বাজারে কৃত্রিম সংকট, ফের বাড়ছে দাম

অর্থনীতি স্লাইড

এপ্রিল ১০, ২০২২ ১২:০৩ অপরাহ্ণ

আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে মিল মালিকরা আবারও এর দাম বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব করেছে। সরকারের পক্ষে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বুধবার এ প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে। এরপর থেকেই বাজারে সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হতে শুরু করে। এখন পাঁচ লিটার ও দুই লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না বললেই চলে। খোলা সয়াবিনও মিলছে কম। এদিকে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে ভোজ্যতেল। এ কারণে দাম আবার বাড়তে শুরু করেছে।

রোজা ও ঈদ উপলক্ষ্যে ভোজ্যতেলের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার সয়াবিন ও পাম ওয়েল আমদানির ওপর ১০ শতাংশ, উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং বিপণন পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করেছে। এর আগে এলসি কমিশন ও মার্জিন প্রত্যাহার করা হয়েছে। এরপরও বাজারে তেলের দাম কমছে না। বরং বেড়েইে চলেছে। এসব সুবিধা দেওয়ার পর ২০ মার্চ তেলের দাম প্রতি লিটার ১৬৮ টাকা থেকে ৮ টাকা কমিয়ে ১৬০ টাকা নির্ধারণ করে। কিন্তু ওই দরে বাজারে তেল পাওয়া যাচ্ছিল না। ১৭০ থেকে ১৭৫ টাকা লিটার দরেই বিক্রি হচ্ছিল। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বাজারে অভিযান চালিয়ে নির্ধারিত দরে তেল বিক্রি না করে বেশি দামে বিক্রির প্রমাণ পেয়েছে। ফলে তারা অনেক ব্যবসায়ীকে জরিমানা করেছে। তাতেও বাজারে তেলের দাম কমেনি।

এদিকে দাম বৃদ্ধির দুই সপ্তাহ অতিক্রম হওয়ার আগেই আবার সয়াবিনের দাম বাড়ানোর জন্য মাঠে নেমেছেন তেলের মিল মালিকরা। তারা বুধবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে একটি বৈঠক করে তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। তারা বলেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিনের দাম বেড়েই চলেছে। এর সঙ্গে বেড়েছে জাহাজ ভাড়া। ফলে আমদানি খরচ অনেক বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় তেলের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু সংস্থাটি ওই প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গেই নাকচ করে দেয়। অধিদপ্তর বলেছে, ঈদের পরে এ বিষয়ে আবার বৈঠক হবে। তখন এ বিষয়ে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

সূত্র জানায়, মিল থেকে এখন যেসব তেল বাজারে ছাড়া হচ্ছে সেগুলোর এলসি খোলা হয়েছে কমপক্ষে তিন মাস আগে। ওই সময়ে তেলের দাম বেশ কম ছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে আবার বাড়তে শুরু করেছে। এই দরে এখন যেসব এলসি খোলা হচ্ছে সেগুলো দেশে আসবে কমপক্ষে তিন মাস পর। এগুলো বন্দর থেকে খালাস হয়ে কোম্পানিতে পরিশোধন হয়ে বাজারে আসতে সময় লাগবে আরও কমপক্ষে এক মাস। সব মিলে বাড়তি দামে আমদানি করা তেল বাজারে আসতে কমপক্ষে ৪ মাস লাগবে। কিন্তু মিল মালিকরা এখনই ভোজ্যতেলের দাম বাড়াতে চাচ্ছেন।

ভোক্তা অধিদপ্তর দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নাকচ করে দিলে বুধবার থেকেই বাজারে সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট দেখা দেয়। ওইদিন কক্সবাজারে তেলের সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামেও সয়াবিন তেলের সংকট দেখা দেয়। শুক্রবার রাজধানী ঢাকার অনেক বাজারে ৫ ও ২ লিটারের বোতল পাওয়া যায়নি। ১ লিটারের বোতল পাওয়া গেলেও তা ছিল চাহিদার তুলনায় অনেক কম। খোলা সয়াবিন তেল পাওয়া গেলেও বিক্রি হয়েছে বাজার দরের চেয়ে প্রায় ৪০ টাকা বেশি দামে। বেশি দামে তেল বিক্রির দায়ে শনিবার মিরপুর শাহ আলী মার্কেটে অভিযান চালিয়ে ভোক্তা অধিদপ্তর ৫ ব্যবসায়ীকে চার লাখ টাকা জরিমানা করেছে।

এদিকে অনুসন্ধানে দেখা যায়, খোলা সয়াবিনের দাম বেশি হওয়ায় বোতল থেকে তেল ড্রামে ঢেলে খোলা হিসাবে বিক্রি করা হচ্ছে। কারণ ক্রেতাদের বড় একটি অংশ সক্ষমতার অভাবে এখন খোলা তেল কিনছেন। ফলে ব্যবসায়ীদের এতে মুনাফা বেশি হচ্ছে। খুচরা বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬০ টাকা লিটার দরে বিক্রির কথা থাকলেও বাজারে যেগুলো পাওয়া যাচ্ছে তা ১৭০ টাকার কমে বিক্রি করছে না দোকানদাররা। খোলা সয়াবিন তেল ১৩৬ টাকা লিটার বিক্রির কথা থাকলেও বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ টাকা দরে।

কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তি। তাই সরকারের পক্ষ থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার ছাড়াও বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাজারে অস্থিরতা দূর হয়নি। তাই তেলের বাজারে অস্থিরতা দূর করে ক্রেতাকে স্বস্তি দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে কারা কারসাজি করছে তাদের চিহ্নিত করতে হবে। পাশাপাশি কঠোর আইনের আওতায় আনতে হবে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, সরকার ইতোমধ্যে আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট রেখে অন্যান্য সব ভ্যাট প্রত্যাহার করেছে। ফলে নতুন আমদানিতে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার আশঙ্কা খুবই কম। এক্ষেত্রে প্রতি লিটার তেলে ২০ টাকা পর্যন্ত কমার সম্ভাবনা রয়েছে। তারপরও আন্তর্জাতিক বাজার পর্যালোচনা করে ঈদুলফিতরের পর সব পক্ষকে নিয়ে সমন্বয় সভা হবে। সেখানে ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।

চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রামের ভোগ্যপণ্যের অন্যতম বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ-চাক্তাইয়ে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ভোজ্যতেলের দাম মনপ্রতি বেড়েছে ৫০০ টাকা। খুচরায় তা আরও বেশি। সংশ্লিষ্টরা জানান, ট্রেডার বা ডিও ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি তেলের বাজার। তাদের কারসাজিতে এখনো চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন ও পাম অয়েল। খাতুনগঞ্জের পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী আবদুর রাজ্জাক জানান, বর্তমানে প্রতি মন সয়াবিন (৩৭.৩২ কেজি) পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার ৫০০ টাকা দরে, যা ৭-৮ দিন আগেও ছিল ৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ মনপ্রতি বেড়েছে ৫০০ টাকা। খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার ৮০০ টাকা। অথচ সরকার যেসব সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে এ খাতে, তা হিসাব করলে প্রতি মন সয়াবিনের পাইকারি মূল্য হওয়ার কথা ৫ হাজার থেকে ৫ হাজার ২০০ টাকা। পাম অয়েল প্রতি মন বিক্রি হচ্ছে পাইকারিতে ৫ হাজার ৮০০ টাকা। পাশাপাশি খুচরায় বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ১০০ টাকা। সরকারি দামে বিক্রি হওয়ার কথা ছিল ৪ হাজার ৫০০ ও ৪ হাজার ৭০০ টাকায়। কেজি হিসাবে খোলা সয়াবিনের দাম ১৩৬ টাকা হওয়ার কথা থাকলেও পাইকরিতেই তা ১৬০ ও ১২৮ টাকার পাম অয়েল ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *