মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান (শাশ্বত মনির)
রক্তার্জিত স্বাধীন দেশে উন্নত-সমৃদ্ধ জীবন প্রত্যাশী জাতি হিসেবে আমাদের জীবনে শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম। শিক্ষা একটি দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগ কিন্তু মানুষের সুকুমার বৃত্তি, মানবিকতার উৎকর্ষ সাধন এবং স্বয়ম্ভরতা অর্জনের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। জাতির স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নে শিক্ষা একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া। এ উপলদ্ধি এবং দৃঢ় বিশ্বাস থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতাত্তোর যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনে আর্থিক সংকট সত্ত্বেও শিক্ষার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
স্বল্পতম সময়ের মধ্যে যুগোপযোগী ও বিজ্ঞানমনস্ক ‘কুদরত-এ-খুদা’ শিক্ষা কমিশন গঠন করে কমিশনের সুপারিশের আলোকে সার্বজনীন শিক্ষা চালুকরণের ভিত্তি হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ এবং পর্যায়ক্রমে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল অভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সহমর্মিতা ও স্বদেশ প্রেমে উদ্দীপ্ত একটি উদার মানবিকতা সম্পন্ন আধুনিক সমাজ নির্মাণ করা। কিন্তু ’৭৫ এর ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাকান্ডের ফলে তাঁর মহান উদ্যোগ তথা পুরো জাতির স্বপ্ন-আশা ধূলিস্বাৎ হয়ে যায়। বাঙালি জাতির শত বছরের সফল সংগ্রামী ইতিহাস, ঐতিহ্য এমনকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুখ থুবড়ে পড়ে। দেশ পশ্চাদমুখি ও কুপমন্ডুকতার অন্ধকার গহ্বরে নিমজ্জিত হয়। দীর্ঘ ২১ বছরের প্রতীক্ষা, প্রতিরোধ, সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগের বিনিময়ে জাতি বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবারো হারানো মর্যাদা এবং অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে পায়।
শেখ হাসিনাও দেশ গঠন পরিকল্পনা ও কর্মযজ্ঞে শিক্ষাকে প্রাধান্য দেন। ঔপনিবেশিক শাসনের ঔরসজাত বিদ্বেষ সৃষ্টিকারক বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনকল্পে সমাজের সর্বস্তরের সুশীল মানুষের মতামতের ভিত্তিতে যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে নানা কার্যক্রম শুরু করেন। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনিও সিলেবাসের বাস্তব সম্মত পরিবর্তন, পরিমার্জন, ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা আওতাভুক্তকরণ, দশম শ্রেণিকে একাদশ, একাদশ শ্রেণিকে দ্বাদশ শ্রেণিতে উন্নীতকরণ, শিক্ষা ও শিখন ক্ষেত্রে সৃজনশীল পাঠ্যক্রম, পরীক্ষা পদ্ধতি ডিজিটালকরণ, গ্রেডিং পদ্ধতিতে ফল প্রকাশ, বিড়ম্বনা ও বাণিজ্য রোধকল্পে অনলাইনে ভর্তি, দ্রুততম সময়ে পরীক্ষার ফল প্রকাশ ইত্যাদি কার্যক্রমে আইসিটির উপর গুরুত্বারোপ, মাল্টিমিডিয়া ক্লাশরুম চালু, কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন এবং বছরের শুরুতে সারাদেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন বই প্রদান, কারিগরি বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার, নারীদের শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধির জন্য নারী শিক্ষা অবৈতনিক করেছেন।
শিক্ষা বান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদার মহানুভবতায় সে অবস্থার বদল হয়েছে। দেশের পাঁচ লক্ষাধিক বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী আন্দোলন ছাড়াই এমপিওভুক্ত হয়েছে এবং জাতীয় বেতন স্কেলের আওতায় ১০০% বেতন পাচ্ছে। সর্বশেষ সরকারি কর্মচারিদের ন্যয় তাদের বেতন দ্বিগুণ হয়েছে; বছরান্তে বেতনের শতকরা ৫% ভাগ প্রবৃদ্ধি স্বয়ংক্রিয়ভাবে হচ্ছে। এখন তারা উৎসব ভাতা, বৈশাখী ভাতা এবং যথাযথ না হলেও বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসাভাতা পাচ্ছেন।
শিক্ষা হচ্ছে একটি অন্তহীন চলমান প্রক্রিয়া। শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে দুটি দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়। একটি হচ্ছে ব্যক্তির দেহমনের উন্নয়ন, ব্যক্তির স্বাত্যন্ত্রবাদের বিকাশ, কোন না কোন পেশায় নিয়োজিত হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ একই সঙ্গে ব্যক্তির আত্মপরিচয়ের ভিত্তি রচনা করা। অপরটি হচ্ছে ভালো নাগরিক হিসেবে ব্যক্তিকে গড়ে তোলা যাতে সে নিশ্চিতভাবে সমাজের কাজে আসে, উৎপাদনক্ষম মানুষ হিসেবে সমাজের উন্নয়নে অংশ নিতে পারে। সেজন্য তাকে পর্যাপ্ত জ্ঞান দান, সেই সাথে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে উদ্দীপ্ত করা। দুটো দৃষ্টি ভঙ্গি সম্পূরক এবং দু’য়ের যোগফলের নামই প্রকৃত শিক্ষা। যার মর্মকথা শিক্ষার মূল্যবোধের বিকাশ। শিক্ষা লাভের পর যদি কেউ ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দের ফারাক না বুঝে, ভালোর পক্ষে অসত্য, কদর্য ও মন্দের প্রতিরোধ করতে না পারে তাহলে সে শিক্ষা সম্পূর্ণটাই বৃথা। দূর্ভাগ্যজনক হচ্ছে আমাদের বর্তমান শিক্ষায় এ চিত্রটাই প্রকট।
শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি কিংবা প্রসারের জন্য স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার সংখ্যা বৃদ্ধির আবশ্যকতা আছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের ক্রমবর্ধনশীলতার সাথে তাল মিলিয়ে উপযুক্ত, যথার্থ শিক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে কি?
পৃথিবীতে এমন কোন দেশ পাওয়া যাবে না শিক্ষায় পিছিয়ে থেকে আর্থ-সামাজিক উন্নতি সাধন করেছেন। আমাদের নীতি নির্ধারকরা সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষও শিক্ষা বলতে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধিতে, পাশের হার বাড়াতে যতটা সক্রিয় শিক্ষার মান অর্জন বা অর্জিত মান ধরে রাখতে ততটাই নিষ্ক্রিয়। ফলে সুদুর প্রসারি পরিকল্পনা বিহীন সারাদেশে প্রতি জেলায় সরকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করছে, বেসরকারি পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ধূম পড়েছে। আমাদের রাজধানীর ন্যায় এত সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর কোথাও আছে কিনা জানা নেই। এসব অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা সনদ পাচ্ছে বটে যথার্থ এবং প্রকৃত শিক্ষা লাভ করছেনা। জ্ঞান অর্জনের আদর্শ পরিবেশ তথা দরজা জানালা বন্ধ রেখে শুধু পাঠ্যপুস্তকে নিমগ্ন থেকে যে করেই হোক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করাই এদের লক্ষ্য, জ্ঞান বৃদ্ধি নয়।
শিক্ষার মানের সঙ্গে পাঠ্য বই এবং শিক্ষকের মানের প্রশ্নও জড়িত। পাঠ্য বই/সিলেবাস হচ্ছে একটি জাতির মানস গঠনের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার বা দর্পণ, আর শিক্ষক হচ্ছেন জাতি গঠনের কারিগর। ফরমায়েশি পাঠ্য পুস্তক কিংবা নীতি বিবর্জিত, দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত মেধাশূন্য, অযোগ্য শিক্ষক উভয়ই এ দর্শনের পরিপন্থী। শিক্ষা এমন একটি ক্ষমতা যেখানে আপস কিংবা গুজামিলের সুযোগ নাই। শিক্ষায় গুজামিল থাকলে সৃজনশীলতা, মুক্ত চিন্তার প্রকাশ সংকুচিত, বাঁধাগ্রস্থ হয়, দূরাচার, দূর্নীতি বৃদ্ধি পায় এবং মানবিক মূল্যবোধ লোপ পায়। সমাজ সরল ভাবে এগুতে পারেনা। সহিঞ্চু ও সৃজনশীল বলে বাঙালির সুনাম ছিল, প্রাকৃতিক ও মানবিক যে কোন বিপর্যয়ে সরকারের আগে মানুষই এগিয়ে আসতো, বিপন্নদের সাহায্য করতো। এখন সবাই নিজেরটা নিয়ে ব্যস্ত। স্বার্থ, লোভ, লালসা আখের গোছানোর উগ্র বাসনা, আধিপত্য বিস্তারের উন্মাদনার কাছে সব মূল্যবোধ ম্লান হয়ে পড়েছে। মানুষ কতটা নির্দয়, পাষন্ড হলে তিন বছরের শিশু ধর্ষিত হয়, কোমলমতির কিশোরেরা পাড়া মহল্লায় গ্যাংস্টার বাহিনী গড়ে তুলে তুচ্ছ কারণে নিজেরা হানাহানিতে লিপ্ত হয়।
কাজেই প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত জাতি হতে হলে আমাদের সর্বাগ্রে শিক্ষানীতির অসঙ্গতি দূর করতে হবে। শিক্ষাকে মনোগ্রাহী ও সৃজনশীল করতে হবে। দেশের খ্যাতিমান চিন্তাবিদ, অভিজ্ঞ ও নির্মোহ শিক্ষকদের দিয়ে পাঠ্যবই তৈরি করতে হবে। শিক্ষাদানের জন্য মেধাবী, নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক নিয়োগ এবং তার জন্য শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় ও সর্বোচ্চ মর্যাদা দিতে হবে। শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিসহ চাকরির নিরাপত্তা বিধান এবং পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্যের সম্পূর্ণ অবসানকল্পে দেশে অভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং এর পূর্ব শর্ত হিসেবে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহ শিক্ষা কার্যক্রম ও ভৌত অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি, দেহ-মনের গঠন ও চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষকদের দ্বারা পরিচালনার জন্য যোগ্যব্যক্তিদের উপযুক্ত স্থানে নিয়োগ দিতে হবে। এটা মুক্ত বাজার, বিশ্বায়নের যুগ। এখন সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা অর্জন করে টিকে থাকতে হবে।
স্বাধীনতাত্তোর কয়েকটি প্রজন্ম চলে গেছে সত্য, কিন্তু আজকের প্রজন্ম নিঃসন্দেহে একটু ভিন্ন যারা মুক্ত চিন্তা, বিজ্ঞান চর্চা, নতুনের উদ্ভাবন ও সৃজনে উদ্যোগী। আমাদের সময়ের সেরা ১০ জনের তুলনায় আজকের পরীক্ষার ফলাফলে সেরা ১০ জন অনেক বেশি মেধাবী, জ্ঞানের প্রতিটি জগতে বিচরণে অভিলাষী। একটা সময় ছিল মেধাবীরা বিদেশে গেলে ফিরত না, এখন পড়াশোনা পশ্চিমা দেশগুলোতে অবস্থানের কঠোরতা এবং দেশের টানেও ফিরতে চায়, দেশ গঠনে নিজের সেরাটা দিতে চায়। এর জন্য বর্তমানে সৃজনশীল কাজের যে ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে তার পরিধি আরো বিস্তৃত করতে হবে। প্রতিযোগিতা সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। শিক্ষা হোক আনন্দের, শিক্ষা হোক সুন্দরের এই প্রত্যাশা করি।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, সাপ্তাহিক শীর্ষ খবর