সেপ্টেম্বর ১০, ২০২২ ১০:০৯ পূর্বাহ্ণ
‘বিটিকে কিলার’। এক সময় এই নাম শুনলেই ভয়ে কাঁপত আমেরিকার পিটস্বুর্গের উইচিটা এবং উইচিটা সংলগ্ন এলাকার মানুষ। বিটিকে কিলারের আসল নাম ডেনিস রেডার। তিন দশক ধরে মোট ১০ জনকে নৃশংসভাবে খুন করেছিল ডেনিস।
বিটিকে-র পুরো অর্থ ছিল, ‘বাইন্ড, টর্চার অ্যান্ড কিল’ (অর্থাৎ বেঁধে রাখো, অত্যাচার করো এবং মেরে ফেলো)। ডেনিস নিজেকে বিটিকে খুনি বলত, কারণ সে তার শিকারদের বেঁধে, নির্যাতন করে নির্মম ভাবে খুন করত। তবে তার এই অপরাধের পিছনের কারণ কী? কী কারণেই বা ইতিহাসের অন্যতম ভয়ঙ্কর সিরিয়াল কিলারের তালিকায় নাম তুলল সে?
১৯৪৫ সালের ৯ মার্চ আমেরিকার কানসাসের উইচিটায় জন্ম ডেনিসের। ১৯৬০-এর দশকে সে আমেরিকার বায়ুসেনায় যোগ দেয়। ১৯৭০ সালের দিকে সে বায়ুসেনার চাকরি ছেড়ে উইচিটাতে ফিরে আসে। উইচিটা ফিরে সে বিয়ে করে। দুইটি সন্তানও হয় তার। এরপর ডেনিস কিছু দিন ক্যাম্পিং করার সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী কোলম্যান কোম্পানির কারখানায় কাজ শুরু করে। এই সময় সে একাধিক বার চাকরি বদলেছিল। ১৯৭৯ সালে ডেনিস ‘উইচিটা স্টেট ইউনিভার্সিটি’ থেকে স্নাতক হয়। বিষয় ছিল ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা। এরপর সে নিরাপত্তারক্ষীদের একটি সংস্থায় কাজ শুরু করে।
একজন ধার্মিক মানুষ হিসেবেই এলাকায় পরিচিত ছিল ডেনিস। নিয়মিত গির্জায় যাতায়াত ছিল তার। তবে এরই মধ্যে ডেনিস তার প্রথম খুন করে ফেলেছে। ১৯৭৪ সালের ১৫ জানুয়ারি ডেনিস প্রথম খুন করে। উইচিটাতেই দুই শিশু-সহ এক পরিবারের চার সদস্যকে শ্বাসরোধ করে খুন করে ডেনিস। ঐ পরিবারের গৃহকর্ত্রী এক সময় ডেনিসের সঙ্গে কাজ করতেন। ঘটনাস্থলে বীর্য পাওয়া গেলেও মৃতদের মধ্যে কেউই যৌন নির্যাতনের শিকার হননি বলেও ময়নাতদন্তে উঠে আসে। ডেনিস এই পরিবারের সবাইকে খুনের পর সেখান থেকে একটি ঘড়ি এবং কিছু অন্তর্বাস চুরি করে। পরে জানা যায়, স্রেফ স্মারক হিসেবে এই জিনিসগুলো সে চুরি করেছিল।
১৯৭৪ সালের এপ্রিলে ডেনিস ২১ বছর বয়সি আরো এক তরুণীকে খুন করে। ঐ তরুণীও এক সময় ডেনিসের সঙ্গে একই সংস্থায় কাজ করতেন। ঐ তরুণীর ভাই ডেনিসকে আটকানোর চেষ্টা করে। তবে ডেনিস তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর পর সে পালিয়ে যায়। এরপর তরুণীকে বার বার ছুরির আঘাতে খুন করে ডেনিস। তবে এই খুনের পরও পুলিশের হাতে ধরা পড়েনি সে। প্রথম দুইটি খুনের ঘটনাস্থলেই মৃতদের শরীরের পাশে একটি হাতে আঁকা ছবি খুঁজে পায় পুলিশ। প্রাথমিক ভাবে এই আঁকিবুঁকি দেখে নারীর ছবি মনে হলেও পুলিশ ছবি ঘুরিয়ে দেখতে পায় এতে ‘বিটিকে’ লেখা রয়েছে।
ডেনিসের এতোগুলো খুনের পিছনে আসল কারণ ছিল পরিচিতি পাওয়া এবং সিরিয়াল কিলার হিসেবে নিজের ছাপ রেখে যাওয়া। তবে সংবাদমাধ্যমে তার করা খুনগুলো নিয়ে বিশেষ আলোড়ন তৈরি না হওয়ায় পরের বছর জানুয়ারি মাসে হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দিয়ে নিজেই একটি চিঠি লেখে সে। এই চিঠি সে রেখে দেয় উইচিটারের গ্রন্থাগারের একটি বইয়ের মধ্যে। চিঠি হাতে আসতেই উইচিটায় হইচই পড়ে যায়। চিঠিতে লেখা ছিল, ‘আমার পদ্ধতি হলো বেঁধে রাখা, নির্যাতন করা এবং তারপর তাদের খুন করা। এই কারণে আমি নিজের নাম ‘বিটিকে কিলার’ রেখেছি।’
১৯৭৭ সালের মার্চ মাসে তিনটি বাচ্চাকে বাথরুমে তালাবদ্ধ করার পরে শ্বাসরোধ করে খুন করে ডেনিস। ঐ বছরের ডিসেম্বরে আরো এক নারীকে সে খুন করে। তখনো সংবাদমাধ্যমে তার খুনগুলো নিয়ে বিশেষ চর্চা শুরু না হওয়ায় সে বিরক্ত হয়ে ওঠে। একটি স্থানীয় টিভি চ্যানেলে একটি চিঠি পাঠিয়ে সে লেখে, ‘খবরে নাম তোলার জন্য আমাকে আর কত খুন করতে হবে?’ টিভিতে সেই খবর সম্প্রচারিত হওয়ার পর এলাকা জুড়ে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরের আট বছর ডেনিস আর কোনো খুন করেনি। এরপর ১৯৮৫ সালে এক নারীকে খুন করে ডেনিস। শোনা যায়, ডেনিস ঐ নারীকে স্থানীয় গির্জায় নিয়ে গিয়ে খুন করে। গির্জায় দড়ি দিয়ে ঐ নারীকে বেঁধে তার উপর অত্যাচার করার বেশ কিছু ছবিও তোলে সে।
১৯৮৬ সালে ২৮ বছর বয়সী আরো এক নারীকে খুন করে ডেনিস। নারীর দুই সন্তানের সামনেই তাকে খুন করা হয়েছিল। ১৯৯১ সালে ডেনিস ৬২ বছর বয়সী আরো এক বৃদ্ধাকে শ্বাসরোধ করে খুন করে। তবে সেই সময় এই খুনের ঘটনাগুলোর কিনারা হয়নি। ২০০৪ সালে প্রথম খুনের ৩০ বছর পর স্থানীয় এক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, উইচিটার খুনি সম্ভবত মারা গিয়েছে বা অন্য কোনো জেলে বন্দি। এই প্রতিবেদন দেখে নড়েচড়ে বসে ডেনিস। নিজের জীবনের নবম খুন সংক্রান্ত বেশি কিছু নথি নিজেই ঐ সংবাদমাধ্যমের এক সাংবাদিককে পাঠায় সে। এই নথির মধ্যে ছিল মৃত নারীর ছবি এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স।
এরপর এক বছর ধরে ঐ সংবাদমাধ্যমে খুন সংক্রান্ত আরো বেশ কিছু প্রমাণ পাঠায় ডেনিস। খুনগুলো করার পর মৃতদের বেশ কিছু জিনিস সে স্মারক হিসেবে নিজের কাছে রেখে দিত। আর সেই জিনিসগুলোই ডেনিস বাক্সে ভরে পুলিশ এবং সংবাদমাধ্যমে পাঠাত। ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে খুনের যাবতীয় প্রমাণ একটি ফ্লপির মাধ্যমে পুলিশের কাছে পাঠায় ডেনিস। আর এই ফ্লপি পাঠানোই কাল হয় তার। ফ্লপির সূত্র ধরে ফেব্রুয়ারি মাসে ডেনিসকে গ্রেফতার করে পুলিশ। প্রথম খুনের ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া বীর্যের পরীক্ষা করে প্রমাণিত হয় যে, ডেনিসই খুনি। আদালতে দাঁড়িয়ে ডেনিস সব অপরাধ স্বীকার করে।
আদালতে ডেনিস জানায়, অল্প বয়সে তার মধ্যে পশুদের হত্যা করার প্রবণতা তৈরি হয়েছিল। ছো়টবেলায় সহিংস যৌন কল্পনাও দানা বাঁধতে থাকে তার মাথায়। আর এ থেকেই একের পর এক খুনের নেশা পেয়ে বসে। বিচারে ডেনিসের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা হয়।
সূত্র: আনন্দবাজার