ইতিহাস ঐতিহ্যে আহসান মঞ্জিল

ফিচার

জুলাই ৩১, ২০২২ ৭:২৩ অপরাহ্ণ

জাহাঙ্গীর আলম

বুড়িগঙ্গা নদীর পাড় ঘেঁষে কুমারটুলি এলাকায় আহসান মঞ্জিলের অবস্থান। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে শেখ এনায়েত উল্লাহ আহসান মঞ্জিলের বর্তমান স্থানে রংমহল নামের একটি প্রমোদ ভবন নির্মাণ করেন। পরে বিভিন্ন হাতঘুরে তা নবাব আব্দুল গনির হাতে আসে। দেশের নানা জায়গা থেকে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরতে আসেন এই ঐতিহাসিক স্থানে। আহসান মঞ্জিল শত বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য।

আহসান মঞ্জিলের প্রতিষ্ঠাতা নওয়াব আবদুল গনি। পুত্র খাজা আহসানুল্লাহর নামানুসারে এর নামকরণ করেন। ১৮৫৯ সাথে আহসান মঞ্জিলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১৮৭২ সালে সমাপ্ত হয়। আহসান মঞ্জিল থেকেই শুরু হয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের পথ। এখান থেকেই ১৯০৬ সালে এক অনুষ্ঠিত বৈঠকে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়।

শুরুটা যেমন ছিলো আহসান মঞ্জিলের
অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে জামালপুর পরগনার জমিদার শেখ এনায়েত উল্লাহ আহসান মঞ্জিলের বর্তমান স্থান রঙমহল নামে একটি প্রমোদভবন তৈরী করেন। পরবর্তী সময়ে তারছেলে শেখ মতি উল্লাহ রঙমহলটি ফরাসি বণিকদের কাছে বিক্রি করে দেন। ১৮৩০ সালে বেগমবাজারে বসবাসকারী নওয়াব আব্দুল গনির পিতা খাজা আলী মুল্লাহ এটি কিনে বসবাস শুরু করেন।

নতুন রূপে আহসান মঞ্জিল
১৮৮৮ সালের ৭ এপ্রিল প্রবল ভূমিকম্পে পুরো আহসান মঞ্জিলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত আহসান মঞ্জিল পুননির্মাণের সময় বর্তমান উঁচু গম্বুজটি সংযোজন করা হয়। পুননির্মাণ ও মেরামতের জন্য রাণীগঞ্জ থেকে উন্নতমানের ইট আনা হয়। মেরামতকর্ম পরিচালনা করেন প্রকৌশলী গোবিন্দ চন্দ্র রায়। সেই আমলে ঢাকা শহরে আহসান মঞ্জিলের মতো এত জমকালো ভবন আর ছিল না। সাদোপরি গম্বুজটি শহরের অন্যতম উঁচু চূড়া হওয়ায় তা বহুদূর থেকেও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

এক নজরে আহসান মঞ্জিলের ভেতরের পরিবেশ
এই প্রাসাদের ছাদের উপর সুন্দর একটি গম্বুজ আছে। এক সময় এই গম্বুজের চূড়াটি ছিল ঢাকা শহরের সর্বোচ্চ। মূল ভবনের বাইরে ত্রি-তোরণবিশিষ্ট প্রবেশদ্বারও দেখতে সুন্দর। একইভাবে উপরে ওঠার সিঁড়িগুলোও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে দু’টি মনোরম তোরণ আছে যা সবচেয়ে সুন্দর। আহসান মঞ্জিলের অভ্যন্তরে দু’টি অংশ আছে। বৈঠকখানা ও পাঠাগার আছে পূর্ব অংশে। পশ্চিম অংশে আছে নাচঘর ও অন্যান্য আবাসিক কক্ষ। নিচতলার দরবারগৃহ ও ভোজন কক্ষ রয়েছে।

ইতিহাস ঐতিহ্যে আহসান মঞ্জিল

প্রাসাদের বাইরের সোন্দর্য
প্রাসাদের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একতলার সমান উঁচু করে গাড়ি বারান্দা। দক্ষিণ দিকের গাড়ি বারান্দার ওপর দিয়ে দোতলার বারান্দা থেকে একটি সুবৃহৎ খোলা সিঁড়ি সম্মুখের বাগান দিয়ে নদীর ধার পর্যন্ত নেমে গেছে। প্রাসাদের উভয় তলার উত্তর ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে অর্ধবৃত্তাকার খিলানসহযোগে প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দা ও কক্ষগুলোর মেঝে মার্বেল পাথরে শোভিত।

ইতিহাস ঐতিহ্যে আহসান মঞ্জিল

গম্বুজের সোন্দর্যে আহসান মঞ্জিল আলোকিত
আহসান মঞ্জিলের গম্বুজটি নির্মাণের জন্য প্রথমে নিচতলার বর্গাকার কক্ষটির চারকোণায় ইট দিয়ে ভরাট করে গোলাকার রূপ দেওয়া হয়েছে। এর উপর দোতলায় নির্মিত অনুরূপ গোলাকার কক্ষের ঊর্ধ্বাংশে স্কুইঞ্চের মাধ্যমে ছাদের কাছে কক্ষটিকে অষ্টভূজাকৃতির করা হয়েছে। এই অষ্টকোণ কক্ষটিই ছাদের উপর গম্বুজের পিপায় পরিণত হয়েছে।

পরিশেষে অষ্টবাহুর মাথাগুলোকে কেন্দ্রের দিকে ক্রমে হেলিয়ে চূড়াতে নিয়ে কুমদ্র কলির আকারের গম্বুজটি তৈরি করা হয়েছে। ভূমি থেকে গম্বুজ শীর্ষের উচ্চতা ২৭ দশমিক ১৩ মিটার। গম্বুজের সোন্দর্য দর্শনার্থীদের মন ছুঁয়ে যায়। আহসান মঞ্জিলের প্রতিটি কক্ষ ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দেয়।

রঙমহলের ৩১টি কক্ষের ২৩টিতে প্রদর্শনী উপস্থাপন করা হয়েছে। ৯টি কক্ষ লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে প্রাপ্ত ও মি. ফ্রিৎজকাপ কর্তৃক ১৯০৪ সালে তোলা আলোকচিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে সাজানো হয়েছে। আহসান মঞ্জিলের তোষাখানা ও ক্রোকারীজ কক্ষে থাকা তৈজসপত্র ও নওয়াব এস্টেটের পুরনো অফিস এডওয়ার্ড হাউজ থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন নিদর্শন সংরক্ষণ করে প্রদর্শনীতে দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া এই আলোকচিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরি ও সমসাময়িককালের সাদৃশ্যপূর্ণ নিদর্শনাদি ক্রয় ও সংগ্রহ করে গ্যালারিতে উপস্থাপন করা হয়েছে। আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে এ যাবৎ সংগৃহীত নিদর্শন সংখ্যা মোট ৪০৭৭টি।

পুরান ঢাকার ইতিহাস সমৃদ্ধ হওয়ার পেছনে আহসান মঞ্জিলের ভূমিকা অতুলনীয়। বর্তমান সময়ে মুক্ত পরিবেশে আড্ডা দেওয়ার উৎকৃষ্ট স্থানে পরিণত হয়েছে। আহসান মঞ্জিল ইতিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নতুন প্রজন্মের জন্য আহসান মঞ্জিল হতে পারে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *