প্রতিটি নিঃশ্বাস যেখানে শ্বাসরুদ্ধকর। মাঝে মধ্যে মনে হবে যেন ধরগতির কোনো মেঘমালার ভেতর দিয়ে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছেন আপনি। বরফের শুভ্র আভায় চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া এমন এক রাজ্য, যেখানে সাজানো গোছানো একটি শহর আছে।
এই শহরে কুয়াশা এমন যে- হাতে ধরে আবার মুক্ত করে দেওয়া যায়। বিস্তৃত শহরের জানালায় যখন সূর্যের আলো এসে পড়ে- তখনই কেবল বাইরে বের হওয়া যায়। চারপাশের ঘর-বাড়ি এমনকি গাছপালা দেখলেও মনে হয় বরফ দিয়ে বানানো।
যখন আকাশে বাঁকা চাঁদ দেখা যায় তখন সাইবেরিয়ানরা একে বলে তারার ফিসফিসানি। পূর্ব সাইবেরিয়ার ইয়াকুৎস্ককে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে শীতল শহর। এই শহরের তাপমাত্রা বছরে প্রায় তিন মাস মাইনাস চল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে থাকে। এ এক অনন্য অঞ্চল।
পৃথিবীর ভেতর ভিন্ন আরেক জগৎ। রাশিয়ার প্রদেশ সাইবেরিয়ার এক শহরের নাম ইয়াকুৎস্ক। এটি রাশিয়ার উত্তর-পূর্বে লীনা নদীর তীরে অবস্থিত। ত্রিশ লাখ তিরাশি হাজার পাঁচশো তেইশ বর্গকিলোমিটা। উত্তর মহাসাগর পানে ছুটে চলা লীনা নদীর পলি মাটির অববাহিকায় এই শহরের অবস্থান। শহরের ৫০০কিলোমিটার দূরে একটি গ্রাম আছে যেখানে ৫০০মানুষের বসবাস। গ্রামের নাম ওম্যাকন। এই মানুষেরাই পৃথিবীর সবচেয়ে শীতল অঞ্চলের বাসিন্দা। এখানের তাপমাত্রা মাইনাস একাত্তর ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যায়।
১৬৩২সালে ইয়াকুৎস্ক শহরের গোড়াপত্তন হয়েছিল। লীনা নদীর অববাহিকায় প্রথমে একটি দূর্গ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৬৪২সালে দূর্গটি তেতাল্লিশ মাইল সরে এসে অপেক্ষাকৃত উঁচু ভূমিতে স্থায়ীভাবে আজকের অবস্থানে স্থানান্তরিত করা হয়। পূর্বে ভিন্ন মতাবলম্বীদের নির্বাসন দেওয়ার জন্য এটি ব্যবহার করা হতো। সতেরো এবং আঠারো শতকে ইয়াকুৎস্ককে প্রশাসনিক এবং বাণিজ্যিক প্রয়োজনে ব্যবহার করা শুরু হয়। দূর প্রাচ্যে রাশিয়ার উপনিবেশ স্থাপনের জন্য এই জায়গাটির গুরুত্ব বাড়তে থাকে।
এই শহরের দুই তৃতীয়াংশ রাশিয়ান এবং ইউক্রেনীয় বাকীদের অধিকাংশই ইয়াকুৎস্ক। স্থানীয়রা নিজেদের ভাষায় নিজেদের শাখা পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। শাখা শব্দের অর্থ মানুষ। আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এখানে ইয়াকুৎস্কদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এবং উনিশ শতকের মধ্যে তারা জনসংখ্যার ৩৫শতাংশে পৌঁছায়।
ইয়াকুৎস্ক শহরে জাতিগত সংখ্যালঘুদের কয়েক হাজার সদস্য আছেন, যাদের বেশিরভাগ তুঙ্গুস জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত। লীনা নদীর তীরে বিস্তৃত শহরটি ১৯২২সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ইয়াকুৎস্ক স্বায়ত্ব শাসিত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী হয়। ঐতিহ্যগত ভাবে ইয়াকুতীয়ানরা ঘোড়া এবং অন্যান্য গবাদি পশুর ওপর নির্ভরশীল। তেরো শতকের মঙ্গল আক্রমণের পর থেকে ইয়াকুৎস্ক জাতিগোষ্ঠী লীনা নদীর তীরে সমভূমিতে বসবাস করতে শুরু করে। এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগই এখনো গ্রামাঞ্চলে বাস করে। তবে চার শতাধিকাল আগে পশ্চিম থেকে আসা রাশিয়ানদের সংস্পর্শে তাদের জীবনযাত্রা ব্যাপক পরিবর্তন শুরু হয়।
সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে রাশিয়ান সম্রাজ্যের অনুগামী কসাক জাতির লোকেরা সাইবেরিয়ার পৌঁছেছিল এবং ইয়াকুৎস্ক এবং তুঙ্গুসদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। দীর্ঘ যুদ্ধ অবশেষে তারা ইয়াকুৎস্ক এবং তুঙ্গুসদের পরাজিত করে। এবং এই অঞ্চলকে রাশিয়ান সম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করে।
ইয়াকুতীয়ানরা বছরে দুইবার নতুন বছর উদ্যাপন করে। শীতকালীন নববর্ষ পালন করে সমগ্র রাশিয়ানদের সঙ্গে এবং গ্রীষ্মকালীন নববর্ষ পালন করে তাদের প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারে। জুনের মাঝা মাঝি সময়ে উদযাপিত হয় তাদের এই নববর্ষ ‘ইয়াক’। এই উৎসবটি তাদের সূর্য দেবতার সঙ্গে সম্পর্কীত। বৃত্তকার উন্মুক্ত বেদীতে সূর্যের কাছে প্রার্থনার মাধ্যমে শুরু হয় এই উৎসব।
এরা আত্মার আরাধনা করে। তারা তাদের পরলোকগত আত্মাদেরকে আহ্বান করে যেন তারা তাদের আশীর্বাদ করে। তারা এই সময়ে তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে। পোশাকের অলংকার হলো পুঁতির শোভাময় সন্নিবেশ। ধাতব দুল ঝোলানো থাকে। তারপর বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে ঐতিহ্যবাহী নাচের অনুষ্ঠান শুরু হয়।