ডেঙ্গুর টিকা আবিষ্কার : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের পরই প্রয়োগ

জাতীয় স্পেশাল স্লাইড

সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৩ ৭:০৯ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গু রোগের টিকার সফল পরীক্ষা হয়েছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ভার্মন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউভিএম) লার্নার কলেজ অব মেডিসিনের গবেষকেরা যৌথভাবে এই টিকার সফল পরীক্ষা করেছেন। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন—ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪। টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগে দেখা গেছে, চারটি ধরনের বিরুদ্ধেই এই টিকা অ্যান্টিবডি তৈরিতে সাফল্য দেখিয়েছে। টিকার এই সফল পরীক্ষা নিয়ে গত বুধবার (২৭ সেপ্টেম্বর) একটি প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক সাময়িকী ‘ল্যানসেটে’ প্রকাশিত হয়েছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন দিলে তা দেশে ব্যবহার করা যাবে। তিনি বলেন, টিকা এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। আইসিডিডিআরবির বরাত দিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, এই টিকা বেশ কার্যকর। তবে এটি নিয়ে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। প্রয়োজনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছ থেকে অনুমোদন নেওয়া হবে। শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দুপুরে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার চান্দইর গ্রামে নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

এই মুহূর্তে পৃথিবীর কোনো দেশেই ডেঙ্গুর প্রতিষেধক হিসেবে কার্যকর টিকা তৈরি হয়নি উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, টিকা নিয়ে বিশ্বব্যাপী গবেষণা চলছে। ইতিমধ্যে দুটি টিকা তৈরিও হয়েছে। কিন্তু সেগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে না। কারণ, টিকাগুলোয় কিছু সমস্যা রয়েছে। চার ধরনের ডেঙ্গু আছে। টিকা নিলে দেখা যায়, কিছু ভাইরাস দমন হচ্ছে; কিন্তু সব ভাইরাস দমন হয় না। আর যাঁরা একবার ডেঙ্গুর টিকা নিয়েছেন, তাঁদের অন্য ভাইরাসে আক্রমণ করলে অবস্থা বেশি গুরুতর হয়ে যায়। এ কারণে এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গুর টিকা ব্যবহার করা হচ্ছে না।

এই টিকার নাম দেওয়া হয়েছে টিভি-০০৫ (টেট্রাভেলেন্ট)। এই টিকা গবেষকদের একজ আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী মোহাম্মদ শফিউল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, এটি একটি আশাব্যঞ্জক ঘটনা। যেহেতু দেশে ডেঙ্গুর ব্যাপক প্রকোপ চলছে, তার মধ্যে এটি একটি আশার খবর।

গবেষক মোহাম্মদ শফিউল আলম জানান, ‘যারা টিকা নিয়েছেন, তাঁদের আমরা ২০২০ সাল পর্যন্ত দেখেছি। তাঁদের কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হননি।’

বাংলাদেশে ডেঙ্গু টিকা টিভি-০০৫–এর দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা শুরু হয়েছে ২০১৬ সালের ১৩ মার্চ। শেষ হয় ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি।

এতে অংশ নেন ১৯২ জন। তাঁরা সবাই স্বেচ্ছায় অংশ নেন। প্রাপ্তবয়স্ক ১৮ থেকে ৫০ বছর (২০ জন পুরুষ ও ২৮ জন নারী), কিশোর ১১ থেকে ১৭ বছর (২৭ জন পুরুষ ও ২১ জন নারী), শিশু ৫ থেকে ১০ বছর (১৫ জন পুরুষ ও ৩৩ জন নারী) এবং ছোট শিশু ১ থেকে ৪ বছর (২৯ জন পুরুষ ও ১৯ জন নারী)। চারটি বয়সের শ্রেণিতে বাছাই করে টিকা বা প্লাসিবো করা হয়। অর্থাৎ প্রতি দলে ৪৮ জন করে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এসব ব্যক্তির কারও কারও আগেই ডেঙ্গু হয়েছিল, আবার কারও হয়নি। অংশগ্রহণকারীরা সবাই ছিলেন বাংলাদেশি। টিকার বেশির ভাগ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিল সামান্য।

এ গবেষণার সঙ্গে জড়িত আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী রাশিদুল হক বলেন, টিকাটি কতটুকু নিরাপদ এবং এর মাধ্যমে কতটা অ্যান্টিবডি তৈরি হতে পারে সেটাই দেখা আমাদের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো। আমরা দেখেছি, ডেঙ্গুর চারটি ধরনের বিপরীতেই ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যথেষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে।

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে অন্যতম ছিল ফুসকুড়ি বা র‍্যাশ। ১৪৪ জন টিকাগ্রহণকারীর ৩৭ জনের (২৬%) এবং ৪৮ জন প্লাসিবো প্রাপকের মধ্যে ৬ জনের (১২%) ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছিল ফুসকুড়ি। টিকা পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে জ্বর ছিল ৭ জনের (১৪৪-এর ৫%) ক্ষেত্রে এবং আরও ৭ জন গিঁটে ব্যথা (১০৮-এর ৬%) অনুভব করেছেন। টিকা গ্রহণের ১৮০ দিন পর সব অংশগ্রহণকারীর ( ১৪২ জন) মধ্যে বেশির ভাগ সেরোটাইপের (ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন – ৪) বিপরীতে সেরোপজিটিভ দেখা গেছে।

বাংলাদেশে এ বছর এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৯৬ হাজার ৮৩১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাই বলছেন, এর বাইরে অন্তত চার গুণ বেশি মানুষ এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এ বছরের আগে দেশে সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়েছিল ২০১৯ সালে। সেই বছরও টিকা পাওয়া মানুষগুলো সুরক্ষা পেয়েছেন।

গণমাধ্যমকে গবেষক শফিউল আলম বলেন, এই টিকার একটি ডোজই সুরক্ষা দিতে পারে। তবে আরো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে এই টিকা নিয়ে। কারণ, বাংলাদেশে এর দ্বিতীয় ধাপের ট্রায়াল বা পরীক্ষা হয়েছে। টিকাটি ৪২টি বিভিন্ন ধাপের ট্রায়াল সম্পন্ন করেছে বিশ্বের নানা দেশে। ভারতের এর তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শুরু হয়েছে। ডেঙ্গুর হাত থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে এর জোর সম্ভাবনা আছে। আমরাও চেষ্টা করছি এর তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল করার জন্য।

দ্য ল্যানসেট ইনফেকশাস ডিজিজেস-এ প্রকাশিত এই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দৈবচয়নভিত্তিক দ্বিতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমে টিভি-০০৫ টেট্রাভ্যালেন্ট লাইভ-অ্যাটেনুয়েটেড ডেঙ্গু টিকার নিরাপত্তা, ইমিউনোজেনিসিটি বা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তৈরির সক্ষমতা এবং তিন বছর পর্যন্ত রোগ প্রতিরোধক্ষমতার স্থায়িত্বের অবস্থা মূল্যায়ন করা হয়েছে। টিকা দেওয়ার পর বেশির ভাগ স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে চারটি ডেঙ্গুর সেরোটাইপের অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। যাঁরা পূর্বে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁদের অ্যান্টিবডির পরিমাণ বেশি পাওয়া গিয়েছে। যদিও গবেষণাটি কার্যকর মূল্যায়ন করার জন্য ডিজাইন করা হয়নি, তবে এখন পর্যন্ত টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণের কোনো ঘটনা শনাক্ত করা যায়নি।

গবেষণাপত্রে বলা হয়, গবেষণালব্ধ এসব ফলাফল ডেঙ্গুপ্রবণ জনগোষ্ঠীতে ব্যাপক হারে টিভি-০০৫ ডেঙ্গু টিকা ব্যবহারের জন্য উপযোগী করে তোলার পাশাপাশি, তৃতীয় ধাপের কার্যকারিতা ট্রায়াল পরিচালনার জন্য সমর্থন জোগাড় করতে সহায়তা করবে।

দাম কত হবে এই টিকার
জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন এই টিকার সফল পরীক্ষাকে স্বাগত জানান। তবে তিনি দুটি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সেগুলো হলো, এই টিকা যাদের এক বা একাধিকবার ডেঙ্গু হয়ে গেছে, তাদের দেওয়া যাবে কি না এবং এর দাম সাধারণ মানুষের জন্য সাশ্রয়ী হবে কি না।

গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা টিকা নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৬১ জন ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন আগে, টিকার ট্রায়াল শুরুতে তাঁদের পরীক্ষা করে এটা বোঝা গেছে। তাই যাঁদের ডেঙ্গু হয়েছে, তারাও নিতে পারবেন। এই ৬১ জনের টিকা নেওয়ার পর আর ডেঙ্গু হয়নি; বরং তাঁদের অ্যান্টিবডির মাত্রা বেশি ছিল।

দামের প্রসঙ্গে শফিউল আলম বলেন, ভারতের তিনটি কোম্পানি ও ভিয়েতনামের একটি স্থানীয় ওষুধ কোম্পানি এই টিকা বাজারজাত করার অনুমতি পেয়েছে। যেহেতু স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এসব বাজারজাত করার সুযোগ পেয়েছে, তাই এর দাম সাশ্রয়ী হবে বলেই ধারণা করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *