ভারতের ঘরোয়া লিগ ‘রঞ্জি ট্রফি’। কর্নাটকের বিপক্ষে সেদিন ব্যাট হাতে মাঠে নেমে ৪০ রানে অপরাজিত ছিলেন ১৭ বছর বয়সী এক ব্যাটার। এরই মাঝে খবর আসে বাবার অসুস্থতার। মনস্থির করলেন বাড়িতে ফিরে যাবেন। কিন্তু নিয়তির কি অদ্ভুত খেয়াল! সেদিনই রাত ৩টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তার বাবা প্রেম কোহলি।
এবার কি করবে ছেলেটা? নিশ্চয়ই বাবা শেষকৃত্য সম্পন্ন করবে। সেটা সে করছিলোও। কিন্তু ততক্ষণে ক্রিকেট ঈশ্বর লিখে ফেলেছেন তার জীবনের একটা অধ্যায়। বুঁকে শোকের পাথর চাপা দিয়ে ৯০ রানের ইনিংস খেলে দলকে পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা করে তবেই শেষ সময়ে হাজির হয়েছিলেন বাবার শেষকৃত্যে।
ছেলেটার নাম বিরাট কোহলি। জীবনের এই একটি অধ্যায়ই ঘুরিয়ে দিয়েছে তার জীবনের গল্পের মোড়। শোককে শক্তিতে পরিণত করে নিজের ভেতরের সব আবেগ এবং ভালোবাসাকে এক জায়গায় এনে শুরু করেছিলেন কঠোর পরিশ্রম। উদ্দেশ্য বাবার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন।
ছোট থেকেই নিজের জাত চিনিয়েছেন কোহলি
কোহলি পেরেছে, সে আজ বিশ্ব ক্রিকেটের আকাশে জ্বলজ্বলে নক্ষত্র। তবুও স্মৃতির ডালপালা এসে ভীড় করে তার মস্তিষ্কে, “বাবার মৃত্যু আমাকে বদলে দিয়েছিল। অন্য আর সবকিছুতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে সব শক্তি এক জায়গায় এনে ফেলেছিলাম। আমারও অবশ্য একই স্বপ্ন ছিল।”
কোহলি মাঠে নামেন। সবুজ গালিচার চারদিকে ব্যাট নামক তুলির আচড়ে দক্ষ শিল্পীর মতো নিপুণ কায়দায় এঁকে যান বিরল সব চিত্রকর্ম। সে চিত্রকর্মে বল নামক ছয় আউন্সের চর্মগোলকটা কখনো সবুজ গালিচার ঘাস মাড়িয়ে ছুঁয়ে দেয় গোলকধাধার শেষপ্রান্ত। আবার কখনো উড়ে গিয়ে পড়ে সবুজগালিচার বাহিরে লোক লোকারণ্যের ভীড়ে। কি যে তার সৌন্দর্য্য!
কোহলির এই অদ্ভুত চিত্রকর্ম আঁকা যেন শেষ হতেই চায় না। দিন, মাস, বছর পেরিয়ে আবার নতুনের আগমন ঘটে এবং একই পরিক্রমায় সেটা চলতে থাকে। তবুও তার ব্যাট থামে না। আসলে থামানো যায় না। থেমে গেলেও সেটা ক্ষণিকের। ক্রিকেট ঈশ্বরের রাজ্যে সে যেন এক সৌন্দর্য্যের দেবতা।
কোহলির প্রতিটি শটই যেন আলাদা স্বাদের সৌন্দর্য
ক্যারিয়ারে সবারই খারাপ সময় আসে। তার স্বাক্ষী হয়েছিলেন কোহলিও। ২০১৯ সালের পর তিন-তিনটা বছর গত হয়েছে ক্যালেন্ডারের পাতায়। তবুও হাসছিল না কোহলির ব্যাট। চারদিক থেকে ধেয়ে আসা অজস্র দুয়ো, সমালোচনা, তীর্যক কথার বাণ জর্জরিত করে ফেলেছিল কোহলিকে।
কখনো বাউন্ডারি লাইনে, কখনো বা ৩০ গজ বৃত্তে ধরা পড়ে ছটফট করেছেন খাঁচায় বন্দি পাখির মতো। আকাশে উড়বেন, আগ্রাসনের চূড়ান্তটা দেখাবেন, হাসবেন; এই তো কোহলি। সব কিছুর অবসান ঘটলো আরব আমিরাতের মাটিতে। দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরিতে ১০২০ দিন পর ফিরে পেলেন নিজেকে।
বাবার মৃত্যু তাকে পাথরের ন্যায় শক্ত করে তুলেছিল। ক্রিকেট নামক খেলাটাকে নিয়েছেন জীবনের কঠিন নির্মমতার অংশ হিসেবে। তারই প্রতিফলন দেখা যায় বাইশগজের প্রান্তরে। এখানে একটা ক্যাচ নেয়ার পর তার অঙ্গভঙ্গি কিংবা শতক উদযাপনের নানান দৃশ্য অনেকের কাছে মনে হয় অসহ্যকর, বিরক্তিকর। কিন্তু তাতে তার কিছু আসে যায় না।
কোহলির নানা সময়ের অঙ্গভঙ্গি অনেকের কাছেই অসহ্যকর, বিরক্তিকর লাগলেও তার ব্যাটিংয়ের ভক্ত সবাই
কোহলি জবাব দেন ব্যাটে, তাকে ঘৃণা করা ব্যক্তিকেও বাধ্য করেন ভালোবাসতে, মোহ করে ফেলেন ব্যাটিং সৌন্দর্য্যের অদ্ভুত মায়ায় কিংবা পেশাদারিত্বের সর্বোচ্চ চেষ্টার প্রতিফলনে। ক্রিকেটও তাই তাকে দিচ্ছে দু’হাত ভরে। তিনি দেখিয়ে দিচ্ছেন পেশাদারিত্বের সাথে কোনো আপোষ নয়।
কোহলি তাই আজও বিশ্ব ক্রিকেটের আকাশে জ্বলজ্বল করতে থাকা ধ্রুবতারা। আজ থেকে ঠিক এক শতাব্দী পরও যদি ক্রিকেটের সৌন্দর্য্যের ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়, পেশাদারিত্বের চূড়ান্ত উদাহরণ দেখতে চাওয়া হয়, তবে নির্দ্বিধায় চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যাবে কোহলির নাম।
গল্পের শুরু ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট, শ্রীলংকার ডাম্বুলায়। সেই থেকে টানা ১৪ বছর ধরে কোহলি অনবরত গল্প লিখে চলছেন। গল্পের বাঁকে বাঁকে কান্না আছে, শোক আছে, লড়াই আছে, ব্যর্থতা আছে, আছে সফলতার এক সমুদ্র উপমাও। কোহলির গল্পে কোনো শুকতারা, ধ্রুবতারা কিংবা ধুমকেতু নেই। আছে কেবল একটা নক্ষত্র!
কোহলির গল্পে কোনো শুকতারা, ধ্রুবতারা কিংবা ধুমকেতু নেই। আছে কেবল একটা নক্ষত্র!
প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম যাবে আসবে, ক্রিকেটে রথী-মহারথীদের তালিকাও ভারী হবে কিন্তু তাদের কাছে একজন বিরাট কোহলি কিংবা পরিশ্রমের গল্পটা নতুনই রয়ে যাবে। যে গল্পের শেষের আদি কিংবা অন্ত নেই। কোহলি হয়ে থাকুক বিশ্ব ক্রিকেটের এক বিস্ময়কর চরিত্র।