সাত দিন পর চাল পেলেন মনোয়ারা

দেশজুড়ে

ডিসেম্বর ২১, ২০২২ ১:৫৩ অপরাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক

বৃদ্ধ মনোয়ারা বেগম। বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই। বয়সের ভারে হাঁটতে হয় কুঁজো হয়ে। তবুও এসেছেন ওএমএস’র ট্রাক সেলে।  দীর্ঘলাইনে দাঁড়িয়েছেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তার অপেক্ষা ৫ কেজি চালের জন্য। এর আগেও ট্রাক থেকে চাল নিতে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু দীর্ঘলাইন দেখে হতাশ হয়ে ফিরেছেন খালি হাতে। মনোয়ারা জানান, সকাল ৬টা থেকে দাঁড়িয়ে আছি। আমি বয়স্ক মানুষ।

মানুষের ঠেলাঠেলিতে পড়ে যাই। ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারিও না। এর আগে পরপর ৭ দিন এসে ফিরে গিয়েছি। আজ আবার এসেছি। এগুলো ভাগ্যের খেলার মতো। ভাগ্যে থাকলে পাবো, না হয় আগের মতো ফিরে যেতে হবে। গতকাল অবশ্য ৫ কেজি চাল হাতে পেয়েছেন।

 

রাজধানীর জুরাইনের আলম মার্কেটে সরজমিন দেখা যায়, ওএমএসের একটি ট্রাক সেলের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সামনে কয়েক’শ মানুষের ভিড়। নারী-পুরুষ আলাদা লাইনে পণ্য ক্রয়ের অপেক্ষায়। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলেও ভিড় কমছে না সেখানের। ওএমএসের চাল ও আটা বিক্রি করছে বিক্রেতারা। পণ্য নিতে আসা কয়েকজন সিরিয়াল নাম্বার পেলেও বাকিরা না পেয়ে হতাশ।

দীর্ঘ অপেক্ষার পর ফিরে যেতে হচ্ছে অনেকের। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চাল ও আটা পেয়েছেন অনেকে। তবে দুপুরের পর আটা শেষ হয়ে যাওয়ায় শুধু চাল নিয়ে ফিরতে হচ্ছে বাকিদের। ট্রাক সেলের সামনে দীর্ঘ এই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় বৃদ্ধ মনোয়ারা বেগমকে। তিনি বয়সের ভারে ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। কখন দাঁড়িয়ে থাকা স্থানে বসছেন। আবার লাইনের অন্যরা সামনে দিকে এগিয়ে গেলে ওঠে দাঁড়াচ্ছেন। পণ্য কিনতে পারবেন কিনা ভরসা পাচ্ছেন না তিনি। ৫ কেজি চাল পেলে হয়তো তার কষ্ট কিছুটা ঘুচবে সেটিই প্রকাশ পাচ্ছে তার চেহারায়। সকাল ছয়টায় তিনি এসেছেন পণ্য কিনতে। দুপুর ১টার পরে ৫ কেজি চাল পেয়ে তার মুখে হাসি ফুটেছে কিছুটা। তবে খুশি হলেও কিছুটা অক্ষেপও ছিল দুপুরের আগে আটা শেষ হয়ে যাওয়ায়। তার ইচ্ছে ছিল আটাও ক্রয় করতে পারবেন আজ। ৭ দিন ঘুরে যাওয়ার পর সে আশাও পূরণ হয়নি তার।

মনোয়ারা বেগম বলেন, সকাল থেকে অপেক্ষা করছি। আমি বয়স্ক মানুষ। এর আগে সাতবারের মতো খালি হাতে ফিরে গিয়েছি। এখানে আজ আটা আর চাল দেয়ার কথা শুনেছি। আটা সবাই পায় না। কয়েকজনকে দেয়ার পরেই দেখি আটা শেষ। কিছু কিছু সময় আবার চাল থাকে না শুধু আটা থাকে। আজ আসার পর হাতে সিরিয়াল নাম্বার লিখে দিয়েছে। ক’দিন পাই ক’দিন পাই না। জুরাইন মেডিকেল রোডে ভাড়া বাসায় থাকি মেয়ে ও নাতিকে নিয়ে। মেয়ে বাসা-বাড়িতে কাজ করে। ৩০ বছর আগে স্বামী মারা যায়। ৩৫ বছর ধরে ঢাকায় থাকি। আমিও বাসাবাড়ি ও মেসে কাজ করে সংসার চালাতাম। এই আয় দিয়ে মেয়েকে বড় করেছি। এখন বয়সের ভার ও অসুস্থতার জন্য কাজ করতে পারি না। মেয়ের কাজের টাকায় সংসার চলে।

তিনি বলেন, আমরা গরিব মানুষ বাজার থেকে এত দামে কিনে খেতে পারি না। সবকিছুর দাম অনেক বাড়তি। এখান থেকে নিলে কিছু টাকা বেঁচে যায় তা দিয়ে নাতনির জন্য কিছু খাবার কিনতে পারি। মাসে চার-পাঁচ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিতে হয়। সকাল ৬টা বাজে এসেছি এখানে এই গাড়িটা দেয়ার কথা ছিল মুন্সিবাড়ি মোড়ে কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি গাড়ি নেই। এরপর জুরাইনে দৌড়ে এসেছি। এখানে এসে সকাল ৬টা থেকে দাঁড়িয়ে আছি। দিনটাই শেষ হয়ে যাচ্ছে। যদি এখানে পণ্য দেয়া শেষ হয়ে যায় আবার খালি হাতে ফিরে যেতে হবে। বিশ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে এসেছি আবার বিশ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে যেতে হবে। এই চাল এখানে এক বছর ধরে দেয়। এর আগে ৭ দিন নিতে এসে খালি হাতে ফিরে গেছি আবার আজকে এসেছি। বয়স্ক মানুষ দাঁড়াতে পারি না ঠেলে ফেলে দেয়। কখনো কখনো নিচে পড়ে যাই। এগুলো ভাগ্যের খেলার মতো। মাঝে কয়েকদিন আসিনি। আজকেও আটা শেষ হয়ে গেছে। এখান থেকে ৫ কেজি চাল কিনলে এক’শ টাকা বেচে যায়। কয়েক মাস ধরে ঠিকমতো খেতে পারছি না। এত দামে কিনে খাওয়ার মতো টাকা নেই আমাদের। আমার ওষুধের পেছনে খরচ হয় অনেক টাকা। বাসায় ছোট একটা নাতনি আছে। সংসারে খরচ চালানোর মতো একটি মেয়েই আছে আমার। তার একার আয়ে ধার-দেনা করে কোনোমতে বেঁচে থাকতে হয়।
সংগৃহীত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *