রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শেষ কোথায়

আন্তর্জাতিক স্লাইড

জুলাই ২, ২০২২ ৮:০৩ পূর্বাহ্ণ

নিহত হয়েছেন হাজারো সেনা, সামরিক সরঞ্জামের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বিলিয়ন ডলারের বেশি। চার মাসের বেশি সময় ধরে ইউক্রেনে অব্যাহত রয়েছে রাশিয়ার সামরিক অভিযান। নিরলস বোমা হামলার শিকার হচ্ছে ইউক্রেনের বিভিন্ন শহর। আর এ যুদ্ধ কবে নাগাদ শেষ হতে পারে তা নিয়েও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মত।

পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ সতর্ক করে বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ স্থায়ী হতে পারে আরও কয়েক বছর। অন্যদিকে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দাবি, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই কমে যাবে রাশিয়ার যুদ্ধের সক্ষমতা।

ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে নজর দেয়ার পর, লুহানস্ক প্রদেশ পুরোপুরি দখলের পথে রয়েছে রাশিয়া এবং দোনেৎস্কের বাকি অংশ দখল না করা পর্যন্ত তাদের এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। একসঙ্গে এ দুই এলাকা নিয়েই গঠিত হয়েছে দোনবাস অঞ্চল।

সম্প্রতি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযান কবে শেষ হবে তার তারিখ নির্ধারণ করে ‘কোনো লাভ নেই’। দোনবাস অঞ্চলকে ‘মুক্ত করার’ উদ্দেশ্যও পরিবর্তন হয়নি বলে জানান তিনি। অর্থাৎ ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল পুরোপুরি দখলে না নেয়া পর্যন্ত এই সংঘাত যে শেষ হচ্ছে না পুতিনের মন্তব্যে তা মোটামুটি স্পষ্ট।

ন্যাটোর সাবেক কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল কনস্টান্টিনোস লুকোপোলোসের মতে, কিয়েভে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়ে পূর্ব ইউক্রেনে নজর দেয়ার পর রুশ জেনারেলরা ধীর গতিতে তবে দৃঢ়ভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

গত সপ্তাহে দেশের অন্যতম প্রধান শহর সেভেরোদোনেৎস্ক থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয় ইউক্রেন। কয়েক সপ্তাহ ধরে রাশিয়ার তীব্র হামলার শিকার হয় শহরটি। পাশাপাশি নিজেদের নিকটবর্তী শহর লিসিচানস্ক দখল করার জন্যও জোর দিচ্ছে রাশিয়া।

তবে এর মধ্যে দেশটি গত বৃহস্পতিবার (৩০ জুন) কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্নেক আইল্যান্ড থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। ইউক্রেনীয় বন্দরগুলো থেকে খাদ্য রফতানি পুনরায় শুরু করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এ পদক্ষেপকে নিজেদের ‘সদিচ্ছা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে মস্কো। তবে এটিকে এক বিজয় হিসেবে স্বাগত জানিয়ে কিয়েভ বলছে, রাশিয়ানদের পিছু হটতে বাধ্য করেছে তারা।

উভয় পক্ষের পাল্টাপাল্টি এমন অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে এ যুদ্ধের স্থায়ীত্ব নিয়ে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় পরিস্থিতি কী, ঘুরেফিরে এখন সেটিই আসছে আলোচনায়।

জেনারেল লুকোপোলোসের মতে, ‘একটি যুদ্ধ তখনই শেষ হয় যখন এক পক্ষ প্রথমে মাঠে এবং তারপর আলোচনার টেবিলে তার ইচ্ছা অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে সফল হয় অথবা উভয় পক্ষই যখন যুদ্ধের পরিবর্তে একটি সমঝোতা চায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে পরেরটি অর্থাৎ সমঝোতা সম্ভবত খুব বেশি দূরে নয়। তা সত্ত্বেও, অবিলম্বে এ যুদ্ধের সমাপ্তি অকল্পনীয় বলেই মনে হচ্ছে।’

যুদ্ধে বিভিন্ন এলাকার উল্লেখযোগ্য ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান পরিস্থিতি একটি দীর্ঘ লড়াইয়েরও ইঙ্গিত দেয়। অনেক বিশ্লেষক আবার বলছেন, এখনই শান্তি আলোচনার দিকে গেলে লাভের তুলনায় ক্ষতিই বেশি কিয়েভের। রাশিয়া আপাতত সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে।

এছাড়া এখনই শান্তি আলোচনায় বসা রাজনৈতিকভাবে ন্যায়সঙ্গত হবে না ইউক্রেনের নেতা ভলোদিমির জেলেনস্কির জন্যও। কারণ এমন উদ্যোগ বিশ্বের সামনে তাকে একজন পরাজিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দাঁড় করাবে, যিনি কেবল যুদ্ধই নয়; নিজ দেশের বড় অংশও হারাবেন।

জেমি শিয়া নামে ন্যাটোর সাবেক নিরাপত্তা বিষয়ক এক কর্মকর্তা সম্প্রতি জানান, ইউক্রেন এখনই সমঝোতায় গেলে রাশিয়ার কাছে তার ভূখণ্ডের এক-পঞ্চমাংশ হারাবে। এর মধ্যে অত্যাবশ্যক বাণিজ্য-বন্দর, দোনবাসের শিল্প ও খনি এলাকা এবং বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি রয়েছে। এসব হারালে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি হুমকির মুখে পড়বে।

যুদ্ধের শুরু থেকেই ইউক্রেনকে অস্ত্রসহ নানা সহায়তা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিয়েভকে অস্ত্র সহায়তা দেয়া নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যেই মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, যুদ্ধ বন্ধ হবে কিনা তা অনেকটাই এখন নির্ভর করছে পুতিনের সিদ্ধান্তের ওপর। আর লড়াই যত দীর্ঘ হবে, ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমা সমর্থন কমে আসার সম্ভাবনা ততই বেশি।

এ যুদ্ধে ইউক্রেনকে সমর্থনকারী পশ্চিমা জোটের মধ্যে সংহতি কমে আসায় অবস্থান পাল্টে জোটের অনেক সদস্য দেশ এরইমধ্যে যুদ্ধবিরতি এবং আলোচনার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে।

জেমি শিয়া মনে করেন, বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সামনে দুটি সম্ভাব্য পরিস্থিতি রয়েছে। হয় ইউক্রেন পশ্চিমাদের সমর্থন নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত রাশিয়াকে ইউক্রেন থেকে সম্পূর্ণভাবে তার সেনা প্রত্যাহারে বাধ্য করবে। অথবা উভয় পক্ষই কোনো সমঝোতায় পৌঁছাবে।

জেমির মতে, “মস্কো ইউক্রেনের দখল করা অঞ্চলগুলোর ‘রাশিয়াকরণ’ নিয়ে এগিয়ে যাবে এবং সেগুলোর মধ্যে কিছু এলাকা সরাসরি রাশিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করতে পারে। যুদ্ধবিরতি, সেনা ও অস্ত্র প্রত্যাহারের মতো বিষয়গুলো নিয়ে কিয়েভ, মস্কো এবং আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের মধ্যে যে দীর্ঘ এবং ফলহীন আলোচনা অতীতে দেখা গেছে, তা আবারও শুরু হবে।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়ার হাতে চলে যাওয়া এলাকাগুলো ফিরিয়ে নিতে ইউক্রেনকে বড় ধরনের বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। আবার রাশিয়াও জানে যে তারা পুরো ইউক্রেন জয় করতে পারবে না। ফলে মস্কো শুধু দোনবাসের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে এবং ইউক্রেন যুদ্ধকে একটি ‘হিমায়িত সংঘাতে’ পরিণত করার দিকেই মনোনিবেশ করতে পারে।

আল-জাজিরা অবলম্বনে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *