়া-দাওয়াসহ ৭ থেকে ৮ হাজার খরচ হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালে চার দিনে প্রায় লাখ টাকা খরচ হয়েছে।

মুগদা হাসপাতালের তৃতীয়তলার আইসিইউ ইউনিটের চিকিৎসকরা জানান, এখানে ২০টি শয্যার মধ্যে ছয়জন ডেঙ্গু রোগী রয়েছে। প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আবেদন ও তদবির আসে। কিন্তু সবাইকে তো শয্যা দেওয়া সম্ভব নয়। যারা বেশি গুরুতর তাদেরই প্রাধান্য দেওয়া হয়।

চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, সরকারি হাসপাতালগুলোর কর্মকাণ্ড কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলেও বেসরকারি হাসপাতালে সম্ভব হচ্ছে না। এতে রোগীদের নাভিশ্বাস বাড়ছে। আইসিইউসহ অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যয় রোধে সরকারের দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া  উচিত।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী-বর্তমানে রাজধানীর ১০টি সরকারি হাসপাতালে ১০৯টি আইসিইউ ও ১০৪টি এইচডিইউ শয্যা রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *