মহিউদ্দিন আহমেদ, সমাজ কর্মী, শেরপুর।।
শেরপুর জেলার ১৫ লক্ষ ৪২হাজার ৬১০ জন নাগরিকের ও ৩ লক্ষ ৩৫ হাজার ৩৫৩টি পরিবারের মধ্যে আমিও একজন। এই জেলার সব নাগরিকের মত আমারও জানতে ইচ্ছা হয় সব জেলার উন্নয়ন হয় শেরপুরে হয় না কেন? সরকার সারা দেশের ব্যাপক উন্নয়ন করেছে এটি অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। তার আগে শেরপুর জেলার নামকরণ সম্পর্কে আপনাদেরকে একটু তথ্য দিতে চাই।
শেরপুর থেকে জামালপুর পর্যন্ত ১০ (দশ) মাইল প্রশস্ত ব্রহ্মপুত্র পারাপারের জন্য কড়ি নির্ধারিত ছিল দশকাহন। এ থেকে ব্রহ্মপুত্র উত্তর—পূর্ববর্তী পরগনার নাম হয় দশকাহনীয়া বাজু। অনুমিত হয় খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতকে এ বাজুর জায়গীরদার হয়ে গাজীবংশের শের আলী গাজী বর্তমান গাজীর খামার বা গড়জড়িপা হতে ২১ বৎসরকাল তাঁর শাসনকার্য পরিচালনা করেন। আর এই কিংবদন্তি শাসকের নামে এ এলাকার নামকরণ করা হয় শেরপুর। ১৯৮৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জামালপুর জেলার শেরপুর মহাকুমাকে জেলা হিসেবে উন্নীত করা হয়। বর্তমানে শেরপুর জেলা ময়মনসিংহ বিভাগের প্রশাসনিক অঞ্চল। ১৯২৯ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত এই জেলা ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত ছিল। শেরপুর জেলার আয়তন ১৩৬৫ বর্গ কিলোমিটার, যার পোস্টকোড ২১০০। এই জায়গাটি একটি সীমান্তবর্তী জেলা যার উত্তরে মেঘালয় যার তুষার শুভ্র মেঘপুঞ্জ নীল গারো পাহাড়। হিমালয় থেকে নেমে আসা একমাত্র পুরুষ নদ ব্রহ্মপুত্র এবং ভোগাই, নিতাই, কংস, সবার শরীর ও মালি ধার মত জলস্রোতের হরিত উপত্যকায় গড়ে ওঠা এক প্রাচীন নগরীর নাম শেরপুর জেলা।
এ জেলায় বর্তমানে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলায় সীমান্তের কোল ঘেষে পাহাড়ি পর্যটন ইতিমধ্যে দেশ—বিদেশে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছে। মাঝে মাঝে ভারতের পাহাড় থেকে শেরপুর জেলার সমতলে বন্য হাতি নেমে এসে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যায়। এ পাহাড়ের চিনামাটি দিয়ে তৈরি হয় অনেক নামী দামী তৈজসপত্র। এই জেলা মূলত কৃষি সমৃদ্ধ। সারাদেশের মোট চালের প্রায় ৩০% চালের যোগান দেয়া হয় এই জেলা থেকে। এখানে বিসিকের ছোট্ট একটি শিল্প স্থাপনের জায়গা ছাড়া কোন শিল্পজোন গড়ে ওঠেনি। তারপরও এ জেলায় ছোট বড় মিলে প্রায় ৬ শত অটো রাইস মিল রয়েছে। গবাদি ও পোল্ট্রি শিল্প ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। শেরপুর শহরের সুস্বাদু মিষ্টি ও দধির ব্যাপক সুনাম রয়েছে সারাদেশে। এই জেলার মানুষ খুবই অতিথি পরায়ন এবং বেশ সহজ সরল। এই জেলায় অনেক খ্যাতিমান কীর্তি পুরুষ প্রয়াত হয়েছেন। বর্তমানেও শেরপুর জেলার অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তি সরকারের উচ্চ পদে কর্মরত রয়েছে। সেনাবাহিনীর চিপ অফ স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জনাব ওয়াকার জামান সাহেবের বাড়ি শেরপুর জেলায়। সরকারের সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব, আইসিটি মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র কৃষি সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন এই জেলার নাগরিক। এখনো পুলিশের ঊর্ধতন কর্মকর্তা রয়েছেন। সারাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ওয়েটও অধ্যাপনা করছেন এই জেলার অনেক ছেলেমেয়ে।
এই জেলার প্রত্যেকটি মাঠে আমি ফুটবল খেলেছি। শহরের এমন কোন পুকুর নেই যে পুকুরে আমি সাঁতার কাটি নাই। এই জেলায় আমার জন্য তাই আমার মনেও প্রশ্ন জাগে কেন হয় না এই জেলার উন্নয়ন? ঢাকা থেকে এই জেলায় যাতায়াতের জন্য একমাত্র সড়ক পথে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। তীব্র যানজট আর সড়কের ভোগান্তি থাকায় সর্বোচ্চ তিন ঘন্টার এই পথে যেতে সময় লাগে এখন ৮ ঘন্টা। অথচ অবহেলিত অর্থনৈতিক সম্ভাবনা না থাকা সত্ত্বেও অনেক জেলায় রেলপথ নির্মাণ করেছে বর্তমান সরকার। উন্নত চিকিৎসা বা চিকিৎসা শিক্ষার জন্য নেই কোন মেডিকেল কলেজ। কোন রোগী যদি উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনতে হয় অনেক ক্ষেত্রে পথিমধ্যেই তার মৃত্যু হয়। ঢাকার বিভিন্ন ম্যাচ এমনকি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে উন্নত শিক্ষার জন্য ছেলেমেয়েরা দিনরাত কষ্ট করছে অথচ বিপুল সম্ভাবনামায় এই জেলায় নেই কোন বিশ্ববিদ্যালয়। সরকার ১০০টি শিল্প জোন নির্মাণ করলেও কৃষি সমৃদ্ধ এবং কৃষি শিল্প বিপ্লব ঘটার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এই জেলায় কোন শিল্পজোন গড়ে তোলা হয়নি। আগেই বলেছি এই জায়গাটি সীমান্তবর্তী একটি জেলা তাই এই জেলায় রয়েছে নাকুগাঁও স্থলবন্দর।
বর্তমানে সারা বছর মাত্র ১০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয় সরকারের এই বন্দর দিয়ে। অথচ এর উন্নতি করা গেলে ১০০০ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। সবুজে ঘেরা মেঘালয়ের মেঘাচ্ছন্ন আকাশ তুষার শুভ্র পরিবেশ এত বিপুল পর্যটন সম্ভাবনাময় থাকা সত্ত্বেও এই জেলাকে পর্যটন জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয় না। এই জেলায় নেই কোন পাঁচতারা মানের হোটেল মোটেল। ফলে বিদেশী পর্যটক এখানে আসে না। ইতিমধ্যে এই জেলার উন্নয়নের জন্য শেরপুর জেলা উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদ আট দফা দাবি নিয়ে রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করছে। যদিও এ সকল উন্নয়ন করতে হলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কেই সরকারের কাছে প্রস্তাব করতে হয়। কিন্তু বিধি বাম, ঢাকায় অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেন এটি কি বেগম মতিয়া চৌধুরীর এলাকা। যিনি বর্তমানে সংসদের উপনেতা এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত আস্থাভাজন ব্যক্তি। বলতে খুব কষ্ট হয় হ্যাঁ তিনি এই জেলা থেকে বারংবার নির্বাচিত একজন প্রতিনিধি। যিনি চাইলেই শেরপুর জেলার ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করতে পারতেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনি দাবি করলে কোন কিছুই বাদ দিতেন না বলে আমাদের বিশ্বাস। গত ১৫ বছরে তিনি ১৫ টি শব্দ শেরপুর জেলার জন্য উচ্চারণ করেছেন সংসদে বলে আমাদের মনে হয় না। অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, সাবেক রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ, তোফায়েল আহমেদ, প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু তার এলাকার জন্য কি না করেছেন। সদরে থেকে নির্বাচিত আতিউর রহমান আতিক বর্তমানে সংসদের হুইপ। তিনি একসময় শেরপুর জেলা কলেজ থেকে নির্বাচিত ভিপি ছিল। কৃষি ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় শেরপুরের জনগণ আশায় বুক বেঁধেছিল, হয়তো হবে উন্নয়ন। কিন্তু না, হয়েছে উল্টো কেবল তার ব্যক্তিগত উন্নয়ন যার সংবাদ আমরা গন মাধ্যমে দেখি।
পর্যটনের দুটি উপজেলা শ্রীবরদী —ঝিনাইগাতি থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যকে কখনো সংসদে পর্যটন জেলা হিসেবে ঘোষণার দাবি নিয়ে সংসদে কথা বলতে দেখিনি। স্থানীয় জনগণ মনে করেন তিনি কেবল নির্বাচনের সময় এলাকায় উপস্থিত হন।
তবে যাই হোক আমি একজন নাগরিক হিসেবে এবং শেরপুর জেলার উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করি। আমার মত শেরপুর জেলার প্রতিটি সন্তানের এই জেলার উন্নয়ন চায়।
শেরপুর জেলার হবে উন্নয়ন সেই প্রত্যাশায় চেয়ে রইলাম।