নভেম্বর ৩, ২০২৩ ৮:২৯ পূর্বাহ্ণ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকরা নির্বাচনের তফশিলের আগেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপ চান। তারা মনে করেন, সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে রাজপথে সহিংসতা বাড়ছে। সমঝোতা ছাড়া তফশিল ঘোষণা হয়ে গেলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। তাই এখনই অর্থবহ সংলাপ হলে তা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথকে সুগম করবে। এ অবস্থায় শেষ মুহূর্তে সমঝোতার আশায়ও আছেন অনেকেই।
এদিকে বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। বৈঠকের বিষয়বস্তু গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে উভয় পক্ষ। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিও আলোচনায় আসতে পারে বলে আভাস মিলেছে। সচিবের সঙ্গে রাষ্ট্রদূতের বৈঠক বিষয়ে জানতে মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগ করা হলে গণমাধ্যমে পাঠানো বার্তায় মুখপাত্র বলেন, কূটনীতিক হিসাবে আমরা বিভিন্ন সংস্থা-সংগঠন, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি পর্যায়ে কথা বলি।
নাগরিক সমাজ এবং বেসরকারি সংস্থা, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, ব্যবসায়ী নেতা, চেম্বার অব কমার্স, রাজনৈতিক দল, শিক্ষাবিদ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দায়িত্বশীল ব্যক্তি, সরকারি কর্মকর্তা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ অনেকের সঙ্গে আমাদের কথা হয়। এসব যোগাযোগ বা আলাপ-আলোচনায় বাংলাদেশ সম্পর্কে আরও ভালোভাবে আমাদের বুঝতে এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে সহায়তা করে।
নির্বাচন কমিশন চলতি মাসের মাঝামাঝি নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করবে বলে শোনা যাচ্ছে। প্রথা অনুযায়ী, তফশিল ঘোষণার আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অপরাপর নির্বাচন কমিশনাররা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। আগামী ৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন সাক্ষাৎ করার পর তফশিল ঘোষণা হতে পারে। তার আগের দিন অর্থাৎ আগামীকাল শনিবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রস্তুতি বৈঠকে বসছে নির্বাচন কমিশন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলাপের মাধ্যমে নির্বাচনের তফশিল ও তা ঘোষণার তারিখ চূড়ান্ত হবে।
সংবিধান মোতাবেক, আগামী ২৯ জানুয়ারির মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ভোটের ৪৫ থেকে ৫০ দিন আগে তফশিল ঘোষণা করতে হয়। সেই হিসাবে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করলেও নির্ধারিত সময়ে ভোট অনুষ্ঠান সম্ভব। যদিও নির্বাচন কমিশন সতর্কতামূলকভাবে কিছুটা আগেই ভোট করতে চায়। এদিকে সারা দেশে একদিন হরতাল এবং টানা ৭২ ঘণ্টার অবরোধের পর বিএনপি ও তার সঙ্গে আন্দোলনরত দলগুলো আরও দুই দিন অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। হরতাল-অবরোধে সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। অপরদিকে আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশের নামে মাঠে থাকছে।
বিগত ২৮ অক্টোবর রাজধানী ঢাকায় সহিংস ঘটনার পর বিদেশি কূটনীতিকদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। দেশগুলো নিজেদের নাগরিকদের সতর্কভাবে চলাচলের পরামর্শ দিচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘস্থায়ী হলে বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এসব কারণে সহিংসতা চায় না দেশগুলো।
২৮ অক্টোবরের সহিংস ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী ছয় দেশ অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, নরওয়ে, যুক্তরাজ্যের দূতাবাস এক যুক্ত বিবৃতিতে সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছে। বিবৃতিতে হতাহতের ঘটনায় শোক প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে সব অংশীদারকে সংযত হয়ে সহিংসতা পরিহারের আহ্বান জানানো হয়। দূতাবাসগুলো অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করার জন্য আহ্বান জানায়।
এছাড়া ঢাকায় বিদেশি কূটনীতিকরা বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন আলোচনায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপের তাগিদ দিচ্ছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ঢাকায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
বৈঠকে শর্তহীন সংলাপের মাধ্যমে সংকট নিরসনের জন্য আহ্বান জানান পিটার হাস। অপরদিকে ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের সঙ্গে বৈঠককালে সংলাপের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংবিধানের আওতায় শর্তহীন সংলাপে সরকারের আপত্তি নেই বলে জানিয়ে দিয়েছেন। মন্ত্রী বলেছেন, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার জন্য সংলাপের ব্যাপারে তারা রাজি আছেন।
জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বৃহস্পতিবার বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ছাড় দেওয়ার কোনো মানসিকতা দেখছি না। ফলে সংলাপের সম্ভাবনাও দেখছি না। ফলে কম কিংবা বেশি সহিংসতার আশঙ্কা আছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করেছেন। ব্রাসেলস থেকে ফিরে আসার পর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, খুনির সঙ্গে কিসের সংলাপ। বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করেছেন। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংলাপের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি বিধায় অনেকে মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি ছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংলাপের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখানোর কথা নয়। কারণ সংলাপের কোনো বিকল্প নেই।
কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একটি সূত্র জানিয়েছে, তড়িঘড়ি তফশিল ঘোষণা হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়বে। প্রধান দুই দলের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে সংকট নিরসনে বিদেশিরা উৎসাহ জোগালেও তারা এমন সংলাপে মধ্যস্থতা করবে না। অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনেও উৎসাহ জোগাবে।
বাংলাদেশ সরকার ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এসব বিষয়ে যোগাযোগ অব্যাহত আছে। সম্প্রতি মার্কিন উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আখতার বাংলাদেশ সফর করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান যুক্তরাষ্ট্র সফর করে আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
সূত্রটির মতে, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্থায়ী ও বহুমুখী হওয়ায় ওয়াশিংটন নির্বাচন ঘিরে এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না যাতে সার্বিক সম্পর্ক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে সহিংসতার ঘটনা পর্যালোচনা করে ভিসানীতির প্রয়োগে তার প্রতিফলন থাকতে পারে। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সুরক্ষা যুক্তরাষ্ট্রের মৌলিক নীতি। এই নীতির ব্যাপারে বাংলাদেশকে সহায়তার পাশাপাশি বিদ্যমান জোরালো সম্পর্ক রক্ষা করাও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।’