কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে শতকোটি টাকার সনদ বাণিজ্য

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে শতকোটি টাকার সনদ বাণিজ্য

শিক্ষা স্লাইড

এপ্রিল ২৩, ২০২৪ ৮:০৩ পূর্বাহ্ণ

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কম্পিউটার সেলের সিস্টেম অ্যানালিস্ট একেএম শামসুজ্জামানের সিন্ডিকেট এখন পর্যন্ত পাঁচ হাজারের বেশি সনদ বিক্রি করেছে। দালালসহ দুই থেকে তিন হাত ঘুরে এসব সনদ গেছে মূল ক্রেতার হাতে। ঢাকা ও নরসিংদীর কিছু দালাল এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরকারি-বেসরকারি কারিগরি স্কুল, কলেজ, পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, সার্ভে ইনস্টিটিউটের পরিচালক-প্রিন্সিপালদের মাধ্যমে এসব সনদ বিক্রি করত চক্রটি। যা ছিল ওপেন সিক্রেট। একেএম শামসুজ্জামান ৩৫ থেকে ৫০ হাজার টাকায় এসব সনদ বিক্রি করলেও ক্রেতা পর্যায়ে দাম পড়েছে ন্যূনতম ২ লাখ টাকা । ফলে ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ১০০ কোটি টাকার সনদ বাণিজ্য হয়েছে। একেএম শামসুজ্জামানের এই সনদ বাণিজ্যে জড়িত কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে একটি শক্ত সিন্ডিকেট। এতে রয়েছে পরিদর্শক, কম্পিউটার অপারেটর, সিস্টেম এনালিস্ট শাখার কর্মকর্তারা। এসব অপকর্মের জন্য একটি অলিখিত কমিটিও ছিল কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অসাধু চক্রের। তাদের এক বৈঠকের আলোচনার অডিও রেকর্ড সূত্রে জানা গেছে, একটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে কাজ নেওয়া হবে। যে ওই নম্বর চালাবেন তিনি টাকাও নিবেন। একই ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা না নেওয়ার বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয় ওই বৈঠকে। অন্যদিকে মোটা অঙ্কের টাকা ও ডলার ঘুসের বিনিময়ে এ চক্রকে অপকর্মের সুযোগ করে দিয়েছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের প্রভাবশালী কর্মকর্তা, দুদক কর্মকর্তা এবং গণমাধ্যমের কিছু অসাধু কর্মী। এজন্য তদের পেছনে শামসুজ্জামান সিন্ডিকেট ঢেলেছে প্রায় দুই কোটি টাকা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। ডিএমপির গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান বলেন, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সিস্টেম অ্যানালিস্ট একেএম শামসুজ্জামান ৩৫ থেকে ৫০ হাজার টাকায় সনদ বিক্রি করতেন। তবে গ্রাহক পর্যায়ে ন্যূনতম দুই লাখ টাকায় এসব সনদ বিক্রি হতো। এ চক্রে এখন পর্যন্ত অন্তত ৩০ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। যেসব প্রধান শিক্ষক ও প্রিন্সিপাল মধ্যস্থতা করে গ্রাহক নিয়ে আসতেন, তাদের নামের দীর্ঘ তালিকা এসেছে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে। এছাড়া সনদ বাণিজ্যের বিষয়ে জানতেন বোর্ডের ছোট-বড় সব কর্তাই। পর্যায়ক্রমে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

এদিকে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান আলী আকবর খানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আজ (মঙ্গলবার) ডেকেছে ডিবি। সনদ বাণিজ্য চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গত শনিবার কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের স্ত্রী সেহেলা পারভীনকে রাজধানীর উত্তরার বাসা থেকে গ্রেফতার করে ডিবি। সেহেলা পারভীন দুই দিনের রিমান্ডে আছেন। স্ত্রীকে গ্রেফতারের পর আলী আকবরকে প্রথমে ওএসডি ও পরে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সোমবার কারিগরি বোর্ডের আইটিসিসির পরিচালক মো. মামুন উল হককে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছে সরকার।

এ ঘটনায় গ্রেফতার মাকসুদুর রহমান মামুন ও সরদার গোলাম মোস্তফা ওরফে মোস্তাফিজুর রহমান সোমবার আদালতে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশীদের আদালত তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করেন। এরপর তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সনদ বাণিজ্যের অভিযোগে গত ১ এপ্রিল রাজধানীর মধ্যপীরেরবাগ থেকে প্রথমে শামসুজ্জামান ও তার ব্যক্তিগত সহকারী ফয়সালকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যে কুষ্টিয়া গড়াই সার্ভে ইনস্টিটিউটের সানজিদা আক্তার ওরফে কলির নাম বেরিয়ে এলে ৫ এপ্রিল তাকেও গ্রেফতার করা হয়। তিনজনের জবানবন্দি ও তাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন ডিভাইস পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ঘটনার সঙ্গে জড়িত হিলফুল ফুজুল টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজের অধ্যক্ষ সরদার গোলাম মোস্তফা ওরফে মোস্তাফিজুর রহমানকে গত বৃহস্পতিবার মিরপুর থেকে এবং ঢাকা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের (মেডিকেল) পরিচালক মাকসুদুর রহমান ওরফে মামুনকে গত শুক্রবার যাত্রাবাড়ী থেকে গ্রেফতার করা হয়। সর্বশেষ শনিবার গ্রেফতার করা হয়েছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সদ্যবিদায়ি চেয়ারম্যানের স্ত্রী সেহেলা পারভীনকে। রোববার সেহেলাকে ঢাকার আদালতে হাজির করে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন ডিবির পরিদর্শক আমিরুল ইসলাম। শুনানি শেষে আদালত দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

সানজিদার খপ্পরে বেপথে সেহেলা পারভীন : দুই দিনের রিমান্ডের প্রথম দিন রোববার সেহেলা পারভীন ডিবিকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। তার দেওয়া তথ্য মতে কুষ্টিয়া গড়াই সার্ভে ইনস্টিটিউটের সানজিদা আক্তার ওরফে কলির খপ্পরে পড়ে বেপথে গেছেন সেহেলা পারভীন। বিয়ে সংক্রান্ত এ সমস্যার জেরে বছরখানেক আগে সানজিদার সঙ্গে পরিচয় হয় সেহেলা পারভীনের। পরিচয়ের পর থেকেই বুটিকসহ বিভিন্ন ব্যবসা করার টোপ দেন সানজিদা। পর্যায়ক্রমে তাদের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। চলতি মাসের ১৩ এপ্রিল সেহেলা পারভীনের একমাত্র মেয়ের বিয়ের খরচ মেটাতে সানজিদার কাছে তিন লাখ টাকা ধার চান তিনি। এই সুযোগে সানজিদা একেএম শামসুজ্জামানকে পাঠান সেহেলা পারভীনের কাছে। একেএম শামসুজ্জামান তিন লাখ টাকা দিয়ে তার চাকরির পদোন্নতি ও বিভিন্ন অভিযোগের তদন্তে মুক্তি পেতে সেহেলা পারভীনের সহযোগিতা চান। সহায়তার আশ্বাসও দেন সেহেলা পারভীন।

ছয় ধরনের অনিয়ম : সনদ বাণিজ্য ছাড়াও সনদের নাম, ঠিকানা বা বিভিন্ন ভুল সংশোধনে নিয়মতান্ত্রিক আবেদন না করে এ চক্রের মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে শর্টকাটে কাজ হতো। টাকার বিনিময়ে জš§তারিখ পরিবর্তন করে বয়স কমানো, জেলা কোটায় চাকরির সুবিধা পেতে সনদের স্থায়ী ঠিকানা পরিবর্তন করা হয়েছে। পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের রেজাল্ট পরিবর্তন করে পাশের সনদ দেওয়া হতো। রেজাল্ট খারাপ হলে সনদ পরিবর্তন করে ভালো রেজাল্ট করিয়ে দেওয়া হতো। এছাড়া যারা কখনোই কারিগরি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হননি তাদেরও রোল নম্বর, রেজিস্ট্রেশন নম্বর বানিয়ে সনদ দেওয়া হতো।

ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে শামসুজ্জামান জানিয়েছেন, দুদকের উপপরিচালক আলী আকবর অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাকে নোটিশ দিয়েছিলেন। পরে জিজ্ঞাসাবাদও করেন। এর পর মামলা হলে রেহাই পেতে তিনি পূর্বপরিচিত দুদকের উপপরিচালক আবু বকর সিদ্দিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ সময় আবু বকর তার কাছে ৬০ লাখ টাকা দাবি করেন। শামসুজ্জামান টাকা দিলে বদলে যায় তদন্ত কর্মকর্তা। সহকর্মী আবু ফজলের সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল আবু বকরের। সেই সূত্রে তার কাছে যান শামসুজ্জামান। আবু বকরকেই ৬০ লাখ টাকার সমপরিমাণ ডলার দেন তিনি। এরপর আবু বকর ফাইল দেখিয়ে বলেছিলেন, আপনার মামলায় গোলাম মাওলা তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ পেয়েছেন।

দুদক কর্মকর্তা গোলাম মাওলা বিভিন্ন সময় তথ্য চেয়ে শামসুজ্জামানকে সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় ডাকতেন। বিভিন্ন সময় তিনি ৩, ৫ ও ১০ লাখ টাকা করে নিয়েছেন। শামসুজ্জামান ও গোলাম মাওলাকে বাড্ডার বাসায় ডেকে নিয়ে প্রায়ই কথা বলতেন আবু বকর। গোলাম মাওলা শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি উল্লেখ করে প্রতিবেদন দেন। আবু বকর গত ২৯ জানুয়ারি অবসরে গেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *