যে কারণে বারবার বিমান দুর্ঘটনা হয় নেপালে

যে কারণে বারবার বিমান দুর্ঘটনা হয় নেপালে

আন্তর্জাতিক স্লাইড

জানুয়ারি ১৭, ২০২৩ ১১:২১ পূর্বাহ্ণ

নেপালের পর্যটন অঞ্চল পোখারায় ৭২ আরোহী নিয়ে যাত্রীবাহী একটি বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এখন পর্যন্ত মোট ৬৮ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। চারজন এখনো নিখোঁজ থাকলেও তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

রোববার (১৫ জানুয়ারি) সকালে কাঠমান্ডু থেকে পোখারার উদ্দেশে যাত্রা করে ইয়েতি এয়ারলাইন্সের বিমানটি। কিন্তু অবতরণের মাত্র ১০ সেকেন্ড আগে সেটি বিধ্বস্ত হয়।

এদিকে দেশটিতে গত ৩ দশকে এনিয়ে মোট ২৭টি বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে গতকালের বিমান দুর্ঘটনাটি নেপালের ৩০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা। এরফলে আবারও আলোচনায় কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে নেপালে বিমান দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে।

নেপালে কেন এত বিমান দুর্ঘটনা?

সংশ্লিষ্টদের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেপালে বিমান দুর্ঘটনার বেশির ভাগই ঘটে দেশটির রুক্ষ পাহাড়ি ভূখণ্ড, নতুন বিমান এবং অবকাঠামোতে বিনিয়োগের অভাব এবং শিথিল নিয়মের কারণে।

এ ছাড়াও নেপালের আকাশপথগুলো পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত, যেখানে আবহাওয়ার পরিবর্তন হয় অনেকটা আকস্মিক। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ২০১৩ সালে নিরাপত্তা উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে নেপালভিত্তিক সব বিমান সংস্থাকে তাদের আকাশসীমায় চলাচল নিষেধ করেছিল। সংবাদমাধ্যম কাঠমান্ডু পোস্ট জানিয়েছে, সরকারের ব্যর্থতার কারণে এখনও নেপালের অনেক বিমান সংস্থা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সেই নিষেধাজ্ঞায় রয়েছে।

এভিয়েশন সেফটি ডেটাবেসের বরাত দিয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানিয়েছে, গত ৩০ বছরের মধ্যে নেপালে ২৭টি মারাত্মক বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০টিরও বেশি ঘটেছে গত দশকে।

সমাধান কী?

গত বছরের ২৯ মে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে প্রথমে নিখোঁজ হয় তারা এয়ারের একটি বিমান। পরে একটি পাহাড়ের কোলে বিমানটির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। একে একে উদ্ধার করা হয় বিমানটিতে থাকা ২২ আরোহীর মরদেহ। পোখরা-জোমসোম রুটে গত তিন দশকে নেপালের বেশ কয়েকটি ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার মধ্যে এটি একটি।

ওই দুর্ঘটনার পর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান বিষয়টি নিয়ে কথা বলে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, নেপালে বিমান চলাচল নিরাপদ করতে কী করা যেতে পারে এবং কী কারণে বারবার ঘটছে এমন দুর্ঘটনা।

নেপাল অ্যাসোসিয়েশন অব ট্যুর অপারেটরস-এর সভাপতি অশোক পোখারেল গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পুরোনো বিমানগুলোতে আধুনিক আবহাওয়ার রাডার নেই। এটি বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে, যাতে প্লেনের ক্যাপ্টেনের কাছে রিয়েল-টাইম আবহাওয়ার তথ্য থাকে।’

প্রতিবেদন অনুযায়ী, তারা এয়ারলাইনস তাদের প্রথম ফ্লাইট পরিচালনা করেছিল ১৯৭৯ সালে। এতে জিপিএস প্রযুক্তিও ছিল না, যা পাইলট কম দৃশ্যমানতায় ব্যবহার করে থাকেন।

বেড উপ্রেতি নামে এক অভিজ্ঞ পাইলট (ক্যাপ্টেন) গার্ডিয়ানকে বলেন, ৪৩ বছর বয়সী একটি বিমান চালিয়ে যাওয়া যেকোনো পাইলটের জন্যই চ্যালেঞ্জিং। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে, নেপালে বেশির ভাগ ‘ফিক্সড-উইং’ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী শর্ট টেকঅফ এবং ল্যান্ডিং বিমানগুলো। আর এসব বিমানই নেপালের জোমসম বা লুকলার মতো দূরবর্তী স্থানে উড়ে যায়, যেগুলো হিমালয়ের দর্শনার্থীদের কাছে যাত্রা শুরুর জনপ্রিয় স্থান হিসেবে পরিচিত।

তিনি বলেন, প্রযুক্তির অভাবের কারণে শর্ট টেকঅফ এবং ল্যান্ডিং বিমানগুলোর নেপালের মতো জায়গায় চলাচল বিপজ্জনক।

নেপালে বারবার দুর্ঘটনার পর প্রশ্ন উঠেছে যে, ফ্লাইটের আগে এবং ফ্লাইট চলাকালীন যেকোনো ভুল এড়াতে সেখানকার পাইলটরা প্রয়োজনীয় তথ্য ও প্রযুক্তির নাগাল পান কি না। এ বিষয়ে নেপালি সরকারের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ ড. অর্চনা শ্রেষ্ঠা গার্ডিয়ানকে জানান, ১০ হাজার ফুটের কম উচ্চতায় চলাচলকারী অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট রুটের জন্য প্রয়োজনীয় আবহাওয়া পরিষেবা দেয়ার মতো সক্ষমতা তাদের নেই।

যদিও নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক ভ্রমণের জন্য আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ এবং পূর্বাভাস দেয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করা হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে গেছে অভ্যন্তরীণ রুটের পরিষেবা।

নেপালের আলোচিত কিছু বিমান দুর্ঘটনা

প্রথম দুর্ঘটনার মধ্যে একটি: ১৯৬২ সালের ১ আগস্ট তৎকালীন রয়্যাল নেপাল এয়ারলাইনস পরিচালিত একটি ডগলাস ডিসি-৩ বিমান নেপালে বিধ্বস্ত হয়। গাউচার বিমানবন্দর (বর্তমান ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) থেকে ভারতের পালাম বিমানবন্দরে (বর্তমান ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) যাওয়ার পথে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

নাইনএন-এএপি নিবন্ধিত বিমানটির ধ্বংসাবশেষ পরে নেপালের তুলাচান ধুরির কাছে পাওয়া যায়। এটি ছিল নেপালের প্রথম বিমান দুর্ঘটনার একটি।

ওই দুর্ঘটনায় ১০ জন যাত্রী ও চার জন ক্রু নিহত হয়েছিলেন। তদন্তে জানা যায়, বিরূপ আবহাওয়ার কারণে বিমানটি তার গতিপথ থেকে সরে যায় এবং ১১ হাজার ২০০ ফুট উঁচুতে একটি পাহাড়ের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়।

থাই এয়ারওয়েজের দুর্ঘটনা: ১৯৯২ সালের ৩১ জুলাই থাইল্যান্ডের ডন মুয়াং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসছিল থাই এয়ারওয়েজের আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ৩১১। এইচএস-টিআইডি নিবন্ধিত এয়ারবাস এ৩১০-৩০৪ ফ্লাইটটি ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি এসে বিধ্বস্ত হয়।

ক্যাপ্টেন এবং এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের ভাষাগত এবং প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে ‘পরিস্থিতিগত সচেতনতার অভাব’ এ দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে জানা যায়।

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস ট্র্যাজেডি: ২০১৮ সালের ১২ মার্চ নেপালের কাঠমান্ডু ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি যাত্রীবাহী বিমান বিধ্বস্ত হয়। ওই ঘটনায় ৫১ জন যাত্রী ও ক্রু প্রাণ হারান। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা আর ঘটেনি। এমনকি ১৯৯২ সালের পর নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও এর চেয়ে ভয়াবহ কোনো বিমান দুর্ঘটনা ঘটেনি।

স্মরণকালের ভয়াবহ এই বিমান দুর্ঘটনায় ৭১ জন আরোহীর মধ্যে ৪ জন ক্রুসহ মোট ২৭ জন বাংলাদেশি, ২৩ জন নেপালি এবং একজন চীনা যাত্রী নিহত হন। এ ছাড়াও ওই ঘটনায় নয়জন বাংলাদেশি, ১০ জন নেপালি, একজন মালদ্বীপের নাগরিক আহত হন।

সেদিন ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের নেপালগামী ওই ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন ছিলেন আবিদ সুলতান, তার সঙ্গে কো-পাইলট ছিলেন পৃথুলা রশিদ। ৫১ জন যাত্রী ও ক্রুর সঙ্গে নিহতের তালিকায় ছিলেন তারাও। ওই দুর্ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যান ২০ জন। যদিও গুরুতর আঘাতের কারণে তাদের অনেককেই দীর্ঘসময় চিকিৎসা নিতে হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *