নাহিদ হাসান
পুরান ঢাকার বাংলাবাজার মোড় ঘুরে একটু সামনে গেলেই পড়বে শ্রীশ দাস লেন। এই শ্রীশ দাস লেনের প্রথম বাড়িটার নামই ‘বিউটি বোর্ডিং’। পুরান ঢাকার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এখানে দেশের সাহিত্য সংস্কৃতিমনা একদল আড্ডাবাজ মানুষের হাত ধরে সৃষ্টি হয়েছিল অন্য এক জাতিসত্বার। ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প সাহিত্যিকদের আড্ডার প্রাণকেন্দ্র হিসাবে অনেক সুনাম রয়েছে এই বিউটি বোর্ডিংয়ের।
ষাটের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক ছিল বিউটি বোর্ডিংয়ের যৌবনকাল। সেই সময়ে আড্ডা দিতে আসতেন প্রথিতযশা সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এই ঐতিহাসিক স্থানে এসেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও পল্লী কবি জসিমউদদীন। এসেছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এখানে আড্ডা দিতেন কবি শামসুর রাহমান, জিয়া আনসারী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, দেবদাস চক্রবর্তী, ভাষ্কর নিতুন কুন্ডু, সন্তোষ গুপ্ত, ফজল শাহাবুদ্দীন, কবি ইমরুল চৌধুরী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, কবি আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, রণেশ দাস গুপ্ত, মহাদেব শাহা, আহমদ ছফা, খান আতাউর রহমান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হক,আনিসুজ্জামান, বেলাল চৌধুরীসহ অনেকে। টিভি ব্যক্তিত্ব ফজলে লোহানি, চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, জাদুশিল্পী জুয়েল আইচকেও দেখা যেত বিউটি বোর্ডিংয়ের আড্ডায়। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে আসতেন গাজীউল হক, কমরেড আঃ মতিন, অলি আহাদ, সাইফুদ্দীন মানিক প্রমুখ।
চলচ্চিত্র শিল্পের কিংবদন্তি আব্দুল জব্বার খান বিউটি বোর্ডিংয়ে বসেই লেখেন বাংলা প্রথম সবাক চলচ্চিত্র “মুখ ও মুখোশ” এর চিত্রনাট্য। প্রখ্যাত সুরকার সমর দাস বহু কালজয়ী বাংলা গানের সুর সৃষ্টি করেছিলেন এখানে আড্ডা দেওয়ার ফাঁকে। এখান থেকে ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় কবিতাপত্র ‘কবিকণ্ঠ’। আহমদ ছফার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় স্বদেশসহ আরো বেশ কয়েকটি সাহিত্য সাময়িকী। কবি সৈয়দ শামসুল হকের লেখার জন্য একটা নিদিষ্ট টেবিল ছিল বিউটি বোর্ডিংয়ে।
বাংলার ইতিহাসের সাথে শত বছর ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিউটি বোর্ডিং। এর সাইনবোর্ড দেখে ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে এক টুকরো বাগান। বাগানে ফুটে আছে নানা রকম ফুল। বাগান থেকে চোখ ফেরাতেই দেখা যাবে হলুদ রঙের বিশাল একটি বাড়ি। এটি অনেকটা ইংরেজি অক্ষর ‘এল’ আকৃতির বাড়ি। বাড়িটি পুরোপুরি আড্ডার উপযোগী। ভবনের নিচতলার একটি অংশে রয়েছে খাবার ঘর। সেখানে ছোট ছোট টেবিলে খাবার পরিবেশন করা হয়। এখানে ব্যবহৃত থালা, গ্লাস, জগ, বাটিসহ সকল তৈজসপত্র স্টিলের তৈরি। এখানে বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাবার পরিবেশন করা হয়।
বিউটি বোর্ডিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা দুই ভাই প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা ও নলিনী সাহা। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ এর ২৮ মার্চ অনেকের সাথে শহীদ হন প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা। শহীদদের স্মরণে এখানে ১৯৯৬ সালের ৬ ডিসেম্বর কবি শামসুর রাহমান স্মৃতিফলক উন্মোচন করেন।
বিউটি বোর্ডিংকে কেন্দ্র করেই দেশের শিল্প-সংস্কৃতির রেনেসাঁ ঘটে। কিন্তু এখন আর পুরনো দিনের মতো আড্ডা বসে না বিউটি বোর্ডিংয়ে। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিউটি বোর্ডিং।