ঈদ ঘিরে সক্রিয় অপরাধী চক্র, যেসব বিষয়ে সচেতনতা জরুরি

ঈদ ঘিরে সক্রিয় অপরাধী চক্র, যেসব বিষয়ে সচেতনতা জরুরি

জাতীয় স্লাইড

এপ্রিল ৪, ২০২৪ ১০:৩৭ পূর্বাহ্ণ

প্রতি বছরই ঈদকে কেন্দ্র করে অজ্ঞান পার্টিসহ নানা নামের মৌসুমি অপরাধীদের তৎপরতা বেড়ে যায়। তারা অনেকটা বেপরোয়া হয়ে পড়ে। আসন্ন পবিত্র ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে রাজধানী এখন লোকে লোকারণ্য। ঈদের কেনাকাটা ও ঈদ যাত্রার সময় এই সুযোগ কাজে লাগায় রাজধানীর ‘রাজা’ নামে খ্যাত অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা।

যেসব জায়গায় অপরাধীদের আনাগোনা বেশি:

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন অথবা শপিংমলগুলোর সামনে এদের আনাগোনা বেশি থাকে। এরা সংঘবদ্ধ দল কয়েকটা ভাগে বিভক্ত হয়ে জায়গায় জাগায় অবস্থান নেয়। একেক গ্রুপের সদস্য সংখ্যা তিন থেকে চার বা এরও কমবেশি হতে পারে। তারা মানুষের চলন-বলন দেখেই বুঝে নিতে পারে মানুষটির বুদ্ধিমত্তা কেমন হবে, তাকে কাবু করা বা তাদের খপ্পরে ফেলা যাবে কি-না। মানুষের চলনভঙ্গি দেখেই তারা ঠিক করে ফেলে তাদের টার্গেট, এরপরই শুরু অপারেশন।

যেসব বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে:

এই অপরাধীদের খপ্পরে কেউ পড়বেন না- এমন গ্যারান্টি পাওয়া যায় না। এজন্য অজ্ঞান পার্টির খপ্পর থেকে বাঁচতে বেশকিছু বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর মধ্যে রয়েছে-

১. সাহায্যের নামে অপরাধীরা এগিয়ে আসে। পরে সুযোগ বুঝে সব কেড়ে নেয়। ফলে এই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
২. অপরিচিত কোনো মানুষের সঙ্গেই সব ধরনের লেনদেন থেকে বিরত থাকতে হবে।
৩. অপরিচিত কেউ কিছু খেতে দিলে তা খাওয়া যাবে না। অনেক ক্ষেত্রে খাবার খাইয়ে অজ্ঞান করে তারা সব লুটে নেয়।
৪. অনেক সময় অপরাধীরা ছোট কাগজ ধরিয়ে দেয়। তাতে কী লেখা আছে তা জানতে চায়। এতেই ঘটে যায় বিপত্তি। কারণে ঐ কাগজে থাকা মেডিসিনে স্মৃতিভ্রম হয়ে যায়। তখন তার সব লুটে নেয়া হয়।
৫. অনেকে ধাক্কা দিয়ে অযথা বিবাদে জড়ায়। পরে সুযোগ বুঝে ছিনতাই করে।
৬. অনেকে রিকশাচালক সেজে যাত্রীদের উঠিয়ে তাদের আখড়ায় নিয়ে যায়। পরে সব লুটে নেয় তারা।
৭. কোনো পরিবহন ফাঁকা থাকলে বা বেশি লোকজন না থাকলে তাতে না ওঠা ভালো।
৮. চক্রের অনেকে সমস্যায় পড়ার ভান ধরে। তারা অন্যের মোবাইল ফোনে কথা বলতে চায়। পরে কথা বলার সুযোগে ছিনতাই করে থাকে। এটি থেকেও সতর্ক থাকতে হবে।
৯. চক্রের অনেকে টার্গেটকৃত মানুষের সামনে এসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে তাকে সহায়তা করতে গিয়ে নিজের সব হারায়।
১০. বাইরে বের হয়ে বেশি টাকা বের করা না করাই ভালো। এতে চক্রের টার্গেটে পড়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।

রমজানের শুরু থেকে যে পরিকল্পনা করে চক্র:

রমজান মাস ঘিরে কোথায় কোথায় ডাকাতি করবে, তার একটি পরিকল্পনা করেছিল একটি ডাকাত দল। এজন্য রাজধানীর মগবাজারে হোটেল কক্ষও ভাড়া নিয়েছিল তারা। পরিকল্পনা ছিল চাঁদরাত পর্যন্ত ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতি করবে। এরপর ঈদে বাড়ি ফিরে যাবে।

গত ৬ মার্চ সকালে মতিঝিল এলাকায় শাহাদাত হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে ডিবি পরিচয়ে আটকায় ঐ চক্রের সদস্যরা।

ফাইন্যান্স টাওয়ারের অবস্থিত ল’ ফার্ম এবং মাল্টি অ্যাসোসিয়েশনের জেনারেল ম্যানেজার শাহাদাত তার ক্লায়েন্টের ৭১ লাখ টাকা জমা দেওয়ার জন্য ব্যাংকে যাচ্ছিলেন। ক্যাফে সুগন্ধা হোটেলের সামনে তাকে আটকে গাড়িতে তুলে নিয়ে ৭১ লাখ টাকা, মোবাইল, মানিব্যাগসহ সব কিছু নিয়ে যায় চক্রের সদস্যরা।

ঐ ঘটনায় ডিবির হাতে গ্রেফতার হয় চক্রের পাঁচ সদস্য। ডিবি বলছে, এই ছিনতাইকারী-ডাকাতরা ইফতার-সেহরির পর বিভিন্ন স্থানে ওত পেতে থাকে। এজন্য সেসব স্থানে ডিবির টহল জোরদার করা হয়েছে।

যুবক মিনহাজের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা:

বাস, ট্রেন ও লঞ্চে ঢাকায় আসা মানুষকে টার্গেট করে পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাই করছিল একটি চক্র। চক্রটি রিকশাচালকের ছদ্মবেশে যাত্রী তুলে নিজেদের নির্ধারিত স্থানে নিয়ে পুলিশ পরিচয়ে তল্লাশির নামে ছিনতাই করত। সম্প্রতি রিকশায় কমলাপুর থেকে পুরান ঢাকার বংশালে যাওয়ার পথে এক ব্যবসায়ীর ছেলে এই চক্রের কবলে পড়ে এক লাখ টাকা খোয়ান।

সপ্তাহ খানেক আগে রাজধানীর পল্টন থেকে শান্তিবাগ মোড়ে বাস যোগে যাচ্ছিলেন মোহাম্মদ মিনহাজ নামের এক যুবক। একই বাসে থাকা এক লোক হুট করে খুব কাছে এসে ছোট একটি কাগজ দেখিয়ে তাতে কী লেখা আছে পড়ে দিতে বলেন। সেটিতে ইংরেজিতে লেখা ছিল, “ওয়াচ মাই আই’জ” (আমার চোখের দিকে তাকাও)। এ লেখার নিচে অনেকগুলো সংখ্যা। তারপরই ঘটে বিপত্তি।

মিনহাজ জানালেন, কাগজটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারি আমার হাত-পা ঝিমঝিম করা শুরু হয়েছে। আমি আর ওই লোকটির দিকে না তাকিয়ে কোনোভাবে বাস থেকে নেমে যাই। আমার বোন পুলিশ। তার কাছে এমন করে একটি চক্র প্রতারণা করে বলে শুনেছিলাম। বিভিন্ন সময় খবরেও পড়েছি। তাই আর কোনো ঝুঁকি নিইনি।

শুধু মিনহাজ নন, পবিত্র ঈদুল ফিতর সামনে রেখে যানবাহন, রাস্তাঘাট, বিপণিবিতানে বিভিন্ন প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। তবে এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীরা আইনের আশ্রয় নিচ্ছেন কম বা নেয়ার সুযোগই পাচ্ছেন না। ঘটনাগুলো ঘটছে চোখের পলকে।

সচেতন হওয়ার পরও চক্রের খপ্পরে পড়েন অনেকে:

মিনহাজ তার অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেছিলেন ফেসবুকে ‘সায়েন্স বি-বিজ্ঞান ও গবেষণা’ নামের একটি পাবলিক গ্রুপে। মিনহাজের পোস্টের নিচে একাধিক ব্যক্তি নিজে বা অন্যরা কীভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন, সে অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। সচেতন হওয়ার পরও প্রতারক চক্রের খপ্পরে কীভাবে পড়েছিলেন, তা নিয়েও অনেকে লজ্জিত বলে উল্লেখ করেন।

অঠোর অবস্থানে ডিএমপি:

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) বলছে, ঢাকা মহানগরের সব এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করা হয়েছে। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অজ্ঞান পার্টি ও মলম পার্টির তৎপরতা ঠেকাতে মাঠে রয়েছে পুলিশ সদস্যরা। যে নামেই চাঁদা আদায় করা হোক, সব ধরনের চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ডিএমপি বলছে, রাজধানীর বড় বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্র, শপিংমলে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এসব এলাকা চিহ্নিত করে ইউনিফর্মে ও সাদা পোশাকে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারিও।

এ বিষয়ে ডিএমপির মুখপাত্র ও উপপুলিশ কমিশনার ফারুক হোসেন বলেন, চলতিপথে বাসসহ বিভিন্ন যানবাহনে অপরিচিত কেউ সাহায্যের জন্য বা খাতির করতে এলে এক্সট্রা খাতির করা যাবে না। অপরিচিত মানুষের সঙ্গে সব ধরনের লেনদেন থেকে বিরত থাকতে হবে। কোনো কিছু খেতে দিলে খাওয়া যাবে না।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার ও অতিরিক্ত ডিআইজি লিটন কুমার সাহা বলেন, ঈদকে কেন্দ্র করে রাজধানীর বড় বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্র, শপিংমলে নেয়া হয়েছে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এসব এলাকা চিহ্নিত করে পোশাকে ও সাদা পোশাকে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশের টহল টিমসহ বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। ছিনতাই ঠেকাতে মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। এরই মধ্যে ঢাকা মহানগর এলাকায় অনেক অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে। আমরা বিভিন্ন প্রতিবেদন দেখছি, যেখানে গ্যাপ রয়েছে সেগুলো ধরেও কাজ করছি। আমাদের বড় একটি অংশ সড়কে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছে। ঈদকে ঘিরে যেন কোনও বিশৃঙ্খলা না হয় সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

যা বলছে র‌্যাব:

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, অপরাধীদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। ঈদে লোকজনের চলাচল বেড়ে যায়। অনেকে আগেভাগে গন্তব্যে পৌঁছাতে চায়। মার্কেটগুলোতে ভিড় হয়। সব কিছু মাথায় রেখে র‍্যাব নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *